এমন কেন সত্যি হয় না, আহা!

সত্যিই সঠিক সময়ে ছাড়তে পারাটাও একটা বড়ো আর্ট, যেটার সময় জ্ঞানে গণ্ডগোল হলে বর্ণময় ক্যারিয়ার সত্ত্বেও হয়তো মানুষ সেভাবে মনে রাখবেন না। ভারতীয় ক্রিকেটে সুনীল গাভাস্কার আর সৌরভ গাঙ্গুলি যে সময়ে খেলা ছেড়েছেন, আজও লোকে বলে আর দু’বছর আরামসে খেলতে পারতেন। কিন্তু শচীন?

কি হতো যদি ওয়াঙখেড়েতে সেই মায়াবী দুই এপ্রিলের রাতে সতীর্থদের কাঁধে চড়ে ঘোষণা করতেন – আর নয়, আমার সারা জীবনের স্বপ্ন আজকে পূর্ণ হয়েছে। নাইবা খেলা হতো ২০০ টেস্ট, নাইবা হতো ১০০ সেঞ্চুরি; হাজার দুয়েক রান হয়তো টেস্ট আর ওয়ান ডে মিলে কমই হতো, কিন্তু আজও হয়তো লোকে বলতো, ছেড়েছিলো রাজার মতো, বিশ্বকাপ জিতে, বিশ্বকাপে দলের সর্বোচ্চ রান আর দুটো সেঞ্চুরি আর দু’টো ম্যাচ জেতানো হাফ সেঞ্চুরি করে, সেই ৩৮ বছর বয়সেও! ব্রাডম্যান তো ১০০ গড় রাখতে পারেন নি, তাতে কি তাঁর সম্মান একটুও কমেছে?

তাঁর বদলে কি শুনতে হলো, এবং হচ্ছে! আমার এক দক্ষিণ ভারতীয় কলিগ শচীনের ১০০ সেঞ্চুরির দিন বলেছিলেন, ‘আরো আগে বাংলাদেশের সাথে উনাকে একটা ম্যাচ খেলিয়ে দিলেই হতো, সেঞ্চুরিটা হয়ে যেত, আমাদেরও আর এই যন্ত্রনা সহ্য করতে হতোনা’ – সেদিন তাঁর সাথে অনেক তর্ক করলেও, আমরা যারা একসময় তাঁর ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ হয়েছি তাদের কি একটুও খারাপ লাগতো না শচীনকে এইভাবে স্ট্রাগল করতে দেখে?

এই প্রসঙ্গে একটা খুব সুন্দর আর্টিকেল পড়েছিলাম, সম্ভবত আনন্দবাজারে, শচীনের অবসরের কিছুদিন আগে বেরিয়েছিল, সেখান থেকে একটা প্যারাগ্রাফ তুলে দেবার লোভ সামলাতে পারছি না – ‘প্রায় যে কোনও জিনিয়াসেরই একটা সমস্যা থাকে। তারা জানে, কী দুর্লভ জিনিস হাতে পেয়েছে। তাই ক্ষমতার শেষ বিন্দু পর্যন্ত সে প্রতিভা নিংড়ে দিতে চায় তারা। তাই বার বার মাথা হেঁট হলেও পরের মৌসুমের জন্য র‌্যাকেটে শান দেয় রজার ফেদেরার। মুটিয়ে যাওয়ার পরেও ফুটবলে ফিরতে চায় মারাদোনা। কিন্তু অতি বড় জিনিয়াসেরও সেই নাছোড় লড়াইয়ে আমাদের রুচি নেই। আমরা মেসি-ম্যানিয়া বা রোনাল্ডো-হুজুগে আছি, কিন্তু তত দিনই, যতক্ষণ তারা ফর্মের মধ্যগগনে। আমাদের অনেক বেশি পছন্দ উড়নতুবড়ির মতো চ্যাম্পিয়ন। যারা জলদি জ্বলে, আবার জলদি খতমও। এক মুখ বেশি দিন দেখতে আমাদের ভাল্লাগে না।’

হয়তো কথাটা পুরোপুরি সত্যি না, কিন্তু কিছুটা হলেও তো সত্যি, ব্যর্থতা দেখতে আমাদের ভালো লাগেনা, আমরা চাই সাফল্য, সেটাও প্রতিপক্ষকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে। তাই শচীন কেন ভিভ হতে পারলেন না, সেটা নিয়ে আজও টেবিল গরম করেন সাধারণ ফ্যান থেকে ক্রিকেটার ও বিশেষজ্ঞেরা।

শচীন কেন ৬০, ৭০, ৮০ স্ট্রাইক রেট রেখে টেস্টে সেঞ্চুরি করলেন না, সেটা নিয়ে আপসোস করি আমরা। সেহওয়াগ অনেক কম ধারাবাহিক হয়েও যথার্থভাবেই আমাদের মনের মনিকোঠায় সম্মান পান এক চ্যাম্পিয়নের। অথচ কালিস বা দ্রাবিড় থেকে যান টেকনিকের পরাকাষ্ঠা, ডিফেন্স এর দুর্গ হয়ে, তাঁদের কেউ লারা বা ভিভের সাথে একাসনে বসায়না।

ইশ, সচিনও যদি বিশ্বকাপ জিতে উঠে ছাড়তেন!

