আমরা বাঙালিরা বঞ্চনার ইতিহাস পড়তে বেশ ভালবাসি। কিন্তু যে ভদ্রলোকের কথা বলতে যাচ্ছি, তাঁর বেলায় গল্পটা তাঁর কপাল কত চওড়ায় এসে দাঁড়িয়ে যায়। বিশ্বকাপে একটাও ম্যাচ না খেলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মেডেল তিনি ছাড়া পেয়েছেন একমাত্র নাথান হরিজ। কিন্তু হরিজ তো মূল দলে ছিলেন না। শেন ওয়ার্ন ডোপ পরীক্ষায় বাদ পড়ার পর ২০০৩ বিশ্বকাপের দলে সুযোগ পান হরিজ। কিন্তু সুনীল ভালসন?
এমনিতে ভালসনের গল্প সকলেরই জানা। বিশ্বকাপের দল নির্বাচনের সময় তিনি ডারহামের ওয়েস্ট কোস্ট লিগে খেলছিলেন। দিল্লীর সতীর্থ কীর্তি আজাদ ফোন করে জানান যে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ১৪ জনের দলে কীর্তির সঙ্গে তিনিও স্থান পেয়েছেন। অবশ্য ভারতকে কেউ খুব একটা সিরিয়াসলি নেয়নি। ভারতেই নেয়নি তো অন্যত্র!
জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক ডানকান ফ্লেচার পর্যন্ত বলে দেন যে গ্রুপ লিগে যে সব দল পড়েছে, তাদের মধ্যে ভারতকে হারানোই সবথেকে সহজ। তা টানব্রিজ ওয়েলসে বাস্তব করেই ফেলেছিলেন তাঁরা প্রায়। কিন্তু ১৭/৫ থেকে মাঝের অবলিকটি উড়িয়ে দিয়ে কপিলদেব রামলাল নিখাঞ্জ দিনের বেলায় তারাবাজি নিয়ে আসেন। ভারত আর জিম্বাবুয়ে, শ্রীলঙ্কা ছাড়া বোধহয় সবথেকে দুর্বল দুই দল, তাদের ক্রিকেট যদি ইংলিশ চ্যানেলেও খেলা হত তাতেই বা কী হত। বিবিসিও ধর্মঘট পেরিয়ে এই খেলা সম্প্রচার করার গরজ দেখায়নি।
কিন্তু বীজটা বোধহয় অন্যত্র বোনা হয়েছিল, এ কথাও জানে সবাই। গুয়ানার অ্যালবিয়নে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারায় ভারত। গাভাস্কারের ৯০ আর কপিল দেবের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে। তখন থেকেই মনে হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ অপরাজেয় নয়। তারপর তো ওভালে যশপাল শর্মার ৮৯ আর বিনি ও শাস্ত্রীর বোলিং-এ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই আবার হারিয়ে সারা ফেলে দিয়েছিল ভারত।
তবে এসব নয়। সুনীল ভালসনকে কেন নেওয়া হয়েছিল দলে? সুনীল ১৯৮১-৮২তে অভিষেক করেন রঞ্জিতে তামিল নাড়ুর হয়ে। জন্ম অথচ সেকেন্দ্রাবাদে। যাই হোক,পরেরবারই তিনি দিল্লিতে চলে আসেন। দিল্লিই তাঁর আসল পৈত্রিক জায়গা। বাবার বদলির চাকরীর জন্য এদিক ওদিক করে বেড়াতে হত। দিল্লিতে এসেই মাত্র ৫টি রঞ্জি ম্যাচে ২৫টি উইকেট পান। বাঁ-হাতি বোলার ভালসনের এক্সপ্রেস গতিবেগ না থাকলেও স্যুইং-এর ওপর মোটামুটি দখল ছিল। আর সেই কারণেই ১৯৮৩র বিশ্বকাপে সুযোগ ঘটে। অর্থাৎ এটা অন্ততঃ বোঝা গেল যে কোটার খেলোয়াড় হিসাবে খেলেননি তিনি।
সুযোগ যে আসেনি তা নয়, বিশ্বকাপের আগের ওয়ার্ম আপ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের দুই ওপেনার ব্রুস এডগার এবং জন রাইটকে আউটও করেন। কিন্তু রজার বিনি দুর্দান্ত ফর্মে আর মদনলালের ব্যাটের হাতটা মন্দ না। সঙ্গে বলবিন্দর সিং সাঁধুর স্যুইং আর কপিল মহিন্দারের অলরাউণ্ড খেলা। জায়গা কোথায়? ষষ্ঠ বোলারের জায়গাটা কীর্তি আজাদের অফস্পিন আর রবি শাস্ত্রীর বাঁ-হাতি স্পিনে নিয়ে ফেলেছে।
