এক নি:সঙ্গ শেরপা

২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের কাছে সেই অবিচারে শিকার হওয়ায় পুরো বাংলাদেশ তখন ক্ষুব্ধ, হতাশ, বিস্মিত।

কেউ গালি দিচ্ছেন, কেউ অভিশাপ দিচ্ছেন, কেউ যুদ্ধ ঘোষনা করছেন। আমরা তখন ভুলে গিয়েছিলাম যে, আমাদের চেয়ে বেশী হতাশ, ক্ষুব্ধ হয়েছে মাঠে আমাদের হয়ে ওই অবিচারের মধ্যেও লড়ে আসা ছেলেগুলো। এই সময়ে যে ছেলেগুলোর পাশে দাড়ানো খুব জরুরী; খনিকের জন্য সবাই ভুলে গিয়েছিলাম।

একজন ভোলেননি।

আতাহার আলী খান। ফেসবুকে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘ফলাফল যাই হোক, তোমরা বিজয়ী। আমি লাল গোলাপ নিয়ে বিমানবন্দরে হাজির হবো।’

তারপর অনেক সন্ধ্যা কেটে গেছে। আতাহারের এই কথা ভুলে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ দলের বিমান যখন রানওয়ে স্পর্শ করলো, তখনও মনে ছিলো না আতাহারের এই প্রতিশ্রুতির কথা। ইনফ্যাক্ট আতাহারকে খেয়ালও করিনি সেদিন বিমানবন্দরেন।

মাশরাফিরা আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলেন। চারিদিকে ফ্লাশ লাইট ঝলসাচ্ছে, ক্যামেরাম্যান-সাংবাদিকদের হুড়োহুড়ি, কর্মকর্তাদের চিৎকার, নিরাপত্তাকর্মীদের ছোটাছুটি; সব এক লহমার জন্য থেমে গেলো একটা চিৎকারে, ‘ম্যাশ! ম্যাশ, আই অ্যাম হেয়ার। কংগ্রাচুলেশনস!’

আতাহার আলী খান!

চিরকালের আতাহার আলী খান। ড্যাশিং, স্মার্ট, প্রায় ইংরেজী ভাষী, দীর্ঘদেহী, গৌরবর্ণ এবং হাতে একটা ছোট্ট লাল গোলাপ; আতাহার আলী খান।

তিনি কথা রেখেছেন। আতাহার আলী খান। তিনি যা বলেন, সেটা করার জন্য জীবন দিতে পারেন। আমাদের একজন আতাহার আলী খান। আমার সেই নব্বইয়ের প্রেম আতাহার আলী খান।

আমি ঢাকার ছেলে নই।

ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেটের ব্যাটসম্যান আতাহারের প্রেমে পড়ার কোনো সুযোগ আমার ছিলো না; যে আতাহারের গল্প করে শুভ্রদা (উৎপল শুভ্র) প্রায়ই বলতেন, ‘আতাহার টেস্টপূর্ব যুগের সবচেয়ে স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান। অনেক শট হাতে থাকার পরও সে কেনো যেনো দুটো শটের ওপরই ভরসা করতো।’

সেই সাথে ছিলো আতাহার আলীর ডিবলিডবলি বোলিং। আমি অবশ্য প্রেমে পড়লাম ওই ব্যাটিং দেখে।

নব্বইয়ের এশিয়া কাপ সম্ভবত। শ্রীলঙ্কার বেশ বড় একটা টার্গেট চেজ করতে নেমেছিলো। বাংলাদেশ যথারীতি শুরুতেই পট পট কয়েকটা উইকেট হারিয়ে ফেললো।

চেয়ারম্যান বাড়িতে বসে টিভিতে খেলা দেখছিলাম। আমার এটা মনে আছে যে, খুব লম্বা একটা মানুষ, ভেরি আনলাইক বাংলাদেশি, ব্যাট করতে নামলো। একটা পা সামনে নিয়ে কেমন যেন একটা শট করেছিলো; চার হয়েছিলো; এখন জানি, ওটা সম্ভবত কাভার ড্রাইভ ছিলো।

সেটা ছিলো আমার প্রথম কাভার ড্রাইভ প্রেম এবং পরে বুঝেছি আতাহার প্রেম।

৭৮ রানে (রানটা তখনকার স্মৃতিতে ছিলো না) অপরাজিত থাকা আতাহারকে শ্রীলঙ্কানরা পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে; এটা সম্ভবত ক্রিকেট বিষয়ক আমার আদিমতম স্মৃতি।

