গ্যালারিতে নয়, বুকে থাকবেন

১০ জুন; ২০০৬।

হামবুর্গ স্টেডিয়ামে মুখোমুখি আর্জেন্টিনা ও আইভরি কোস্ট।

আর্জেন্টিনা দল তখনও তারকাখচিত। কে নেই সেই দলে। হুয়ান পাবলো সোরিন, গ্যাব্রিয়েল হেইঞ্জ, হুয়ান রোমান রিকুয়েলমে, হ্যাভিয়ের স্যাভিওলা, হার্নান ক্রেসপো; এক ঝাঁক তারকা। এবং একজন পিচ্চি লিওনেল মেসি। আইভরি কোস্ট দলেও আছেন দিদিয়ের দ্রগবা, ইয়াইয়া তোরের মত খেলোয়াড়। গ্যালারি ভর্তি দর্শক প্রাণভরে দেখে নিতে চাইছেন দুনিয়া কাঁপানো সব তারকাকে।

এর মধ্যেই ছন্দটা বদলে গেল।

মাঠের জায়ান্ট স্ক্রিনে ভেসে উঠলো তাঁর ছবি। লেখা উঠলো-লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন, প্লিজ ওয়েলকাম ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা।

ব্যাস, মুহুর্তে বদলে গেলো গ্যালারির চিত্র। যেন পলকের জন্য তুচ্ছ হয়ে গেলেন মেসি, রিকেলমে, দ্রগবারা। সেই মুহুর্তে হামবুর্গে যেন ম্যারাডোনা ছাড়া আর কেউ নেই। পুরো গ্যালারি দুই পায়ে উঠে দাড়িয়ে করতালি দিতে শুরু করলো। এবং একটাই শব্দ ছড়িয়ে পড়লো-দিয়েগো, দিয়েগো।

হ্যাঁ, এটাই গত কয়েক দশক ধরে আর্জেন্টিনার আর্ন্তজাতিক টুর্নামেন্টের নিয়মিত চিত্র ছিল।

যতদিন খেলোয়াড় ছিলেন, কী কী জাদু দেখিয়েছেন, তা সকলের মুখস্ত হয়ে গেছে। যতদিন নিজে জার্সিটা পরেছেন, ততদিন ওই বাম পায়ে মুগ্ধ করে রেখেছেন বিশ্বকে। বুঝিয়েছেন, তিনি আর আর্জেন্টিনা সমার্থক। খেলা ছাড়ার পরও এই ধারণাটা বদলাতে হয়নি।

আর্জেন্টিনার সমার্থক মানুষটি হয়ে উঠেছেন এক নম্বর সমর্থক। দুনিয়ার যে প্রান্তে আর্জেন্টিনা বড় কোনো টুর্নামেন্ট খেলেছে, গ্যালারি মাতিয়ে রেখেছেন ম্যারাডোনা। একেবারে নিষ্পাপ শিশুর মত করে মেসিদের জন্য গলা পাঠিয়েছেন, বিচিত্র সব কাণ্ড কারখানা করেছেন এবং দলের একটা জয়ের জন্য কান্নাকাটি পর্যন্ত করেছেন।

এই চিত্রটা আজ বদলে যাবে। ১৯৯৮ সালের পর প্রথমবারের মত আর্জেন্টিনা আর্ন্তজাতিক টুর্নামেন্ট খেলতে নামবে ম্যারাডোনাকে ছাড়াই। আজ একটা মানুষের বিহনে শূন্য হয়ে রইবে মেসিদের গ্যালারি।

১৯৭৭ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তো নিজেই খেলেছেন মাঠে। তখন তো ম্যারাডোনাকে ছাড়া আর্জেন্টিনা কল্পনা করা যেত না। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ চলা অবস্থাতেই মাদক কেলেঙ্কারিতে শেষ হয়ে গেল ক্যারিয়ার। আর এরপরই হয়ে উঠলেন এক নম্বর সমর্থক।

