বড় মঞ্চের হৃদয়হরণ

সাউদি, বোল্ট, মিলনে, সান্টনার, কোরি অ্যান্ডারসন্ডদের বিপক্ষে ৩৩ রানে ৪ উইকেট হারানোর পরও ১৬ বল হাতে রেখে ২৬৮ রান করে জয় তুলে নেয়া বাংলাদেশের বড় দল হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। বড় দলের তারকা খেলোয়াড়রা যেমন নিজেদের উপর বিশ্বাস রেখে স্কিল প্রদর্শন করে খেলা নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয়, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সাকিব আর মাহমুদুল্লাহ ঠিক এই কাজটিই খুব দৃষ্টিনন্দনভাবে সুসম্পন্ন করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের মাটিতে বাংলাদেশের পারফরমেন্স সাকিব-মাহমুদুল্লাহদের আত্ম-বিশ্বাসী করেছে যার প্রতিফলন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পুরো বিশ্ব দেখেছে।

২০১৭ সাল। আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি।

  • জুন ৭, এজবাস্টন, বার্মিংহাম

দক্ষিণ আফ্রিকা (আইসিসি র‌্যাংকিং ১) বনাম পাকিস্তান (আইসিসি র‌্যাংকিং ৮)

দক্ষিন আফ্রিকা টস জিতে ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত নেয় এবং ৫০ ওভার শেষে তাদের সংগ্রহ দাড়ায় ৮ উইকেটে ২১৯। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান এবি ডি  ভিলিয়ার্স তার ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত ‘গোল্ডেন ডাক’ এর শিকার হন। পাকিস্তান ব্যাট করতে নেমে ২৭ ওভার শেষে ৩ উইকেট হারিয়ে ১১৯ রান সংগ্রহ করার পর বৃষ্টির কারনে খেলা বন্ধ হয়। ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথডে পাকিস্তান ১৯ জয়ী হয়। যদিও তখন খেলার অবস্থা ছিল ৫০-৫০ অথবা পাকিস্তানের পক্ষে ৫৫-৪৫!

  • জুন ৮, দ্য ওভাল, লন্ডন

ভারত (আইসিসি র‌্যাংকিং ৩) বনাম শ্রীলঙ্কা (আইসিসি র‌্যাংকিং ৭)

শ্রীলঙ্কা টস জিতে ভারতকে ব্যাটিং এর আমন্ত্রণ জানায়, ভারতের সুপার স্টার ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি শুন্য রানে আউট হওয়ার পরও ভারতের সংগ্রহ ৬ উইকেটে ৩২১। অনেক বড় সংগ্রহ! আসলেই কি তাই? দানুস্কা গুনাথিলাকা, কুসাল মেন্ডিস, কুসাল পেরেরা, এঞ্জেলো ম্যাথিউস এবং আসেলা গুনারাত্নে যেদিন তাদের ব্যাটে ঝলক দেখাবেন, সেইদিনের জন্য অবশ্যই না। আট বল বাকী থাকতেই শ্রীলঙ্কা ভারতের রান টপকে যায়।

  • জুন ৯, সোফিয়া গার্ডেনস, কার্ডিফ

নিউজিল্যান্ড (আইসিসি র‌্যাংকিং ৫) বনাম বাংলাদেশ (আইসিসি র‌্যাংকিং ৬)

নিউজিল্যান্ড টস জয়ের হাসি হেসে ব্যাট করতে নামে, ৫০ ওভার শেষে তাদের রান ৮ উইকেটে ২৬৫। এই সংগ্রহ আরও বড় হতো যদি না ৪০ ওভারের পর মোসাদ্দেকের স্পিন ভেলকি না দেখা যেত! তারপরেও সংগ্রহ নেহাত মন্দ নয়। টিম সাউদি, ট্রেন্ট বোল্ট ও অ্যাডাম মিলনের তোপে যখন বাংলাদেশের রান দাঁড়ায় ৪ উইকেটে ৩৩; তখন নিউজিল্যান্ডের ২৬৫ রানকে আরও বড় মনে হতে থাকে। সাকিব আর মাহমুদুল্লাহ অসম্ভবকে সম্ভব করলেন! পরবর্তী ৩৫ ওভারে ২২৪ রানের এক মহাকাব্যিক জুটি গড়লেন যাতেই নিউজিল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে ছিটকে পড়লো।