এরপর ১৯৯৭ এশিয়া কাপে আরেকটা ইনিংস। এটার একেবারে খুটিনাটি মনে আছে। বাংলাদেশ আতাহারের হাত ধরে প্রথম সেঞ্চুরি পেতে যাচ্ছে; আমরা থর থর করে কাঁপছি। কী স্টাইলিশ ব্যাটিং। সেঞ্চুরি হবেই। হলো না। বাংলাদেশী এক থার্ড আম্পায়ার বেনিফিট অব ডাউট দিলেন বোলারকে; স্ট্যাম্পিং হয়ে ৮২ রানে ফিরেছিলেন আতাহার। আমি সেই আম্পায়ারকে অনেকবার পরে সামনাসামনি দেখেছি এবং ঘৃণা প্রকাশ করেছি মনে মনে।

আতাহার বিষয়ক ভালোবাসা এবং ঘৃণা সবটাই মনে মনে থেকে গেলো।

এই যে আতাহার ভাইয়ের লম্বা লম্বা ইন্টারভিউ নেই, ছোট ছোট আড্ডা দেই, একটা-দুটো টক শোতে দেখা হয়; কখনো এই ভালোবাসাটার কথা বলা হয়নি তাকে।

আমার মনে হয়, সেটা আতাহারের জন্য নতুন কিছু হতো না।

আতাহার যত বড় ক্রিকেটার, সে তুলনায় তার আর্ন্তজাতিক পারফরম্যান্স মোটেও কোনো কথা বলতে পারে না। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৮; ১০ বছরের ক্যারিয়ারের মাত্র ১৯টি ওয়ানডে খেলতে পেরেছেন। তখন বাংলাদেশ ম্যাচ খেলারেই সুযোগ পেতো না তেমন। তারপরও এই ১৯টা ওয়ানডের মধ্যে ৩টি ফিফটি আছে; দু বার সত্তর পার করেছেন। গড় ছিলো ২৯.৫৫; আজকের অনেকের তুলনায়ও তো খারাপ না। কিন্তু আতাহার কেনো যেনো ওই প্রজেন্মের জনপ্রিয় ক্রিকেটার হতে পারেননি।

ঢাকায় অবশ্য বেশ জনপ্রিয় ছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটের কারণে। এখানে কেবল ব্যাটসম্যান নয়, দারুন কার্যকর অলরাউন্ডার ছিলেন।

তাদের প্রজন্মের অনেক ক্রিকেটারই আতাহারের চেয়ে বড় তারকা হয়েছেন। কিন্তু আজকের প্রজন্মের দর্শকদের কাছে আতাহার এখনও জীবন্ত এক নায়ক। সেটা ওই সময়ের খেলার জন্য যতো না; তার চেয়ে অনেক বেশী তার যোদ্ধা ইমেজের জন্য। খেলা ছাড়ার পর চোস্ত ইংরেজী ও দারুন ও বিশ্লেষনী ক্ষমতার সুবাদে ধারাভাষ্যকার হয়ে গেছেন।

আর ধারাভাষ্যকার হিসেবেই এক নিঃসঙ্গ শেরপা হিসেবে বেয়ে চলেছেন পর্বতের পর পর্বত। কমেন্ট্রিবক্সে তার প্রতিদিনের এই একক যুদ্ধ আতাহারকে এক নতুন নায়কে পরিণত করেছে।

আতাহারের মতোই নিঃসঙ্গ আরেক যোদ্ধা শামীম আশরাফ চৌধুরী এই পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের পরও বলছিলেন, তাদের এই বছরের পর বছর ধরে সহ্য করা গ্লানি ও বিরুদ্ধ পরিবেশের কথা, ‘জীবনের বড় একটা সময় ধরে কী অপমান সহ্য করে, জীবিকার জন্য, ক্রিকেটের জন্য কী ভয়ঙ্কর অপমান সহ্য করে গেছি, আজ বলে বোঝাতে পারবো না। এই রকম একটা সময় একদিন আসবে বলেই আমি বেচে ছিলাম। আর দশটা মানুষের সেই পরাজয়ের যন্ত্রনা থেকে পালানোর উপায় থাকে, আমাদের সে উপায় ছিলো না।’

 

মজার ব্যাপার হল, আতাহার নিজে কখনও এসব নিয়ে আফসোস করেননি। অনেক কিছু নিজের কানে শুনেছি, অনেককিছু দেখেছি। মুলতান টেস্টে রশীদ লতিফ যখন অলক কাপালির ক্যাচ নিয়ে মিথ্যে দাবি করেছিলেন, আতাহার সেখানেই চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘এটা অন্যায়’।

