ওয়েস্ট ইন্ডিজে হওয়া টেস্ট ম্যাচ গুলো তখন রাত জেগে দেখতে বেশ লাগতো, ক্যারিবিয়ান দ্বীপ পুঞ্জের জামাইকা, ত্রিনিদাদ, বার্বাডোজ, অ্যান্টিগার পুরোনো সব মাঠ গুলোতে হওয়া টেস্ট ম্যাচ যেন আলাদা এক মাদকতা তখনও।
ব্রায়ান লারার অবসর আর ২০০৭ বিশ্বকাপের পর থেকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ঢক্কা নিনাদ আসলে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে হওয়া টেস্ট ক্রিকেটের সে মাদকতায় জল ঢেলেই দিয়েছে বলা যায়। সে যাক, সদ্য শেষ হওয়া ২০০৩ বিশ্বকাপের পরেই লারার দেশে সফরে সেবার স্টিভ ওয়াহর ক্যাঙ্গারু বাহিনী।
প্রথম তিনটা টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজ লড়াই দেওয়ার চেষ্টা করলেও দুর্ধর্ষ অজি লাইন আপের বিরুদ্ধে একেবারে ল্যাজে গোবরে অবস্থা লারাদের। লারা আর শিবনারায়ন চন্দরপল যদিও বেশ ভালোই চালাচ্ছিলেন ব্যাট হাতে, সঙ্গে নতুন প্রতিভা ড্যারেন গঙ্গাও গোটা দুয়েক সেঞ্চুরি হাঁকালেন সিরিজে, আসলে সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিংয়ের থেকেও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বোলিংটা। মার্ভিন ডিলন সেই ধার হারিয়েছেন আর তাঁকে সাহায্য করারও তেমন কেউ উঠছিল না।
অ্যান্টিগা রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে সেবার চতুর্থ তথা শেষ টেস্ট, তখনও এখনকার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়াম হয়নি, আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিয়মিত হারলেও মাঠে লোকের অভাব হতো না। ভেঁপু, রেডিও নিয়ে ভিভের পাড়ার লোকজন তারপরেও অনেক আশা নিয়ে খেলা দেখতে আসতেন। জার্মেইন লসনের বিধ্বংসী বোলিংয়ে অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে দারুণ কিছু করতে পারলো না, লারাবাহিনীর অবস্থাও তাই, দু’দলই প্রথম ইনিংসে ২৪০।
দ্বিতীয় ইনিংসে হেডেন, ল্যাঙ্গারের জোড়া সেঞ্চুরিতে অস্ট্রেলিয়া যখন ক্যারিবিয়ানদের সামনে ৪১৮ রানের লক্ষ্যমাত্রা রাখলো ম্যাকগ্রা, ব্রেট লি, জেসন গিলেস্পি, স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলদের সামনে লারাদের হার আর হোয়াইট ওয়াশ হওয়া তখন শুধু যেন সময়ের অপেক্ষা। হাতে তখনও দু’ দিনের বেশি সময়। ১০০ রানের মধ্যে তিন ব্যাটসম্যান প্যাভিলিয়নের পথ দেখার পর ওই পাহাড় প্রমান রানের কাছাকাছি যাওয়াও দু:সাধ্য মনে হচ্ছিল।
এরপর প্রথমে লারার সাথে আর তারপর চন্দ্রপলের সাথে সারওয়ানের দুটো দুর্দান্ত পার্টনারশিপ ধীরে ধীরে সেদিনের মতো রাতের ঘুম উড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। সারওয়ান সম্পর্কে মুগ্ধতা জন্মেছিল তার আগের বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভারত সফর থেকেই, আর বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে একটা ম্যাচে চোট পেয়ে ফিরে এসেও লড়াকু দুর্ধর্ষ একটা ইনিংস সেই মুগ্ধতা আরো বাড়ায়।
