মাদ্রিদের রঙ লাল

নাটকের মঞ্চ তৈরিই ছিল। অপেক্ষা ছিল শুধু পরিবেশনার। একজন লা লিগা সমর্থকও বলতে পারবে না কোনোদিক দিয়ে কম ছিল লা লিগার শেষ দিনের রোমাঞ্চ। শেষপর্যন্ত সেই রোমাঞ্চ জিতে নিয়েছে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ।

রোমাঞ্চটা তৈরি করেছিল অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদই। তাদের জন্য সমীকরণটা ছিল সোজা, নিজেদের ম্যাচ জিতলেই হবে। বাকি কোনোদিকে তাকানোর প্রয়োজনও নেই। কিন্তু ম্যাচের ১৮ মিনিটের মাথাতেই ভায়াদোলিদের কাছে গোল হজম করে বসে তাঁরা।

মাদ্রিদের অন্য প্রান্তে তখন সার্জিও রামোস বেঞ্চ থেকে একবার দেখছেন নিজেদের খেলা, অন্যদিকে কান খোলা রেখে শুনছেন অন্য ম্যাচের খবর। রামোসের মুখের হাসি চওড়া হয়ে গেল খবরটা শুনে, গোল হজম করেছে অ্যাটলেটিকো। অর্থাৎ নিজেদের ম্যাচ জিতলেই এখন শিরোপাটা তাঁদের।

রামোসের সেই হাসি ২ মিনিটও টেকেনি। মুখের হাসি মুখে থাকতেই মলিন হয়ে গেল ভিয়ারিয়ালের গোলে। ২০ মিনিটের মাথায় দুই মাদ্রিদই পিছিয়ে গিয়েছে ১-০ গোল। প্রথমার্ধও শেষ হয়েছে এই অবস্থাতে থেকেই। রিয়াল-অ্যাটলেটিকোর ম্যাচ দেখতে থাকা বার্সা ফ্যানদের মনে এ অবস্থা দেখে একটা আক্ষেপ জমেছিল ঠিকই। ইশ, পরপর দুই ম্যাচে পয়েন্ট না হারালে হয়তো এই সুযোগটা নিয়ে নেওয়া যেত।

দ্বিতীয় হাফ শুরু হতে না হতেই বোঝা গেল জয়ের তাড়না দুই দলের কতখানি। দুই মাদ্রিদই ডিফেন্স ছেড়ে উঠে পরে লাগলো গোল করতে। এখানেও প্রথমে গোলের দেখা পেল অ্যাটলেটিকো। ৫৭ মিনিটে অ্যাঞ্জেল কোরেয়ার ডি-বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া দূর্দান্ত শট থামানোর সুযোগ হয়নি ভায়োদোলিদ গোলরক্ষকের।

মাদ্রিদের অন্যপ্রান্তও তখন উদযাপনে ব্যস্ত। রিয়ালও ফিরেছে ম্যাচে, আর সেই তারকা গত তিন মৌসুম ধরে রিয়ালকে বাঁচিয়ে যাওয়া করিম বেনজেমা। কিন্তু রিয়ালের আনন্দ টেকেনি ২ মিনিটও বেরসিক ভিএআর সেই আনন্দে জল ঢেলে দেয় এক মিনিট পরই। অ্যাটলেটিকো ১-১ করে ফেললেও রিয়াল পিছিয়ে থাকে ০-১ এ।

৬৭ মিনিটে অ্যাটলেটিকোর ত্রাতা হয়ে আসেন লুইস সুয়ারেজ। আর তাতেই জয় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায় অ্যাটলেটিকোর। তখনও এক গোলে পিছিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ। অ্যাটলেটিকোর জন্য আর কিছুই প্রয়োজন ছিল না, তাদের যা জয় করবার তা ইতোমধ্যে হয়ে গিয়েছে।

নিজেদের জন্য যে জয় দরকার ছিল সেটা নিশ্চিত করেই সিমিওনের বিখ্যাত পার্ক দ্য বাসে ফেরত গিয়েছে ও্যাটলেটিকো। অবনমনের শঙ্কায় থাকা ভায়াদোলিদও নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে গিয়েছে একটিবার অ্যাটলেটিকোর ডিফেন্স ভাঙ্গার জন্য। কিন্তু সিমিওনের ডিফেন্স ভাঙা তো অত সহজ কাজও নয়। ভায়াদোলিদ পারেনি।

রিয়াল অবশ্য পেরেছে। শেষ মিনিটে নাটকের অবতারণা করতে রিয়ালের জুড়ি মেলা ভার। ৮৭ মিনিটে এসে রিয়ালের তারতারূপে আবির্ভুত হন করিম বেনজেমা। পুরো মৌসুমজুড়ে যিনি নিজের নামের সুবিচার করে গিয়েছেন, রিয়ালকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন তিনিই। আর ৯২  মিনিটে গিয়ে রিয়ালের হয়ে জয় নিশ্চিত করেন লুকা মদ্রিচ।