তিন দিনের তিনটি খেলার ফলাফল, অনেকের কল্পনার বাহিরে। যদি কারো এই তিনটি খেলার ফলাফল পূর্বানুমান সঠিক হয়ে থাকে, তবে সেই ‘দেবদূত’ এর সাথে সাক্ষাতের জন্য আমি উদগ্রীব!

চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলতে যাওয়ার পূর্বে নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন  গুরুত্বপূর্ণ দুটি কথা বলেছেন-

১. ‘সাধারণত, আমার ধারনা পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো এই ধরনের কন্ডিশনে প্রচুর ক্রিকেট খেলে থাকে’। এই কথার মর্মার্থ দাড়ায় এশিয়ার বাহিরের দলগুলো সামান্য এগিয়ে।

২. ‘চ্যাম্পিয়নস ট্রফি একটি আকর্ষণীয় টুর্নামেন্ট … যে কোনো দিন, বিশেষত একদিনের ক্রিকেটে, যেকোন দল খেলার ফলাফল নিজেদের দিকে নিতে পারে, যা আপনার নিয়ন্ত্রনের বাহিরে।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো এটা টি-টুয়েন্টি খেলার জন্য বেশি প্রযোজ্য, যেকোন দলের যেকোন দিন ভালো বা খারাপ হতে পারে। হ্যাঁ, ওয়ানডে ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও এটা সত্য টেস্ট ক্রিকেটের তুলনায়। অবশ্য আবহাওয়া আপনার নিয়ন্ত্রনের বাহিরে কিন্তু ফিটনেস, বাজে ব্যাটিং, নিয়ন্ত্রনহীন বোলিং কিংবা বাজে ফিল্ডিং তো নিয়ন্ত্রনের বাহিরে নয়!

ভারত ব্যতিত এশিয়ার বাকী তিনটি দলই র‌্যাংকিংয়ের ৬ থেকে ৮ নম্বরে। সাঙ্গাকারা- জয়াবর্ধনে ব্যতীত শ্রীলঙ্কা এখনো ছন্দে আসতে পারেনি, পাকিস্তানের পারফরমেন্স প্রচুর উঠা-নামা করে। আর বাংলাদেশ! ভালো কিন্তু একটি ক্ষুদ্র অংশ মনে করে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বাদ দিয়ে টুর্নামেন্টের আকর্ষণীয়তা কমিয়েছে। বাকি ইতিহাসতো এখন সবার জানা, ইংল্যান্ডের সাথে সেমিফাইনালে এশিয়ার তিন দেশ।

অনেকেই আপত্তি জানাবে। বলবে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পাকিস্তান বৃষ্টির কারণে সামান্য সুবিধা পেয়েছে কিন্তু স্কোরবোর্ড দেখলে প্রতীয়মান হয় যে দক্ষিণ আফ্রিকা সুনির্দিষ্ট ব্যবধানে খেলায় পরাজিত হয়েছে।

কিভাবে বিশ্ব ক্রিকেটের তিন পরাশক্তি টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়লো? কেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার পারফরম্যান্স হঠাৎ ছন্দহীন? টুর্নামেন্ট শুরুর সাথে সাথে কি হলো ২০১৫ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা নিউজিল্যান্ডের? আর দক্ষিন আফ্রিকা- প্রতি বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের মত আবারো ব্যর্থ!

