সুইস ট্র্যাজেডির বীর সেনানী

ম্যাচটি হয়ে থাকবে দুই দলের গোলরক্ষকের। যেখানে দর্শকেরা গোলের অপেক্ষায় মুখিয়ে থাকেন সেখানে গতকাল রোমাঞ্চ অনুভব করেছেন দুই গোলরক্ষককের দারুণ সব সেভ দেখে। দুই গোলরক্ষক উনাই সিমন এবং ইয়ান সমার দুজনেই যেন পণ করে মাঠে নেমেছিলেন একে অন্যকে ছাপিয়ে যাবার।

সেখানে শেষ হাসিটা সিমনের, সুইসদের তিন পেনাল্টি মিসে শেষ চারে উঠলো স্পেন। নির্ধারিত সময়ের খেলা ১-১ সমতায় শেষ হবার পর টাইব্রেকারে ৩-১ গোলে জিতে ২০১২ ইউরোর পর আবারো সেমিফাইনালের টিকিট পেল লা রোজারা। আর সুইস ট্র্যাজেডির নায়ক হয়েই থাকলেন সমার, যাওয়া হল না ইউরোর সেমিফাইনালে।

সুইজারল্যান্ড শেষবার কোনো বড় টুর্নামেন্টের নকআউট পর্বে ম্যাচ জিতেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও আগে। এমনকি সর্বশেষ ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে সেই ১৯৫৪ সালে। অন্যদিকে একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা দল স্পেন। টানা ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো জেতা একমাত্র দল স্পেন।

কিন্তু, সেই সোনালি প্রজন্ম বিদায় নেবার পর সাফল্যে ছেদ পড়ে স্প্যানিশ রাজত্বে। ২০১৪ এবং ২০১৮ বিশ্বকাপের পাশাপাশি ২০১৬ ইউরোতে বাদ পড়ে গ্রুপপর্ব থেকেই। অবশেষে নয় বছরের সাফল্যখরা কাটিয়ে ইউরোর সেমিতে উঠলো। ২০১০ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই স্পেনকে হারিয়েছিল সুইসরা। সেই চমকের পুনরাবৃত্তি হলো না এবার, জমাজমাট এক লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি ঘটলো স্পেনের জয়ের মাধ্যমে।

আগের ম্যাচে দারুণ এক কামব্যাক ঘটিয়ে ম্যাচ জিতেছিল সুইজারল্যান্ড। কিন্তু এ ম্যাচে খেলা শুরুর আগেই কিছুটা ব্যাকফুটে সুইসরা। কার্ডজনিত নিষেধাজ্ঞার কারণে বেঞ্চে তাদের নিয়মিত অধিনায়ক গ্রানিট জাকা। মিডফিল্ডের পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকে জাকার হাতেই, তার অনুপস্থিতিতে দলে আসা জাকারিয়ার গোলেই ম্যাচে পিছিয়ে পড়ে সুইজারল্যান্ড। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে অসাধারণ এক গোলে দলকে সমতা ফেরান জের্দান শাকিরি। কিন্তু রেফারির মাথায় কি ভূত চাপলো, বিতর্কিত এক সিদ্ধান্তে সরাসরি লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন ফ্রয়লারকে।

এরপরের পুরো গল্পটাই ইয়ান সমারের। আগের ম্যাচেই এমবাপ্পের পেনাল্টি ঠেকিয়ে দলকে এনে দিয়েছেন ঐতিহাসিক এক জয়। এবারের ইউরোর আগে খুব বেশি মানুষ তাকে চিনতেন না, অথচ জার্মান ক্লাব মুনশেনগ্লাডবাখের নিয়মিত সেনানী সমার।

কখনো ডানে কিংবা বামে ঝাঁপিয়ে, কখনো দারুণ সব ব্লক করে ১০ জনকে সুইসদের টিকিয়ে রাখলেন খেলায়। পুরো ম্যাচে সেভ করেছেন ১০টি! তা সত্ত্বেও পেনাল্টিতে সতীর্থদের ব্যর্থতা এবং উনাই সিমনের অনবদ্য গোলকিপিংয়ের কাছে হার মানতে হলো তাকে।

ফুটবলে গোলরক্ষকের কাজটাই বোধহয় সবচেয়ে কঠিন। স্ট্রাইকাররা ম্যাচে অনেকগুলো সুযোগ পেয়ে কেবল একটা কাজে লাগাতে পারলেই হয়ে যান নায়ক। তাদের মিসের কথা স্মরণে থাকে না কারোরই। কিন্তু গোলরক্ষকেরা দারুণ সব সেভ করলেও খুব বেশি প্রশংসা পান না অথচ একটা ভুল করে ফেললেই সমালোচনার শূলে বিদ্ধ হতে হয়। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ বোধহয় উনাই সিমন।

অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের এই স্প্যানিশ গোলরক্ষক তিন-চারদিনের মাঝেই দেখে ফেলেছেন মুদ্রার দুই পিঠই। আগের ম্যাচেই ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ভুল করে গোল হজম করে শিকার হয়েছিলেন হাস্যরসের। সমর্থকরা দাবি জানাচ্ছিলেন ডেভিড ডে গিয়াকে বেঞ্চে রেখে তাকে কেনো খেলানো হচ্ছে। কিন্তু স্প্যানিশ কোচ লুইস এনরিকে ভরসা রেখেছিলেন তার শিষ্যের উপর, কি দারুণভাবেই না আস্থার প্রতিদান দিলেন সিমন। টাইব্রেকারে সুইসদের তিনটি শট ঠেকিয়ে দিয়ে বনে গেলেন জাতীয় বীর।

সেমিফাইনালে স্প্যানিশদের প্রতিপক্ষ ইতালি। ২০১২ ইউরোর ফাইনালে ইতালিকে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত করে সোনালি প্রজন্মের ইতি টেনেছিল দেল বস্কের স্পেন। এবার সেই ইতালিকেই হারিয়ে নতুন প্রজন্মের উত্থানের জানান দিতে পারে কিনা এনরিকের স্পেন সেটার জন্য কেবলই সময়ের অপেক্ষা।

একটা পরিসংখ্যান এখানে না দিলেই নয়। চলতি ইউরোতে ২১ টা সেভ করেছেন সমার। এর মধ্যে এক স্পেনের বিপক্ষেই ১০টা। তবুও, তিনি পরাজিতের দলে। নাহ, সব সময় ফলাফলটা মানা যায় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link