যে মাথা নোয়াবার নয়

অস্ট্রেলিয়ান সময় আনুমানিক ২ টার সময় গ্যাবার পিচে জশ হ্যাজলউড চেতেশ্বর পূজার দিকে এগিয়ে এলেন।

চোখেমুখে এক ধরণের অবজ্ঞাই ফুটে উঠল যেন। এমন ঘটনায় সাধারণত যেটা হয়, ব্যাটসম্যানও তাঁর চাহনি দিয়ে বা একটা অঙ্গভঙ্গি করে ‘জবাব’ দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু চেতেশ্বর পূজারা এর কিছুই করলেন না। তিনি শান্তভাবে একবার হ্যাজলউডের দিকে আর আরেকবার গ্যালারির দিকে তাকালেন। গোটা সিরিজটার প্রতিচ্ছবি যেন লেখা হয়ে গেল ঐ একটা মুহুর্তেই।

হ্যাজলউড কিন্তু আনন্দে ছিলেন না। পূজারার সেই চাহনির জবাব দেওয়াতেও কোন সুখীভাব ছিল না। তিনি বোলিং ক্রিজে ফিরে গেলেন আর একের পর এক গোলা ছুঁড়তে লাগলেন। সেই গোলা এতটাই ভয়ংকর ছিল যে একটাতে তো পূজারার স্টেম গার্ডই খুলে গেল। এতটুকুতেও কিন্তু শান্ত হননি হ্যাজলউড। তিনি এরপরও গোলা ছুঁড়ে গেলেন, পূজারার হেলমেটও একটু নড়ে গেল মনে হল।

অস্ট্রেলিয়ার মনোভাব মাঠে সবসময় আগুনে। প্রতিপক্ষের আত্মবিশ্বাস তাঁরা নামিয়ে আনতে চায় হিমাঙ্কের নিচে। হ্যাজলউডও সেরকম একটা চেষ্টা করলেন, এগিয়ে গিয়ে পূজারাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি ওগুলো চোখে দেখেছিলে?’

নাহ, পূজারা এবারও জবাব দেননি। তিনি হেলমেটটা নেড়েচেড়ে ভালমত মাথায় গলিয়ে দিলেন, স্টেম গার্ডটা ঠিকঠাক করে নিলেন। ভাবখানা এমন, এতসব হওয়া যেন প্রতিদিনকার কাজের মত, রুটিন কাজের ন্যায়। পূজারার আত্মবিশ্বাস টলাতে আসা হ্যাজলউড পূজারার কোন ‘অ্যাটেনশন’ই পেলেন না!

চাইলে এই এতটুকু ছবিতে দিনের প্রথম দুই সেশনের গল্প দেখে নিতে পারেন। অস্ট্রেলিয়ার ক্ষিপ্রতা একেবারে স্তিমিত হয়ে গেছে পূজারার শান্ত কিন্তু দৃঢ়তার কাছে।

ভারত তাঁদের শেষ দিনটা শুরু করেছিল একটা ড্রয়ের আশা নিয়ে। তাই প্রথম থেকেই ৩২৪ রান তাড়া করায় তাঁদের খুব একটা তাড়া ছিল এমনটা বলা যাবেনা, অন্তত টিভি স্ক্রিনে দেখে তো সেরকমটাই মনে হয়েছে।

ভারতের মনোভাব ছিল পুরো ইনিংসে ব্যাট করা। পূজারাও তাই ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব জয়’ মনোভাব নিয়ে একের পর এক বল ঠেকিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে টি-ব্রেকের পর ভারত সম্ভবত তাঁদের পরিকল্পনাতে একটা পরিবর্তন আনে, এরপর আর কোন ব্যাটসম্যানের খেলাতেই পূজারার মত ডিফেন্স খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটা কেমন যেন জয়ের ইচ্ছাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল।

তা পূজারার ঐ দৃঢ়চেতা মনোভাব না হলে ভারত যে শেষদিকে জেতার জন্যে খেলতে পারত না , এটাতে তো কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। তাই পূজারার গল্পে আবার ফিরে আসি। পূজারার দিকে একের পর এক বল ছুঁড়ে দিচ্ছিল অস্ট্রেলিয়ানরা, পূজারাও যেভাবে পারেন সেভাবেই ঠেকিয়ে দিচ্ছিলেন। সবকয়টাতেই যে ব্যাট ব্যাবহার করছিলেন, এমনটা কিন্তু নয়। তিনি তাঁর পুরো শরীরটা ব্যাবহার করছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার বোলাররাও একের পর এক বাউন্সার ছুঁড়ে যাচ্ছিলেন- আর কতক্ষণ পূজারা?

পূজারা যেটা করেছেন সেটা কিন্তু মোটেও সহজ নয়। আপনি যখন জানবেন আপনার দিকে বল এসে আঘাত করবে , আর আপনি খুশিমনেই তা করতে দেবেন- এমনটা আসলে সহজ নাকি? আর যদি, এরপরও ক্রিজে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সাবলীলভাবে তাহলে ? পূজারা তো পুরো দুই সেশন এসবই করে গেছেন!

তবে পূজারার উলটো কাজটা করেছেন ঋষভ পান্ত। শুরু থেকেই দলে ছিলেন না তিনি, সিডনির আগে তাঁকে দলে নেওয়ার যৌক্তিকতাও প্রমাণ করতে পারেন নি। তবে পান্তের ওপর ভরসা ছিল দলের। তা তিনি ক্রিজে এসে শট খেলেছেন উইকেটের চারপাশে। তাঁর দিকেও ছুটে এসেছে অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের ক্ষিপ্র গোলা, পান্ত মনে করিয়ে দিয়েছেন-অ্যাটাক ইজ দ্যা বেস্ট ডিফেন্স। জয়ের জন্যে পান্তকে কিন্তু সেটা করতেই হত।

একটু খেয়াল করে দেখুন, পান্ত যা করেছেন আর পূজারা যা করেছেন- দুইভাবে করা দুটো কাজের একই উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে। নাকউঁচু অস্ট্রেলিয়ানদের গর্ব লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে।

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link