ভদ্রলোক জীবনে টেস্ট খেলেছেন মাত্র চারটা। যার সবগুলোই এক সিরিজে! দুটি সেঞ্চুরিসহ ৭২.৫৭ গড়ে রান করেছেন ৫০৮। এত কম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা সত্ত্বেও ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ওপেনারদের ছোট্ট তালিকায় তাঁর নামটা থাকবেই। কেননা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তাঁকে বঞ্চিত করলেও তিনি আলো ছড়িয়েছেন বিভিন্ন দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে। বলছিলাম ‘তর্ক-সাপেক্ষে’ দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান ব্যারি রিচার্ডসের কথা।
চলুন শুরুতেই এই কিংবদন্তির ফার্স্ট ক্লাস রেকর্ডে একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক। ম্যাচ ৩৩৯ টি। রান ২৮,৩৫৮, গড় ৫৪.৭৪। সর্বোচ্চ ৩৫৬ রানের ইনিংস। সেঞ্চুরি ৮০ টি, হাফ সেঞ্চুরি ১৫২ টি। উইকেট ৭৭, ক্যাচ ৩৬৭ টি।
পরিসংখ্যানই বলছে, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তিদের একজন হলেন ব্যারি রিচার্ডস। তাঁর রয়েছে সর্বোচ্চ ১৫ বার এক মৌসুমে হাজারের ওপর রান করার রেকর্ড।
১৯৭০ সালে বর্ণবাদের ভয়াল থাবায় কেঁপে উঠেছিল বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন। যার ফলশ্রুতিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সব রকমের খেলাধুলা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে। এই ঘটনার তিন মাস আগে জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ব্যারির টেস্ট অভিষেক।
কেপটাউনে অভিষেক টেস্টের দুই ইনিংসে তাঁর ব্যাট থেকে রান এসেছিল যথাক্রমে ২৯ ও ৩২। তবে ডারবানে পরের টেস্টেই দারুণ এক সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন তিনি। মাত্র ১৬৪ বলে ১৪০ রানের স্ট্রোক ঝলমলে ইনিংসটা সাজানো ছিল ২০ বাউন্ডারি আর এক ছক্কায়। মধ্যাহ্নভোজনের বিরতিতে যাবার আগে দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর ছিল ১২৬/২। যার ৯৪-ই এসেছিল ব্যারি রিচার্ডসের ব্যাট থেকে!
চতুর্থ উইকেটে পোলক আর রিচার্ডসের গড়া ১০৩ রানের জুটিটাকে বিশ্লেষকগণ খুব হাইলি রেট করে থাকেন। উইজডেনের ভাষায়, ‘Richards and Pollock creamed 103 runs in just an hour after the lunch break. South African fans were treated to some of the best strokeplay ever seen in cricket history.’
প্রোটিয়া অধিনায়ক আলি ব্যাখারের ভাষায়, ‘সম্ভবত এরকম নিখুঁত ব্যাটিং প্রদর্শনী দেখার সৌভাগ্য আর কখনও হবে না দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীর।’
২৭৪ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস খেলে বাঁ-হাতি গ্রায়েম পোলক তাঁকে ছাড়িয়ে গেলেও ব্যারির ইনিংসটির মাহাত্ম্য এতটুকুও কমে যায় নি। ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত ইনিংস ও ১২৯ রানে জিতে নিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। পরের ইনিংসে তাই আর ব্যাটই ধরতে হয়নি তাঁকে।
জোহানেসবার্গে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে ব্যারি রিচার্ডস করেছিলেন যথাক্রমে ৬৫ ও ৩৫ রান। যথারীতি প্রোটিয়ারা জিতেছিল ৩০৭ রানের বিশাল ব্যবধানে।
সেঞ্চুরিয়নে সিরিজের শেষ ম্যাচে ব্যারি রিচার্ডসের ১২৬ ও ৮১ রানের ‘দুটো’ অসাধারণ ইনিংসের সৌজন্যে ৩২৩ রানের আরও একটি বড় জয় তুলে নিয়েছিল স্বাগতিকরা।
সিরিজে তেমন একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে না পারলেও প্রোটিয়া শিবিরে আতঙ্ক ছড়িয়েছিলেন ‘রহস্য স্পিনার’ জন গ্লিসন। যিনি ৩ ম্যাচে নিয়েছিলেন ১৯ উইকেট। গুগলি, ক্যারম বল, লেগব্রেক, অফব্রেকসহ বেশ কয়েক রকমের ভ্যারিয়েশন ছিল তাঁর বলে। গডার্ড, ব্যাখার, পোলক, বার্লোসহ প্রায় সবাইকে নিজের ঘূর্ণিবলে ধরাশায়ী করতে সমর্থ হলেও ব্যারি রিচার্ডসকে একবারও আউট করতে পারেন নি গ্লিসন। বরং ব্যারির মারের চোটে বেশ ক’বার আক্রমণ থেকেই সরিয়ে নিতে হয়েছে তাঁকে!