তখনও অ্যাটলেটিকো ম্যাচের এক মিনিট বাকি। ভায়োদোলিদ কিছু একটা করে ফেললেই আনন্দে মেতে উঠবে মাদ্রিদের আরেকপাশ। বল নিয়ে সামনে ঠিকই এগিয়েছিল তারা, কিন্তু ফিনিশিং করতে পারেননি। অগত্যা অ্যাটলেটিকোর মাঠে শেষ বাঁশি বাজতেই উল্লাসে ফেটে পরলো সিমিওনের দল।

পুরো মাঠ একবার প্যারেড দিয়ে ফেললেন সিমিওনে একাই। ইয়োরেন্তে ট্রিপিয়াররা যখন মাঠ কাঁপাতে ব্যস্ত, তখন মাদ্রিদের অন্যপাশে মাটীতে লুটিয়ে পরেছেন বেনজেমা, নাচোরা। এতদূর এসেও জয়ের আনন্দে না ভাসতে পারার দু:খ সকলের মনেই।

সিমিওনের মুখের হাসিই বলে দিয়েছে, কতটা কষ্টার্জিত জয় সেটা। নিজের ট্যাক্টিস অনুযায়ী কিনে আনা ট্রিপিয়ারকে পাননি তারা বড় একটা সময়। ইংল্যান্ডে দেওয়া ব্যান কার্যকর হয়েছে স্পেনে এসে। তার পরেও একের পর এক ম্যাচ জিতেছেন মৌসুমের প্রথামার্ধে, অথচ খেই হারিয়েছিলেন মাঝপথে। প্রথমার্ধের শুরুটাই এগিয়ে নিয়েছে তাদের।

আনন্দটা লুইস সুয়ারেজের, বার্সেলোনা থেকে একপ্রকার অপমান করেই বের করে দেওয়া হয়েছে তাকে। মাত্র ৫ মিলিয়ন ইউরোর বদলে তাকে কিনেছে অ্যাটলেটিকো। বার্সেলোনাকে ভালোবাসার প্রতিদান পেয়েছিলেন এভাবে। তার জবাব দিয়েছেন গোলের বন্যা বইয়ে। মার্কোস ইয়োরেন্তের কথাও বা বাদ যাবে কেন? বাবা-চাচা ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়।

অথচ কয়েক মৌসুম খেলেও জিদানের গুডবুকে জায়গা করে নিতে পারেননি তিনি। অগত্যা মাদ্রিদের আরেক ক্লাবে এসে ভিড়েছেন। ভিড়েই প্রমাণ করে দিয়েছেন কতটা ভালো মিডফিল্ডার তিনি। ১২ গোল ১১ এসিস্ট করে জানান দিয়েছেন নিজের সামর্থ্য। মারিও হারমেসো, কেইরেন ট্রিপিয়ারদের, ইয়ানিক কারাস্কোর জন্যও ছিল প্রমাণ করার মৌসুম। সেটা প্রমাণ করেছেন মাঠেই।

৭ বছর পরের লিগ জয়ের বুনো উদযাপন চলেছে পুরো দিনব্যাপী। মাঠ ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন লুইস সুয়ারেজ, ইয়ান অবলাকরা। এই আনন্দের দিনে একটু আধটু নিয়ম ভঙ্গ তো করাই যায়। রাস্তায় নেমে এসে প্রতিটি সমর্থকের সাথে গলা মিলিয়ে যেন সেটাই প্রমাণ করেছে অ্যাটলেটিকো বাহিনী। পুলিশ দিয়েও যে শান্ত করা যায়নি তাদের, এতটাই বুনো উদযাপন তাদের।

স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের মতে, ‘অ্যাটাক জেতায় ম্যাচ আর ডিফেন্স জেতায় ট্রফি।’ গত ১০ বছরে সেই কৌশল দিয়েই দুইবার রিয়াল-বার্সার ডেডলক ভেঙেছেন সিমিওনে। জিতেছেন লা লিগা। নিজের মতন করে রিবিল্ড করেছেন লা লিগার তৃতীয় সেরা দলটিকে। আর তা দেখছে পুরো বিশ্ব। যতই সিমিওনের ফুটবলকে ‘ডার্টি ফুটবল’ বলে ট্যাগ দিক না কেন সুশীলরা, সিনশেষে সিমিওনে সফল, উঁচিয়ে ধরা লা লিগা শিরোপাটাই তাঁর প্রমাণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link