তো সেদিনের কথায় ফেরা যাক, ম্যাকগ্রার সাথে একরাশ বচসার পরে কাউন্টার অ্যাট্যাকিং একটা সেঞ্চুরি এলো সারওয়ানের, শতরানের পর সারওয়ান আর রিডলি জেকবস ও যখন আউট হলেন শূন্য করে তখন ও দেড়শো মতো রান বাকি। সে তখন ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ – পেরোনোর জন্য স্বীকৃত ব্যাটসম্যান শুধুই চন্দ্রপল।
সবে মাত্র দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নামা আর আঙ্গুইলা রিজিওনের প্রথম খেলোয়াড় ওমারি ব্যাঙ্কস কিন্তু অন্য রকম কিছু ভেবেছিলেন, চন্দ্রপলকে দিব্যি সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছিলেন। দিন শেষে (আমার কাছে রাত শেষে) তখনও প্রায় ৫০ রান মতো বাকি ওয়েস্ট ইন্ডিজের জিততে। এক ঐতিহাসিক ব্যাপার পরের দিন হতে যাচ্ছে এই ভেবে শেষ রাতে ঘুমোতে যাওয়া।
পরের দিন শুরুতেই চন্দ্রপল ফিরলেন, লারাদের জয়ের সম্ভাবনা ক্রমশ কমছে, এই অবস্থায় ভাসবের্ট ড্রেক্স আর সেই ব্যাঙ্কস জীবন বাজি রেখে যেন লড়াই শুরু করলেন ম্যাকগ্রা, গিলেসপিদের সামনে। তুমুল উত্তেজনা অ্যান্টিগার সেই পুরোনো মাঠে, একটা একটা করে রান হচ্ছে আর স্টিভ ওয়ার মুখ ও কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে ক্রমে।
আর উত্তেজনায় ছটফট করা মনের অবস্থা তখন যেন ভারতের বিজয় পতাকা উড়বে স্টিভদের হারিয়ে, ব্যাঙ্কস আর ড্রেক্স যেন আমাদের ঘরের ছেলে। হোক না দলের নাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কোথাও গিয়ে যেন ঐ মেরুন টুপির লোকগুলোর সাথে আমাদের নীল রঙ টাও মিশে গেছে। অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর দিকে যাচ্ছে, এটাই যেন আসল। বল হাতে এলেন আগের টেস্টের ম্যাচ সেরা ম্যাকগিল, তার আগের ম্যাকগ্রার ওভারে খোঁচা লাগিয়ে কোনোক্রমে বেঁচে গেছেন ড্রেক্স।
ম্যাকগিলের প্রথম বলটাই ফুলটস, ব্যাঙ্কস এর ব্যাটের কানায় লেগে ফাইন লেগ দিয়ে বল বাউন্ডারির বাইরে সোজা। ঐতিহাসিক জয় আসতে রইল বাকি পাঁচ, ব্যাঙ্কস স্ট্রাইক দিলেন ড্রেক্সকে। অপেক্ষা আর বাড়ালেন না আর তিনি, ম্যাকগিলকে পরের বলেই আর রেয়াত করার প্রয়োজন মনে করলেন না দীর্ঘদেহী ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান।
লঙ হপ দিয়েছিলেন ম্যাকগিল, ড্রেক্সের ব্যাটে বল লেগে শুধু বাউন্ডারির বাইরে যাওয়ার অপেক্ষা, গোটা মাঠের চিৎকারের সাথে নিজের গলা দিয়েও কিভাবে যেন জয়োল্লাস বেরিয়ে এসেছিল । স্কোরবোর্ডে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পাশে ৪১৮/৭ – হ্যাঁ, জয় এলো ক্যারিবিয়ানদের, গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়ে, রেকর্ড রান তাড়া করে। আবারও জীবনের গল্প বলে যাওয়া টেস্ট ক্রিকেট যেন বৈশাখের রাতে এক পশলা ঝোড়ো হওয়ার মতো মন ভালো করার গল্প ও বলে দিয়ে গেল, জীবন আর টেস্ট ক্রিকেটের সার্থকতা তো ওখানেই, ঠিক ওই ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের রোম্যান্সের মত।