পরিশিষ্ট হিসেবে শচীনের কিছু সেঞ্চুরি, টেস্ট ম্যাচে যেগুলো তিনি ৬০ এর উপরে স্ট্রাইক রেট রেখে করেছেন, তাঁর একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা দিয়ে যাই।

  • অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১৯৯৮ সালের বেঙ্গালুরু টেস্টে সচিন ২৯ টি বাউন্ডারি ও ৩ টি ওভারবউন্ডারি সহযোগে ১৭৭ রান করেন ২০৭ বলে, স্ট্রাইক রেট ৮৫.৫।
  • ২০০১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ব্লুমফন্টেনে প্রথম টেস্টে ৬৮/৪ অবস্থা থেকে খেলেন ১৮৪ বলে ১৫৫ রানের এক অসাধারণ ইনিংস, বিপক্ষে ছিলেন পোলক, হেয়ওয়ার্ড, এনটিনি, ক্লুজনার, কালিস ও বয়ে। স্ট্রাইক রেট ৮৪ এর উপরে। পিচ ছিল প্রায় সবুজ ও সিমিং। এই ইনিংসটি আমি গোটাটা লাইভ দেখেছি, জানিনা কেন এই ইনিংসটি এতো কম আলোচিত। আপার কাট শট টা সেদিনই প্রথম দেখি। ২৩ টি বাউন্ডারি ও ১ টি ছয়ের অধিকাংশ বাউন্ডারি দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের বাউন্সারের জবাবে থার্ডম্যান দিয়েই হয়।
  • ২০০২ সালে নটিংহ্যাম এ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একটি ১১৩ বলে ৯২ আছে। কারোর মনে নেই যদিও।
  • চেন্নাইতে ওয়ার্নকে ধ্বংস করে ১৫৫ নট আউট, ওই ৯৮ সিরিজেই; স্ট্রাইক রেট ছিল ৮১ এর উপরে।
  • ওই বছরেই (৯৮) ওয়েলিংটনে নিউজিল্যান্ডের সাথে ১১৩ করেন দ্বিতীয় ইনিংসে, ১৫১ বলে, ৭৪ স্ট্রাইক রেট রেখে। ইন্ডিয়া ম্যাচ হারে; কেউ মনে রাখেনি।
  • ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কুখ্যাত সিরিজে এডিলেডে ১৫৩, স্ট্রাইক রেট ছিল ৭৪ এর বেশি।
  • ৯২ সালের পার্থে ১১৪; মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন; স্ট্রাইক রেট ৭০ এর বেশি ছিল।
  • ৯২ সালেই সিডনিতে ১৪৮*, প্রায় ৭০ স্ট্রাইক রেটে।
  • ৯৬ সালে কেপটাউনের ১৬৯, আজহারের সাথে সেই অমর পার্টনারশিপ, স্ট্রাইক রেট ৬৬ মতো।
  • ৯৩ সালে কলম্বোতে ৬৪ স্ট্রাইক রেটে ১০৪*।
  • ২০০৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে হ্যামিল্টনে ১৬০ এবং ২০০৮ সালে সিডনিতে ১৫৪* দুটোই ৬২-৬৩ স্ট্রাইক রেটে করা।

দেখা যাচ্ছে ২০০০ সালের পরে শচীন সেভাবে ভালো বোলিং এর বিরুদ্ধে উঁচু স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেন নি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কয়েকটি সেঞ্চুরি এই তালিকায় রাখলাম না। এর একটা প্রধান কারণ হতে পারে ওপেনার সেহওয়াগ এর উপস্থিতি, যিনি টিকে গেলে রান রেট বেশ বাড়িয়ে দিয়ে চলে যেতেন; এ ছাড়াও মিডল অর্ডার এ দ্রাবিড়, লক্ষ্মণ, গাঙ্গুলির উপস্থিতি তাঁকে টেস্টে প্রধান রোল থেকে সাইড রোলে ঠেলে দিয়েছিলো।

কিন্তু দর্শক হিসেবে আমরা কিন্তু ২০০০ সালের আগের শচীনকেই দেখতে চাইতাম; ওয়ান ডে তে তিনি ঝলক দেখালেও, টেস্টে অনেকটাই রক্ষণাত্মক হয়ে গেছিলেন। ২০০৮ সালের পরের দুই একটি ইনিংস বাদে সেভাবে পুরোনো শচীনকে আর টেস্টে পাওয়া যায়নি বর্তমান শতাব্দীতে। তবে ২০০৮ এর অস্ট্রেলিয়া সিরিজে ব্রেট লির সাথে তাঁর দ্বৈরথ সত্যি ই উপভোগ্য ছিল। ব্রেট লি সব কিছু দিয়ে চেষ্টা করেও শচীনকে কাবু করতে পারেন নি, ইনিংস শেষে শচীনের মাথায় হাত বুলিয়ে হ্যান্ডশেক করার দৃশ্য আমার চিরকাল মনে থাকবে।

তবুও, শচীন যদি আর কয়েক হাজার রান কম করতেন, কিন্তু সেই ৯৮ এর শচীনকে ধরে রেখে দিতেন ২০১০ অবধি, তাহলে?

রোজ কত কী ঘটে যাহা-তাহা —

এমন কেন সত্যি হয় না, আহা।

ঠিক যেন এক গল্প হত তবে,

শুনত যারা অবাক হত সবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link