ফরাসী বিপ্লবের আরেক অধ্যায়?

বিশ্বকাপে ফ্রান্সের যাত্রাটা বেশ অম্লমধুর। বিগত ছয় আসরের মাঝে দুবারের চ্যাম্পিয়ন দল তাঁরা, জিদানের সেই বিখ্যাত ঢুসের কান্ড না ঘটলে সংখ্যাটা বাড়তে পারত আরও এক। বিপরীতে মুদ্রার উল্টোপিঠও আছে, দুবার তাঁরা বাদ পড়েছে গ্রুপ পর্ব থেকেই। এবারের বিশ্বকাপ তাই ফ্রান্সের জন্য পুরনো অভিশাপ ঘুচানোর। বিশ্বকাপ জয়ের লক্ষ্যে তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার মিশেলে ভারসাম্যপূর্ণ এক দলই ঘোষণা করেছেন কোচ দিদিয়ের দেশম। 

বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন গত দুই বছরে সময়টা ভাল কাটছে না দেশমের শিষ্যদের। ২০২০ ইউরোতে দ্বিতীয় রাউন্ডেই সুইজারল্যান্ডের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত নেশন্স লিগের শেষ করতে হয়েছে গ্রুপের শেষ দল হয়েই। তাছাড়া ইতিহাসও কথা বলছে ফ্রান্সের বিপক্ষে। ফরাসিরা যে দুবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, সেই দুইবারই খেলা হয়েছে ইউরোপে। সেই ১৯৮৬ বিশ্বকাপের পর ইউরোপের বাইরে অনুষ্ঠিত হওয়া কোনো বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালের গণ্ডি পেরোতে পারেনি তাঁরা।

সব মিলিয়ে ফ্রান্সের সামনে কাতার বিশ্বকাপে অপেক্ষা করছে বন্ধুর এক পথ। তবে ফ্রান্সের স্কোয়াডে রয়েছেন অসাধারণ সব তারকা ফুটবলার যারা কিনা ক্লাব ফুটবলে রয়েছেন দারুণ ফর্মে। ফরাসি ফুটবলের সমর্থকরা তাই আশা রাখতেই পারেন দলের উপর।

গত বিশ্বকাপে বেশিরভাগ ম্যাচে ৪-২-৩-১ কিংবা ৪-৩-১-২ ফর্মেশনে খেলালেও গত চার বছরে নিজের ফুটবল দর্শনে পরিবর্তন এনেছেন কোচ দিদিয়ের দেশম। বিশেষ করে ইউরো ব্যর্থতার পর থেকে তিন সেন্তারব্যাক খেলানোতেই বেশি মনোযোগী তিনি। ফলে এবারের বিশ্বকাপে ফ্রান্সকে ৩-৪-১-২ ফর্মেশনে খেলতে দেখার সম্ভাবনাই বেশি। গোলবারের নিচে রয়েছেন যথারীতি অভিজ্ঞ হুগো লরিস।

বয়স ৩৫ ছাড়ালেও এখনও তিনিই কোচের প্রথম পছন্দ। এছাড়া দলের নেতৃত্বের ব্যাটনও থাকবে তাঁর হাতেই। সেন্টারব্যাক হিসেবে ডায়োট উপামেকানো এবং রাফায়েল ভারানের জায়গা এক প্রকার নিশ্চিত। তৃতীয় সেন্টারব্যাকের জায়গার জন্য লড়বেন জুলস কুন্ডে, উইলিয়াম সালিবা, প্রেসনিল কিমপেম্বে, ইব্রাহিমা কোনাটের মত ডিফেন্ডাররা। তবে সাম্প্রতিক ফর্ম আর বাঁ-পায়ের হওয়ায় হয়ত আর্সেনালের সালিবাই হবেন দলের তৃতীয় সেন্টারব্যাক।

উইংব্যাক পজিশনে ভাল ফুটবলের জন্য যেখানে মাথা কুটে মরছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, সেখানে ফরাসি কোচের হাতে একাধিক অপশন। লুকাস হার্নান্দেজের মত ফুটবলারকে বসতে হতে পারে বেঞ্চে। কারণ লেফটউইংব্যাক পজিশনে থিও হার্নান্দেজের বদলে কাউকে চিন্তাও যেন করা যায় না। অন্যদিকে ডানপ্রান্তটা সামলাবেন গত বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে অবিশ্বাস্য এক গোল করা বেঞ্জামিন পাভার্ড।

তবে ফ্রান্সের মূল দুশ্চিন্তাটা তাঁদের মিডফিল্ড নিয়ে। ইনজুরি এবং ফর্মহীনতা মিলিয়ে সম্পূর্ণ আনকোরা এক মিডফিল্ড নিয়ে বিশ্বকাপে যেতে হচ্ছে তাঁদের। অরেলিয়ের শুয়ামেনি, এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা, ইউসৌফ ফোফানা, মাত্তেও গুয়েন্দৌজি, আন্দ্রিয়ান রাবিয়োটরাই থাকবেন মাঝ মাঠ সামলানোর দায়িত্বে। 