আলী ব্যাখারের ভাষায়, ‘Barry took one look at him and worked him out, and for the rest of the series he ran down the wicket to Gleeson. The rest of us were still a bit wary – even Graeme Pollock played him from the crease – but Barry went after him.’
নিজেদের মাটিতে আয়োজিত ‘একপেশে’ সিরিজে (৪-০) প্রতিপক্ষের ওপর দিয়ে রীতিমত ‘স্টিম রোলার’ চালিয়েছিল প্রোটিয়ারা। সম্ভবত দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে সেরা দল ছিল এটাই। গ্রায়েম পোলক, মাইক প্রোক্টর, ব্যারি রিচার্ডস, এডি বারলো, আলী ব্যাখার, পিটার পোলক, লি আর্ভাইন, ডেনিস লিন্ডসেদের নিয়ে গড়া দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন দলটির শক্তিমত্তা কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। ইয়ান চ্যাপেল, বিল লরি, ইয়ান রেডপ্যাথ, ডগ ওয়াল্টার্স, গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জি, অ্যাশলি ম্যালেট, জন গ্লিসনদের মত তারকাসমৃদ্ধ অস্ট্রেলিয়াও যাদের সামনে খড়কুটোর মত উড়ে গিয়েছিল।
এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের বিতর্কিত বর্ণবাদ নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল সমগ্র বিশ্ব। যার শাস্তিস্বরূপ দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে ২১ বছরের নিষেধাজ্ঞা জারি করে আইসিসি। ফলে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল গ্রায়েম পোলক, মাইক প্রক্টর, ক্লাইভ রাইস, ব্যারি রিচার্ডসদের মত প্রতিভাবানদের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন।
ব্যারি রিচার্ডস বিখ্যাত ছিলেন তাঁর সহজাত ফ্লেয়ার, এলিগেন্স, বিশুদ্ধ টেকনিক এবং আগ্রাসী স্ট্রোকপ্লের কারণে। সত্তর-আশির দশকের বিখ্যাত ফাস্ট বোলিং গ্রেটদের বিপক্ষেও খেলেছেন দাপটের সাথে। বেশিরভাগ ক্রিকেটবোদ্ধার চোখে তিনি টেকনিক্যালি ইতিহাসের সব চাইতে নিখুঁত ওপেনারদের একজন। স্যার জ্যাক হবস, লেন হাটন কিংবা সুনীল গাভাস্কারের চাইতেও ব্যারি রিচার্ডসকে এগিয়ে রাখেন অনেকে।
বিশিষ্ট ক্রীড়াসাংবাদিক টেলফোর্ড ভাইসের মতে, ‘Barry was technical correctness personified and an epitome of domination over an opponent.’ ধারাভাষ্যকার জন আরলটের ভাষায়, ‘Barry was technically perfect, tall, wristy, implacable, possessed of feline grace and eyesight.’
স্যার ডন ব্র্যাডম্যান তাঁর স্বপ্নের একাদশে ওপেনার হিসেবে প্রথম নামটাই বেছে নিয়েছেন ব্যারি রিচার্ডস। ব্র্যাডম্যানের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছিল সেটি। তাঁকে সর্বকালের সেরা ডানহাতি ওপেনারের স্বীকৃতিটাও ব্র্যাডম্যানেরই দেয়া। প্রখ্যাত আম্পায়ার ডিকি বার্ডের আত্মজীবনীতে উল্লিখিত ‘স্বপ্নের একাদশে’ও এক নম্বর ওপেনার হিসেবে ঠাঁই পেয়েছিলেন ব্যারি রিচার্ডস।
ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ও প্রয়াত ধারাভাষ্যকার টনি গ্রেগের মতে, ‘I consider Barry Richards to be the finest batsman in the world. I am convinced he could have rewritten the record books and rewritten them with a style and grace matched by precious few players in the history of the game.’
