একজন অভিকের জয় ও তামিম

ছোটবেলায় ‘নিড ফর স্পিড’ বা ‘মোটো রেসার’ খেলেনি এমন কেউ কি আছে? হয়তো নেই। কিন্তু রেসিংয়ের জগতে বাংলাদেশীরা দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের চলার ঘোরা কেবল কল্পনাতেই আটকে রাখত।

কখনও কখনও হয়তো মাইকেল শুমাখার, মিকা হাকিনেনদের দেখে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে যেত। কিন্তু লাল সবুজের দেশে কেউ একটা রেস জিতবে, রেসের ট্রাকে গাড়ি ছোটাবে এমন কল্পনা খুব বেশি মানুষ করার কথা নয়। যে দেশের মানুষের একটা বড় অংশের মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাঁদের জন্যে অবশ্যি এটাই স্বাভাবিক।

নাহ, অবশেষে কিন্তু একজনকে পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের এই সবেধন নীলমণির নাম অভিক আনোয়ার। কিছুদিন আগেই তিনি জিতেছেন আরব আমিরাতের ‘ইউএই প্রো চ্যাম্পিয়নশিপ জিটি-৮৬ ক্লাস’। এর আগেও তিনি মালয়েশিয়া আর ভারতে নানা চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন। তবে সদ্য জেতা এই চ্যাম্পিয়নশিপ তিনি উৎসর্গ করেছেন কাছের বন্ধু তামিম ইকবালকে। রেস জেতার পর নিজের ফেসবুক একাউন্টে তিনি লিখেছেন,

‘একটা গল্প বলি আপনাদের। আমি একজন অসাধারণ ক্রিকেটারের বন্ধু, নাম তামিম ইকবাল। ২০১৭ সালে সে একবার আমাকে বলল- ভাই এত রেস করে লাভ কি জিতেন না তো। এরপর ২০১৯ সালে আমি প্রথম রেস জিতে তামিমকে ফোন দিই। ও অনেক গর্বিত ছিল কিন্তু আমি তখন সেটা ওকে উৎসর্গ করতে পারিনি। কিন্তু আজকে আমি আমার এই রেস জয় তামিমকে উৎসর্গ করছি। আমি আবারও বাংলাদেশের হয়ে জিতেছি আর আমিই একমাত্র বাংলাদেশি যে আন্তর্জাতিক মোটর রেসে প্রথম স্থানের ট্রফি জিতেছে। সব কিছুর জন্যে আলহামদুলিল্লাহ। জয় বাংলা।’

অভিক বলেছেন তিনি আবারও জিতেছেন, খুবই সত্যি কথা। দীর্ঘদিনই তিনি রেসের ট্রাকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেণ। গোটা বছরের আগস্টে মালয়েশিয়ার ফর্মুলা ওয়ান ট্রাক সেপাং আন্তর্জাতিক সার্কিটে জিতেছিলেন ব্রোঞ্জ পদক; ৪৮ জনের মধ্যে হয়েছিলেন তৃতীয়। তবে এত অর্জনের সোপানের শুরু কিন্তু অনেক ছোটবেলাতে।

অভিক আনোয়ার পেশাদারভাবে একজন গাড়িব্যাবসায়ী। বাবা আনোয়ার হোসেনেরও ছিল গাড়ির ব্যবসা। খুব স্বাভাবিকভাবেই অল্প বয়স থেকেই গাড়ি দেখে বড় হয়েছেন। ফলে গাড়ির প্রতি একটা টান জন্মে গেছিল,  প্রায়ই বাবার দোকানে গিয়ে গাড়ি ছুঁয়ে দেখতেন। তখনই শখ জাগে গাড়ি নিয়ে নানান কিছু করার। এরপর বাবাকে না জানিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে গাড়ি চালানোও শেখেন। ঐ সময় গাড়ি নিয়ে নিজের ফ্যান্টাসী এত বেশি ছিল যে, টিভিতে সারাদিন দেখতেন ফর্মুলা ওয়ান রেসিং। অভিক আনোয়ারের গাড়ি নিয়ে ছুটে চলার শুরুটা এভাবেই।

তবে ছুটে চলার এই স্বপ্ন থাকলে কি হবে, বাংলাদেশে মোটর রেসিংয়ের কোনো ট্রাকই যে নেই। এমনকি রেসিংয়ের প্রশিক্ষকসহ অন্য সুযোগ-সুবিধাও তো নেই। কিন্তু তাতে কি? তাই বলে থেমে থাকেননি অভিক আনোয়ার। মূল সহায়ই ছিল প্লে স্টেশনের গেম আর সিমুলেটর। সেসময়ে প্লে স্টেশনে খেলতেন গ্রান ট্যুরিসমো স্পোর্ট। ২০১৯ এ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, বন্ধুরা নাকি প্রায়ই হাসাহাসি করতেন আর বলতেন, ‘এসব অবাস্তব গেম খেলে কী হবে?’