১৯৯৮ বিশ্বকাপে অবশ্য গ্যালারিতে থাকতে পারেননি। বিশ্বকাপের কিছুদিন আগে আর্জেন্টিনায় একদল সাংবাদিকের সাথে গোলমাল করেছিলেন। সে জন্য স্থগিত কারাদণ্ডও পেয়েছিলেন। এসব নিয়ে খুব হতাশ ছিলেন। ফলে ফ্রান্সে দলের খেলা দেখতে যেতে পারেননি।

পরের বছরই প্যারাগুয়েতে ছিল কোপা আমেরিকা। শরীরে একটা আকাশী-সাদা পতাকা জড়িয়ে গ্যালারিতে হাজির হয়ে গেলেন। সেটা ছিল নতুন একটা যুগের শুরু। এরপর প্রতিটা টুর্নামেন্টে হাজির ছিলেন।

শরীর খারাপ হয়েছে, অপারেশন করাতে হয়েছে, নানা রকম ঝামেলায় পড়েছেন, প্রায় দেউলিয়া হতে বসেছেন; কিন্তু আর্জেন্টিনার খেলা মিস করেননি ম্যারাডোনা। আয়োজকদের জন্যও ছিলেন এক দারুন আকর্ষণ। তিনি মাঠে থাকা মানেই টিআরপি বেড়ে যাওয়া। ফলে আয়োজকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্মান দেখিয়ে তাকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করতেন।

ম্যারাডোনার বায়নারও শেষ ছিল না। অমুক জায়গায় বসতে দিতে হবে, সাথে এদের ঢুকতে দিতে হবে। জার্মানিতেই এরকম গানম্যানদের ঢুকতে না দেওয়ায় একটা ম্যাচ থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। কখনও কখনও এর মধ্যে ধারাভাষ্যও দিয়েছেন।

আবার এর মধ্যে ২০১০ সালটা ব্যাতিক্রম ছিল। সেবার আর গ্যালারিতে নয়; ছিলেন ডাগ আউটে। কোচ হিসেবে এসেছিলেন সেই বিশ্বকাপে। দারুণ সৌন্দর্য দেখিয়েছিলেন। আবার টেকনিক্যালি যে শিশুসুলভ ছিলেন, তার প্রমাণ রেখে জার্মানির বিপক্ষে বিধ্বস্ত হয়েছিলেন।

২০১৮ বিশ্বকাপেও ছিলেন; এই ক’টা দিন আগের কথা। সেবার গ্যালারিতে বসে বিচিত্র সব অঙ্গভঙ্গি করে নজর কেড়েছিলেন। কিছু আপত্তিকর ভঙ্গিও করেছিলেন। আবার আর্জেন্টিনা গোল করলে চোখ উল্টে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গি করেছিলেন। ম্যারাডোনা গ্যালারিতে মানেই নিত্য নতুন কিছু।

সেই আমোদ আর নেই। ম্যারাডোনা শারীরিক ভাবে আর থাকেন না মেসিদের পাশে। থাকা সম্ভব নয়। তিনি এখন জীবন নদীর ওপারে। গত কোপা আমেরিকায় ছিলেন না। নেই এবারের বিশ্বকাপে।

কে বললো? কে বললো কথাটা?

আজ মেসিরা যখন খেলতে নামবেন, জার্সিটা একটু খেয়াল করবেন। ওখানে একটা মানুষের ছবি থাকবে। বুকের ওপরই থাকবেন ম্যারাডোনা।

গত কয়েকটা বিশ্বকাপ, কোপার আগে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা বলেন, তাঁর মেসির জন্য খেলবেন। মেসি নিজে কোপার আগে বলেছেন, তিনি ম্যারাডোনার জন্য খেলতে চান।

কোপার ট্রফিটা ম্যারাডোনাকে দিতে পেরেছিলেন মেসি। ম্যারাডোনা টের পেয়েছিলেন? এবারও মেসি আপনাকে একটা কিছু উপহার দিতে চান। আর সেটা হল বিশ্বকাপ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link