ব্যারি রিচার্ডসের জন্ম ১৯৪৫ সালের ২১ জুলাই, ডারবানের নাটাল প্রদেশে। তাঁর ক্রিকেটে আসার পেছনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন দাদু পার্সি রিচার্ডস। ছোট্ট ব্যারিকে প্রতিদিন মাঠে নিয়ে যেতেন তিনি; মাঠের এক কোণায় বসে নাতির খেলা দেখতেন।
তাঁর প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয়েছিল ডারবান প্রিপারেটরি স্কুলের অনুর্ধ্ব-১৩ দলের হয়ে। ইন্টার স্কুল চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম ফিফটিটা হাঁকিয়েছিলেন মাত্র ১০ বছর বয়সে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার স্কুল ক্রিকেটে ব্যাট হাতে ছুটিয়েছেন রানের ফোয়ারা।
১৯৬৪-৬৫ মৌসুমে সফরকারী এমসিসি একাদশের বিপক্ষে সাউথ আফ্রিকান কোল্টস একাদশের হয়ে তাঁর ফার্স্ট ক্লাস অভিষেক, মাত্র ১৯ বছর বয়সে। অভিষেকেই উপহার দিয়েছিলেন ৫৬ বলে ৬৩ রানের দাপুটে এক ইনিংস।
১৯৬৬-৬৭ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকা সফররত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একটা ট্যুর ম্যাচে সেঞ্চুরি (১০৬ বলে ১০৭) করে আলোচনায় উঠে আসেন ২১ বছরের তরুণ ব্যারি রিচার্ডস। জাতীয় দলের স্কোয়াডে ডাকও পেয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেবার ডাক পেয়েও খেলার সুযোগ হয় নি। অবশ্য দ্বাদশ ব্যক্তি হিসেবে একবার ফিল্ডিংয়ে নামার সৌভাগ্য হয়েছিল।
১৯৬৮ সালে কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান ব্যারি। হ্যাম্পশায়ারের হয়ে ৪৮.৯০ গড়ে ৫ সেঞ্চুরিসহ প্রথম মৌসুমেই তাঁর ব্যাট থেকে আসে ২৩৯৫ রান। জিতে নেন ১৯৬৯ সালের উইজডেন বর্ষসেরার পুরস্কার।
১৯৬৮-১৯৭৬ পর্যন্ত সবগুলো কাউন্টি সিজন মিলিয়ে ব্যারি রিচার্ডসের সংগ্রহ ৫১.৫০ গড়ে ১৫ হাজার ৬০৭ রান। তিনবার গড়েছেন ‘ক্যারি দ্য ব্যাট’ অর্থাৎ ইনিংসের আদ্যোপান্ত ব্যাটিংয়ের কীর্তি।
হ্যাম্পশায়ারে খেলার সময় উদ্বোধনী জুটিতে তিনি সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন বয়সে ছয় বছরের ছোট গর্ডন গ্রিনিজকে। অল্প সময়ের মধ্যেই দারুণ এক কেমিস্ট্রি গড়ে উঠেছিল দুজনের মধ্যে। রিচার্ডস-গ্রিনিজ জুটিকে কাউন্টির ইতিহাসে ‘সর্বকালের সেরা’ ওপেনিং জুটির স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন অনেকে।
রবিন জ্যাকম্যানের ভাষায়, ‘Barry Richards and Gordon Greenidge made a formidable opening pair, and it wasn’t often you got an early breakthrough against Hampshire.’
১৯৭০ সালের সেই ‘ঐতিহাসিক’ অস্ট্রেলিয়া সিরিজের পর ব্যারি আমন্ত্রণ পান অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া লিগ শেফিল্ড শিল্ডে খেলার। সেখানে গিয়ে প্রথম মৌসুমেই বাজিমাত করেন তিনি। ১৯৭০-৭১ মৌসুমে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ১০৯.৮৬ গড়ে তাঁর ব্যাট থেকে আসে ১৫৩৮ রান! স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের পর ‘প্রথম’ ব্যাটসম্যান হিসেবে এক মৌসুমে শেফিল্ড শিল্ডের সবগুলো দলের বিপক্ষেই হাঁকিয়েছিলেন সেঞ্চুরি!
ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পার্থের বাউন্সি উইকেটে ৩৫৬ রানের ‘মহাকাব্যিক’ এক ইনিংস খেলে রীতিমত হইচই ফেলে দেন তিনি। কারণ তিনি যে একদিনেই তুলেছিলেন ৩২৫ রান! মাত্র ৩২২ বলে! হাঁকিয়েছিলেন ৪৪টি চার ও ১টি ছক্কা! তাঁর এই ইনিংসের মাহাত্ম্য আরো বহুগুণে বেড়ে যায় যখন শুনবেন বিপক্ষ দলে ছিল গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জি, ডেনিস লিলি, টনি লক, টনি মান, জন ইনভেরারিটির মত দুর্ধর্ষ সব বোলার!