যে তিনটি খেলার কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে পরাজিত দল হিসাবে একমাত্র ভারত সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। কারন বাকী ম্যাচগুলোতে ভারত হেসে-খেলে বিপক্ষ দলগুলোকে হারিয়েছে।

এখনকার ইংলিশ ‘ওভারকাস্ট কন্ডিশন’, যেখানে বল প্রচুর সুইং করে সেখানে শীর্ষ আট দলের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানরা খুব বেশী ব্যবধান গড়ে দিতে পারে না। উইলিয়ামসন, কোহলি, জো রুট, স্টিভ স্মিথ, এবি ডি ভিলিয়ার্স হয়ত অন্য ব্যাটসম্যানদের থেকে এগিয়ে কিন্তু সামগ্রিকভাবে ব্যবধান খুব বেশি বড় নয়!

অনেকে হয়ত তর্ক করতে পারে কিন্তু একটি ব্যাপার খুব উল্লেখযোগ্যভাবে বিবেচ্য, তা হলো পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা দল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে, বিশেষ করে ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে বাংলাদেশের উন্নতি লক্ষণীয়।

সাকিব আল হাসান এবং মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে যে রেকর্ডময় জুটি তা এককথায় অসাধারণ; যা শুধুমাত্র আশা গ্রেট খেলোয়াড়দের নিকট থেকে।

তামিম ইকবাল চ্যাম্পিয়নস ট্রফির তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক, যা তামিমের জন্য বড় অর্জন। সাকিব আর মাহমুদুল্লাহ যখন উইকেটে তখন বাংলাদেশ দলের রান ৪ উইকেটে ৩৩; এখান থেকে জয়ের বন্দরে নোঙ্গর করা প্রায় অসম্ভব! ‘পাওয়ার হাউজ’ দলগুলোর সাথে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়লে তুলনামূলক কম শক্তিশালী দলগুলো পরাজিত হয়,অতীতে এর একমাত্র ব্যতিক্রম কেভিন ও’ব্রায়ান এর কল্যানে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আয়ারল্যান্ডের জয়।

সাউদি, বোল্ট, মিলনে, সান্টনার, কোরি অ্যান্ডারসন্ডদের বিপক্ষে ৩৩ রানে ৪ উইকেট হারানোর পরও ১৬ বল হাতে রেখে ২৬৮ রান করে জয় তুলে নেয়া বাংলাদেশের বড় দল হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। বড় দলের তারকা খেলোয়াড়রা যেমন নিজেদের উপর বিশ্বাস রেখে স্কিল প্রদর্শন করে খেলা নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয়, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সাকিব আর মাহমুদুল্লাহ ঠিক এই কাজটিই খুব দৃষ্টিনন্দনভাবে সুসম্পন্ন করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের মাটিতে বাংলাদেশের পারফরমেন্স সাকিব-মাহমুদুল্লাহদের আত্ম-বিশ্বাসী করেছে যার প্রতিফলন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পুরো বিশ্ব দেখেছে।

অন্যদিকে জাভেদ আহমাদির ৮১ রান এবং লেগ স্পিনার রশিদ খানের ইতিহাস গড়া ৮.৪-১-১৮-৭ বোলিং ফিগারের কারনে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৬৩ রানে হারিয়ে চমক লাগিয়েছে আফগানিস্তান। রশিদ খানের ১৮ রানে ৭ উইকেট অবশ্যই বিশাল অর্জন, যা ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে পঞ্চম সেরা বোলিং! ওয়েস্ট ইন্ডিজ এখন আর বড় দল নয়, ওয়ানডেতে অবশ্যই নয়।

সময় পরিবর্তন হচ্ছে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি থেকে ২০১৫ বিশ্বকাপের দুই ফাইনালিস্ট অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের বিদায়! বাংলাদেশের মত ক্রমেই উন্নতশীল দলগুলোর এই অগ্রগতি ক্রিকেট বিশ্বের জন্য আশাব্যঞ্জক। বাংলাদেশের মত দলগুলোর আনন্দ উদযাপন ক্রিকেটের জন্য মন্দ নয়, তাই নয় কি?

প্রথম প্রকাশ: উইজডেন ইন্ডিয়া

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...