রমিজ রাজা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘টিপিক্যাল বাংলাদেশি স্টাইল।’

আর আতাহার বলেছিলেন, ‘অ্যান্ড লতিফ ডিড হোয়াট ইস টিপিক্যাল পাকিস্তানি স্টাইল।’

আতাহার জবাব দিয়েছেন, লড়েছেন; কিন্তু কমেন্ট্রি বক্সের বাইরে কখনো এসব নিয়ে অভিযোগ করেননি, অনুযোগ করেননি। আমার কেন যেন মনে হয়, আতাহার সবসময় বোধ করেছেন, তাদের গঞ্জনা নিয়ে অনুযোগ করলে সেটা খেলোয়াড়দের বিপক্ষে যায়। খেলোয়াড়রা পারেন না বলে তারা গঞ্জনা পান; এটা কখনো আতাহার প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি।

এটাই আতাহারকে অনন্য করে তুলেছে।

আতাহার জুনিয়র ক্রিকেটারদের যেভাবে সম্মান জানাতে পারেন, তা কেবলই অনুকরণীয় হতে পারে। ম্যানেজার হিসেবে বয়সভিত্তিক দলে কাজ করেছেন, নির্বাচক ছিলেন জাতীয় দলে। ঘটনাচক্রে বর্তমান জাতীয় দলের প্রায় সব খেলোয়াড় আতাহারের অধীনে এই সময়গুলোতে উঠে এসেছেন।

আতাহার চাইলে এদের অন্য সিনিয়রদের মতোই ‘তুমি-তুমি’ করতে পারেন; ‘তুই’ বললেই বা মারে কে! কিন্তু আতাহার সবাইকে ‘আপনি’ বলেন; অন্তত মিডিয়া স্টেটমেন্টে। অন্তত মিডিয়ায় আতাহারকে কখনো কোনো ক্রিকেটার সম্পর্কে ‘তুমি’ বাচক শব্দ বলতে শুনিনি। সবসময় ‘উনি, ওনারা, বলেছেন’ এই শব্দচয়ন করে কথা বলেন। সবসময় বলেন, ‘ক্রিকেটাররা হলেন সবচেয়ে সম্মানীয়।’

এই যে মাশরাফির সাথে তার এতো ভালো সম্পর্ক, এতো পছন্দ করেন তিনি মাশরাফিকে। সামনাসামনি ‘তুমি’ বলেন। কিন্তু আমাদের সাথে কথা বলতে গেলেই বলেন-উনি, বলেছেন।  এই হলেন আতাহার; এখানেও তিনি একা এবং নিঃসঙ্গ। এখানেও তিনি দৃষ্টান্তস্থাপনকারী।

আতাহারদের নি:সঙ্গ লড়াইয়ের সময়টা শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। রাত কেটে যাচ্ছে। মাশরাফিরা ভোরের আলো দেখাতে শুরু করেছেন।

দিনের আলোয় আস্তে আস্তে আতাহারের সঙ্গী বাড়বে। এখনই আমরা কমেন্ট্রিবেক্সে আধুনিক, দারুণ বিশ্লেষনী ক্ষমতার দু একজন তরুণকে দেখতে পাচ্ছি। এই অনেকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবেন বাংলাদেশের রিচি বেনো, টনি গ্রেগরা। তারা আতাহারের চেয়ে ভালো ইংরেজিতে, ভালো বিশ্লেষণে মন ভরিয়ে দেবেন।

আমরা জানি, আতাহারের ইংরেজী আপনাকে ব্রিটিশ, ক্যারিবিয় বা অস্ট্রেলিয় ধারাভাষ্যকারদের মতো করে টানে না। আতাহারের ঝুলিতে ওসব নামকরা ধারাভাষ্যকারের মতো অতো মন ভরিয়ে দেওয়া শব্দ নেই। আমি জানি, আতাহার কখনোই রিচি বেনোর মতো বিশ্লেষন করতে পারেন না। আপনারা যারা ‘আধুনিক’ তাদের তুলনায় আতাহার বড় ক্লিশে।

কিন্তু হাজারটা রিচি বেনো এসেও আমাদের একটা আতাহার হতে পারবেন না; একটা পর্বতে ওঠার শেরপা হতে পারবেন না। কারণ, আতাহার কেবল একজন খেলোয়াড় বা ধারাভাষ্যকার নন, তিনি একটা প্রজন্মের হয়ে লড়াই করেছেন। একা একা পর্বত বেয়ে উঠেছেন।

আতাহার এক শেরপার নাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link