ইনিংসটির বর্ণনা দিতে গিয়ে উইজডেন বলছে, ‘He simply carved up everything that was delivered at him. He played with all the time in the world and the decisive quality of a master craftsman.’
প্রতিপক্ষ সাউথ অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেলের ভাষায়, ‘Scoring 325 runs in a day took cricketing art and domination to it’s most supreme zenith facing bowlers like Lillee and Mackenzie.’
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ডানহাতি পেসার গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জি এক সাক্ষাতকারে সেদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন এভাবে, ‘আমার প্রথম বলেই ব্যারি পরাস্ত হওয়ার পর ভেবেছিলাম দারুণ একটি দিন কাটাতে চলেছি। কিন্তু তখনো বুঝতে পারিনি যে, ওটাই হতে চলেছে ব্যারিকে পরাস্ত করা দিনের প্রথম ও শেষ বল। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, ও আমার একটা বলও মিস করে নি সেদিন! আপনি যদি বোলার হতেন তবে সেদিনের পর আর কখনো ওর সামনে বোলিং করতে চাইতেন না।’
ডেনিস লিলির ভাষায়, ‘অবিশ্বাস্য ইনিংস! সত্যি বলতে নিজেকে সেদিন এতটাই অসহায় লাগছিল যে বল ফেলার জায়গাটা পর্যন্ত খুঁজে পাচ্ছিলাম না।’
উল্লেখ্য, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে এক দিনে তিন শতাধিক রান করা মাত্র পঞ্চম ক্রিকেটার হলেন ব্যারি রিচার্ডস। ১৯৩০ সালে সর্বপ্রথম এই কীর্তি গড়েছিলেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান।
ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্যারি রিচার্ডস ঠিক কতটা বিধ্বংসী ছিলেন সেটা বোঝানোর জন্য একটা পরিসংখ্যান দিচ্ছি। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তিনি লাঞ্চের আগেই সেঞ্চুরি পূরণ করেছেন ৯ বার!
সাবেক পেসার ও জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার রবিন জ্যাকম্যান তো প্রায়ই বলতেন, ‘ও মাঝেমধ্যে এমন নির্দয়ভাবে পেটাত, যে কোন রকমে একটা মেডেন নিতে পারলেই মনে হত বিশাল অর্জন।’ অথচ ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে ব্যারি রিচার্ডসকে সবচেয়ে বেশি ১৬ বার আউট করা বোলার হলেন এই জ্যাকম্যান। সেই তিনিই একথা বলছেন!
১৯৭১ সালে শেফিল্ড শিল্ডে মাত্র এক মৌসুম খেলেই ব্যারি রিচার্ডস ফিরে আসেন জন্মভূমি ডারবানে। ইংল্যান্ডে কাউন্টি ক্রিকেট খেলার ফাঁকে তিনি অংশ নেন কুরি কাপে। নাটাল প্রভিন্সের হয়ে খেলেন টানা চার মৌসুম। এই চার মৌসুমে তাঁর সংগ্রহ ছিল যথাক্রমে-
- ১৯৭১-৭২ মৌসুমে ১৩৬.১২ গড়ে ১০৮৯ রান
- ১৯৭২-৭৩ মৌসুমে ১৩৩ গড়ে ১০৬৪ রান
- ১৯৭৩-৭৪ মৌসুমে ১২৮.২৮ গড়ে ৮৯৮ রান
- ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে ১২৪ গড়ে ৮৬৮ রান
উল্লেখ্য, সাউথ আফ্রিকার ঘরোয়া টুর্নামেন্ট কুরি কাপের এক মৌসুমে ১০০০ রান করা একমাত্র ক্রিকেটার হলেন ব্যারি রিচার্ডস! সেই রেকর্ড আজও কেউ ভাঙতে পারে নি।
ব্যারি রিচার্ডস বাজিমাত করেছিলেন ১৯৭৮-৭৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত কেরি প্যাকার ওয়ার্ল্ড সিরিজেও। তিন জাতি ‘সুপার টেস্ট’ সিরিজে বিশ্ব একাদশের হয়ে আসর মাতিয়েছিলেন তিনি। ব্যাট হাতে দেখিয়েছিলেন অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা। ৮ ইনিংস খেলে ৭৯.১৪ গড়ে করেছিলেন ৫৫৪ রান। দুটি শতকের পাশাপাশি হাঁকিয়েছিলেন দু’টি হাফ সেঞ্চুরি।