অভিক বন্ধুদের বোঝাতেই পারতেন না যে এই খেলার সঙ্গে বাস্তবে গাড়ি চালানোর মিল রয়েছে আর গাড়ি চালনা রয়েছে তাঁর নেশাতেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২০০৭ সালে কানাডায় উচ্চতর পড়াশোনার জন্য গেলে সেখানেই মেলে আরাধ্য স্বপ্নের অনুশীলনের সুযোগ।

কিন্তু সুযোগ মিললে কি হবে, মোটর রেসিং একটি ব্যয়বহুল খেলা। অনুশীলন করতেও প্রয়োজন মোটা অঙ্কের অর্থ আর সরঞ্জাম। সেই টাকা অবশ্য অভিক তাঁর বাবার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকেই নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা নেননি, নিজেই সাহায্য করতে চেয়েছেন নিজেকে। কানাডায় পড়াশোনার ফাঁকে কাজ করতেন পিৎজা ডেলিভারির। কানাডাতে এটা প্রায় সবারই উপরি আয়ের উৎস। অভিক অবশ্য এটা ছাড়াও কখনো রেস্তোরাঁর সবজি কেটেছেন, কখনো লাইব্রেরিতে করেছেন খণ্ডকালীন চাকরি।

এসব কাজ করেই তিনি টাকা জমিয়েছেন আর সেই টাকা দিয়ে গাড়ি কেনেন একসময়। আর তারপরই কানাডার অনুশীলন ট্র্যাকে গিয়ে নিয়মিত অনুশীলন করতেন। অনুশীলন করতে করতেই একদিন রেসিংয়ে নিজের সম্ভাবনাও অনুমান করে ফেলেন অভিক। তবে ২০১২ সালে পড়াশোনা শেষে ফিরে আসেন ঢাকায়।

ঢাকায় ফিরে আবার আগের সমস্যা, রেসিং এখানে একেবারেই অনিয়মত একটি খেলা। তবে যেটুকু সুযোগ আছে, সেটাই তিনি নিয়ে নেন দুহাত ভরে। আর তাই ২০১৪ সালে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত হওয়া একমাত্র মোটর রেস র‌্যালি ক্রসে অংশ নেন অভিক। র‍্যালি ক্রসের এরপরের আসরেও অংশ নেন তিনি। ঢাকায় হওয়া সেই প্রতিযোগিতায় হয়েছেন হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন। প্রথম দুইবার তিনি জেতেন মাইক্রোসেকেন্ডের ব্যাবধানে, কিন্তু শেষবার পেছনের গাড়ি থেকে এগিয়ে ছিলেন সময়ের ব্যবধানে অনেকটাই। সেই আত্মবিশ্বাস আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রেস করার সাহস জোগায় অভিকের। তিনি ভারতে যাওয়ার চিন্তা করতে শুরু করেন।

ভাবনামত এরপর ভারতের ভক্সওয়াগন কাপে ২০১৭ সালে অংশ নেন অভিক, অংশ নিয়েই চতুর্থ হন।  যা তাঁর আত্মবিশ্বাসের পালে লাগায় নতুন হাওয়া। রেসে নিজের সম্ভাবনার যে ভাবনা কানাডাতে থাকতে জন্মেছিল, সেই ভাবনা আরো শক্ত হতে থাকে। তা সেই ভাবনা যে অমূলক নয় তা তো আরব আমিরাতেই দেখা গেল।

তবে অভিকের এই পথচলাতে বিপত্তি আর বাঁধাও আছে। আগেই বলেছি দেশে অনুশীলনের সুযোগ নেই। তাই প্রায়ই বিদেশে চলে যান অনুশীলনের জন্য। তবে ব্যাবসাতে মনোযোগ দেওয়াতে মাঝেমধ্যেই মনোযোগ সরে যায়। একসময় তাই রেসের অনুশীলনের জন্য ব্যবসা থেকেও মনোযোগ উঠিয়ে নেন। মাঝেমধ্যে সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়েও নেন।

অনুশীলনের এক সপ্তাহে মুঠোফোন, ফেসবুকসহ সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান ইচ্ছা করে। তখন শুধু হোটেল থেকে ট্র্যাকে যান, শেষে আবার ফিরে আসেন হোটেলে। নিজের উন্নতির জন্যে অনুশীলনের পর ট্র্যাক থেকে কিছু উপাত্ত অভিককে দিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে নিজের খেলার দুর্বলতা দেখেন। কোথায় উন্নতি করতে হবে, সেগুলো বোঝার চেষ্টা করেন।

এভাবেই এগিয়ে চলেছেন অভিক। সামনে আরো আগে বাড়বেন স্টিয়ারিং হাতে; এ তো আমরা আশাই করি!

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link