সুযোগ যে একেবারেই আসছিল না তা নয়, গ্রুপলিগের দ্বিতীয় লেগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলার আগে রজার বিনির চোট ছিল। কপিল বলে রেখেছিলেন সুনীলকে, রজার না খেলতে পারেন, সুনীল যেন তৈরি থাকেন। কিন্তু ম্যাচের দিন রজার বিনিকে দৌড়তে দেখেই ভবিতব্য বুঝে যান সুনীল ভালসন। আসলে তখন ফিটনেস টেস্ট বলতে শুধুমাত্র দৌড় আর স্ট্রেচিং করেই দেখে নেওয়া হত। আজকের মত ইয়োইয়ো টেস্ট বা স্পেশালাইজড পরীক্ষা ছিল না।
তবু লর্ডসের ব্যালকনিতে বিশ্বকাপের সোনার মেডেল জয়ের কপাল তো সবার থাকে না। সুনীল ভালসনের ছিল। কিন্তু এরপরেই সমস্যাটা তৈরি হল। যে লোকটিকে বিশ্বকাপে নিয়ে যাওয়া হল তাকে সুযোগ তো দেওয়াই যেত তাই না? কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভারত সফরে খোঁচা খাওয়া বাঘের দুই ওপেনার গ্রিনীজ এবং হেনসের হাতে শুরুতেই উত্তরাঞ্চলের হয়ে হেনস্থা হওয়ায় আর সুযোগ নেওয়া যায়নি। তদ্দিনে চেতন শর্মাও চলে এসেছেন।
হরিয়ানা থেকে ডিপি আজাদের ছাত্র, কপিলদেবের আপাত উত্তরসূরি। পশ্চিমাঞ্চল থেকে কাউকে সুযোগ দেবার ছিল অতএব মুম্বইয়ের রাজু কুলকার্নি। যদিও ভালসনের সেবারেও ৮ ম্যাচে ২৭ উইকেট রঞ্জিতে। দলীপে অবশ্য সুযোগই পাননি। কপিল, বলবিন্দর সাঁধু, চেতন আর মহিন্দার।
তারপরের বছর আবার মনোজ প্রভাকরের প্রবেশ। ভালসনের উইকেট সংখ্যা কমছে। মনোজের ব্যাটের হাত ভাল। এইভাবে এদিক ওদিক সেদিক করে আর সুযোগ হয়নি ভালসনের। ১৯৮৭র বিশ্বকাপে টিমে কপিলের সঙ্গে মনোজ, চেতন আর রজার বিনি। জায়গা কোথায়? অথচ সেবার রেলওয়েজকে রঞ্জি ফাইনালে তুলেছেন ভালসন।
সে’সব থাক। বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ভারত, পরের বারের ফেভারিট হয়েও সেমি ফাইনালে হেরে যাওয়া ভারত। মাঝে ১৯৮৫তে বিশ্বের সেরা দল ভারত। এর মাঝেই কোথাও যেন হারিয়ে গেলেন ভালসন। আসলে পাশের দেশ পাকিস্তানের মতো বাঁ-হাতি পেসারদের স্বর্গরাজ্য নয় ভারত। এত বছরে দেখতে গেলে একটা কার্সন ঘাউড়ি, তারপর একটা রশিদ প্যাটেল হয়ে মাঝে আশিস নেহরা, জাহির খান আর ইরফান পাঠান । জয়দেব উনাদকাট, বারিন্দর স্রণরা আসেন আবার টিকতে পারেন না। কেন? এর উত্তর থাকে না।
যেমন উত্তর থাকে না, সুনীল ভালসন মোটামুটি ভালই পারফর্ম করার পরেও একটাও ম্যাচ কেন ভারতের হয়ে খেলতে পারলেন না। অবশ্য সুনীল ভালসন এসব প্রশ্ন ছেড়ে এসেছেন কবে। পড়াশুনোটা ভালোভাবে মন দিয়ে করেছিলেন, মাঝে রেলের চাকুরীও। বর্তমানে তো উনি জিএমআর-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট। আইপিএলএ দিল্লির টিমের ম্যানেজার। জিজ্ঞাসা করলে বলবেন, ‘অতীত নিয়ে ঘাঁটি না!’ আজও ডাক পড়ে। ৩৭ বছর পরে ঐ স্মরণীয় ২৫ জুনকে উদযাপন করতে কপিল গাভাস্কার রবি মদন শ্রীকান্তের সঙ্গে তাঁরও ডাক পড়ে।
কুণ্ঠায় জড়সড় হয়ে থাকতে দেখা যায় না তাঁকে। জিজ্ঞাসা করলে বলবেন, ‘দুটো সুনীল সেবার বিশ্বকাপ জিতেছিল। এভাবেই মনে থাকে’। মেডেলটা একান্ত ওর, ভারতের হয়ে চুটিয়ে খেলা আজহার, কুম্বলে, সৌরভ, রাহুলের যেটা নেই। আসলে এক জীবনে সবার সবকিছু হয় না তো। সুনীল ভালসন বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য হয়েই থেকে গেলেন। ভারতের হয়ে খেলা হল না আর।
এ এক অন্য সুনীলের কথা। কোটার খেলোয়াড় বলে যাঁকে আমরা উড়িয়ে দিই, কিন্তু ভুলে যাই ক্রিকেটটা মাঠেই খেলেছেন সুনীল ভালসন। নিজের যোগ্যতাতেই সুযোগ ঘটেছিল। পুরোটা না পেলেই বা কী আসে যায়। জীবন তো চলতেই থাকে। অন্য খাতে, অন্য হিসাবের খাতায়।