তবে মিডফিল্ড কিংবা ডিফেন্স যাই হোক, ফ্রান্সের আক্রমণভাগ এবারের বিশ্বকাপের সেরা তাতে বোধহয় কারও সন্দেহ নেই। আক্রমণভাগের একদম মাঝখানে খেলবেন আতোয়ানে গ্রিজম্যান। ক্লাব ফুটবলে ফর্মটা যাই হোক, জাতীয় দলের জার্সিতে গ্রিজম্যান বরাবরই দুর্দান্ত। গত বিশ্বকাপেও দলের আক্রমণভাগকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তাঁর সাথে দুই ফরোয়ার্ড হিসেবে থাকবেন বিশ্বের সেরা দুইজন – কিলিয়ান এমবাপ্পে এবং করিম বেনজামা।

গ্রিজম্যানের ভিশন, এমবাপ্পের গতি আর বেনজামার ফিনিশিং- এই ত্রয়ী মিলে বিশ্বের যেকোনো রক্ষণভাগকে ধসিয়ে দিতে পারেন। তাছাড়া তাঁদের বিকল্প হিসেবে যারা বেঞ্চে বসবেন তারাও রয়েছেন দুর্দান্ত ফর্মে। বিশেষ করে বার্সেলোনার উসমান দেম্বেলে এবং লাইপজিগের এনকুকু রয়েছেন নিজেদের ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে। সুতরাং ফ্রান্সের ম্যাচে একাধিক গোল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। 

তবে বিশ্বকাপের ঠিক আগমূহুর্তে ইনজুরির কারণে পল পগবা এবং এনগোলো কান্তের ছিটকে যাওয়াটা ভালই ভোগাবে ফ্রান্সকে। কামাভিঙ্গা কিংবা ফোফানা দারুণ প্রতিভাবান হলেও বড় ম্যাচ খেলার তেমন অভিজ্ঞতা নেই তাঁদের। ফলে বিশ্বকাপের বড় মঞ্চে চাপের মুখে নিজেদের কতটা মেলে ধরতে পারেন তাঁরা সেটা চিন্তার ভাঁজ ফেলবে কোচের কপালে। এছাড়া দলে রাইট উইংব্যাক বেঞ্জামিন পাভার্ডের কোনো বিকল্প খেলোয়াড় নেই। ফলে টুর্নামেন্টের মাঝপথে পাভার্ডের কোনো ইনজুরি কিংবা ফর্মহীনতা ঘটলে বিপদে পড়তে হবে দলকে।

বরাবরের মত ফ্রান্সের মূল ভরসা এমবাপ্পে। তাঁর গতি, ড্রিবলিং চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে প্রতিপক্ষের দলগুলোর জন্য। বিশেষ করে কাউন্টার অ্যাটাকে এমবাপ্পে অপ্রতিরোধ্য, তাঁকে সামলানোর মত গতিশীল উইংব্যাক বিশ্বে খুব বেশি নেই। তবে এবারের বিশ্বকাপে তাঁদের জন্য এক্স ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন রিয়াল মাদ্রিদের তরুণ মিডফিল্ডার অরেলিয়ের শুয়েমেনি।

মাত্র ২২ বছর বয়স হলেও ইতোমধ্যেই বিশ্ব ফুটবলের ভবিষ্যৎ তারকা খেতাব পেয়ে গিয়েছেন। পুরো মাঠজুড়ে দৌঁড়ে খেলতে জানেন। প্রতিপক্ষের আক্রমণ নস্যাৎ করার পাশাপাশি নিজের দলের খেলাও গড়ে দেন পেছন থেকে। তাছাড়া উইংব্যাক থিও হার্নান্দেজ আক্রমণে উঠে গেলে বাঁ-প্রান্তের ফাঁকা জায়গাটা পূরণ করতে হবে তাঁকেই। সবমিলিয়ে এবারের বিশ্বকাপে শুয়ামেনি হয়ে উঠতে পারেন ফ্রান্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলারে। 

গ্রুপ বি’তে ফ্রান্সের মুখোমুখি লড়বে ডেনমার্ক, তিউনিসিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া। তবে গ্রুপ চ্যাম্পিয়নের লড়াইটা মূলত হবে ফ্রান্স এবং ডেনমার্কের মধ্যে। গ্রুপপর্ব পেরোলেও ফ্রান্সের জন্য ফাইনালে ওঠার পথটা বেশ কঠিন। গ্রুপে দ্বিতীয় হলে সম্ভাবনা আছে পরের রাউন্ডেই আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হওয়ার। মেসিদের বাঁধা পেরোতে পারলে শেষ আটে অপেক্ষা করছে ইংল্যান্ড কিংবা নেদারল্যান্ডসের মত শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। সব মিলিয়ে শিরোপা ধরে রাখার মিশনে কঠিন এক পথই পাড়ি দিতে হবে ফ্রান্সকে। 

এবারের বিশ্বকাপ শেষেই কোচের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা ফ্রান্সের হয়ে অধিনায়ক এবং কোচ দুই ভূমিকাতেই বিশ্বকাপ জেতা দিদিয়ের দেশম। নিজের বিদায়ী বিশ্বকাপটা তিনি রাঙিয়ে যেতে চাইবেন আপন মহিমায়। শিষ্যরাও মুখিয়ে থাকবেন বিশ্বকাপ জিতেই কোচকে বিদায় জানাতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link