বিশ্ব একাদশ নামে অংশ নেয়া দলটিতে ছিল তারকার ছড়াছড়ি। ব্যারি রিচার্ডস ছাড়াও সেখানে ছিলেন টনি গ্রেগ, ইমরান খান, রিচার্ড হ্যাডলি, মাইক প্রক্টর, এডি বারলো, ক্লাইভ রাইস, জাভেদ মিয়াঁদাদ, জহির আব্বাস, মাজিদ খান, ডেরেক আন্ডারউড, অ্যালান নটদের মত তারকা ক্রিকেটার।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ‘সুপার টেস্ট’ সিরিজের ফাইনালটা ছিল লো-স্কোরিং অথচ তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। ফোর্থ ইনিংসে বিশ্ব একাদশের সামনে জয়ের লক্ষ্য ছিল ২২৪ রান। মাত্র ৮৪ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলা দলটিকে শেষ পর্যন্ত ৩ উইকেটের শ্বাসরূদ্ধকর এক জয় উপহার দেন ব্যারি রিচার্ডস। লিলি-থমসন-গিলমোরদের পিটিয়ে খেলেন অপরাজিত ১০১ রানের অনবদ্য ইনিংস। দুই ইনিংস মিলিয়ে বিশ্ব একাদশের আর কোন ব্যাটসম্যান একটা ফিফটি পর্যন্ত হাঁকাতে পারেন নি।
বিপক্ষ দলে মাইকেল হোল্ডিং, অ্যান্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, ডেনিস লিলি, জেফ থমসনের মত ভয়ঙ্কর সব ফাস্ট বোলার থাকা সত্ত্বেও ওয়ার্ল্ড সিরিজে ব্যারি রিচার্ডস রান তুলেছেন প্রায় গড়ে ৮০ ! ব্যাটিং গড়ের দিক দিয়ে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে ছিলেন গ্রেগ চ্যাপেল (৫৬.৬০) এবং ভিভ রিচার্ডস (৫৫.৬৯)।
প্রখ্যাত ক্রীড়াসাংবাদিক গিডিওন হেইয়ের মতে, ‘Viv was generally a more destructive batsman, but on that occasion, Barry outshone him.’
ওয়ানডে ক্রিকেটের জন্মের পূর্বেই থেমে গিয়েছিল ব্যারি রিচার্ডসের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। তবে ওয়ানডে না খেললেও ঘরোয়া সীমিত ওভারের ক্রিকেটে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছেন অসংখ্যবার। ১৬টি সেঞ্চুরিসহ তাঁর রয়েছে সাড়ে আট হাজারের ওপর লিস্ট-এ রান।
একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ১৯৭০ সালে একটি সীমিত ওভারের ম্যাচ বৃষ্টির কারণে নেমে এসেছিল ৪০ ওভারে। ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে হ্যাম্পশায়ারের দলীয় স্কোর ছিল ২১৫ রান; যার ১৫৫-ই এসেছিল ব্যারি রিচার্ডসের ব্যাট থেকে! জবাবে পুরো ৪০ ওভার ব্যাট করেও ব্যারি রিচার্ডসের একার রানই করতে পারে নি ইয়র্কশায়ার; নয় উইকেটে করেছিল মাত্র ৭৪ রান! সত্যিকারের ‘ওয়ান ম্যান শো’ বুঝি একেই বলে!
১৯৮৪ সালে অবসরের পর তিনি বেশ কিছুদিন কাজ করেছেন ব্যাটিং কোচ হিসেবে। এছাড়া রেডিও এবং টিভিতে ধারাভাষ্যকার ও বিশ্লেষকের দায়িত্ব পালন করেও বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। ১৯৯৯ সালে গ্রায়েম পোলকের সাথে তিনি যৌথভাবে পেয়েছেন বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটারের স্বীকৃতি। ২০০৯ সালে আইসিসি ক্রিকেট ‘হল অব ফেমের’ সদস্যভুক্ত করা হয় তাঁকে।
ব্যারি রিচার্ডসের জীবনে সবচেয়ে বড় আক্ষেপ তাঁর অসম্পূর্ণ টেস্ট ক্যারিয়ার। ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের বন্যা বইয়ে দিলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের উত্তাপটা ভীষণ মিস করতেন তিনি। কে জানত, টেস্ট ক্যারিয়ারটা পূর্ণতা পেলে হয়ত তিনি হতে পারতেন সর্বকালের সেরা পাঁচ কিংবা দশ ব্যাটসম্যানের একজন! কিন্তু নিজেকে প্রমাণের সেই সুযোগটাই পান নি তিনি। ক্রিকেটে তাঁর মত হতভাগ্য খেলোয়াড় আর ক’জনই বা আছে বলুন?
শেষ করব রবিন জ্যাকম্যানের একটি উক্তি দিয়ে, ‘When you’re that much talented you want the world to see it, not a few guys watching at Southampton.’