কোহলি–আগারকার ও গম্ভীরের ত্রিমুখী সংঘাতে

যখন ব্যক্তিগত ইগো সামনে চলে আসে, দলগত দৃষ্টিভঙ্গি হারিয়ে যায়। এখন জরুরী বিষয়—বোর্ডের শীর্ষ কর্তাদের হস্তক্ষেপ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনলে ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য এর মূল্য দিতে হবে আরও অনেক বেশি।

ভারতীয় ক্রিকেটের এই সময়টা মোটেও সুখকর নয়। ঘরের মাঠের গৌরবময় রেকর্ড ভেঙে গেছে টেস্টে, অন্দরমহলে কানাঘুষো আর অবিশ্বাস বাড়ছে। ঠিক এমন এক অস্থিরতার রাতে, রাঁচিতে দুর্দান্ত শতরান করে যেন নিজের মতো করেই জবাব দিলেন বিরাট কোহলি—তাঁদের উদ্দেশ্যে, যারা বলেছেন সিনিয়রদের নিয়মিত জাতীয় দলে থাকতে হলে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতেই হবে।

আর এই সিনিয়র মূলত দু’জন, রোহিত শর্মা আর কোহলি—যারা এখন শুধু ওয়ানডে খেলেন। রোহিত নিয়ম মানলেও, লন্ডনে বসবাস করা কোহলি এখনও তাতে সাড়া দেননি। বরং রাঁচির সেই জ্বলে ওঠা রাতেই বললেন, ‘আমি কখনোই অতিরিক্ত প্রস্তুতির ভক্ত নই।’

বোর্ডের নির্দেশ বনাম দেশের সমসাময়িক সবচেয়ে বড় ক্রিকেট তারকা—ভারতীয় ক্রিকেটে লড়াই যেন এখন প্রকাশ্যে। এই নাটকের তিন কেন্দ্রীয় চরিত্র—কোহলি, প্রধান নির্বাচক অজিত আগারকর এবং কোচ গৌতম গম্ভীর।

বছরের পর বছর ধরে বিরাট কোহলির পরিচিত চরিত্র—তিনি সবসময়ই কোনো না কোনো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখেন। তাঁর সমর্থকরাও বলেন, ‘বিরাট চুপ করিয়ে দিতে জানেন সবাইকে।’

যেমন বলেছিলেন রবি শাস্ত্রী, ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে কোহলির সেই অবিশ্বাস্য ৮২ রানের ইনিংসের পর—যখন তিনি অধিনায়কত্ব হারানোর নানা ধাক্কায় বিব্রত ছিলেন। টি-টোয়েন্টির দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পর হারান ওয়ানডে নেতৃত্ব, তারপর ছেড়ে দেন টেস্ট অধিনায়কত্ব—সবটাই ঘটছিল সৌরভ গাঙ্গুলির সভাপতিত্বে। সেই সব দু:সময়ের মতোই, রাঁচির ইনিংসও যেন বোর্ডের কোর্টে বল ফিরিয়ে দিল।

বোর্ড চেয়েছিল—ওয়ানডের মাঝের বিরতিগুলোতে ফিট ও ধারাবাহিক থাকতে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলুন। বিশেষ কিছু দাবি নয় মনে হলেও, কোহলি হয়তো এটাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখেন না। তাঁর চোখে এটা যেন আরেকটা চেষ্টা—তাকে কোণঠাসা করার।

তাঁর ‘অভিযোগের খাতা’ জমেই চলেছে—টি-টোয়েন্টি নেতৃত্ব ছাড়ার পর ওয়ানডে নেতৃত্ব কেড়ে নেওয়া, টেস্ট অধিনায়কত্ব ছাড়ার প্রেক্ষাপট, তারপর টেস্ট ক্রিকেটকেও বিদায়। কখনো কোচ অনিল কুম্বলের সঙ্গে টানাপোড়েন, কখনো গাঙ্গুলির সঙ্গে ভুল-বোঝাবুঝি। এখন সেই জায়গাটি নিয়েছেন আগারকার আর গম্ভীর।

আগারকারের অবস্থাটাও সহজ ছিল না। রোহিত-কোহলিকে রেখেও ঘরের মাঠে লজ্জাজনক পরাজয়, বাইরে তো আরও বাজে। রোহিতের টেস্ট ব্যাটিং ধসের মধ্যে তিনি নিজেই একসময় সিডনিতে খেলেননি। কোহলির টেস্ট ব্যর্থতা চলছে অনেকদিন ধরে—স্পিন হোক, বা অফস্টাম্পের বাইরে চ্যানেলে পেস বোলিং—কোথাওই কোনো সমাধান নেই।

টি-টোয়েন্টিতে নতুন যুগ শুরু হওয়া স্বাভাবিকই ছিল বিশ্বকাপজয়ের পর। টেস্টেও ফল না আসায় সময় এসেছে নতুনদের জায়গা দেওয়ার। রোহিত সরছিলেন না, তাই আগারকারের নেতৃত্বাধীন নির্বাচকরা তাঁকে নরমভাবে সরে যেতে ইঙ্গিত দেন। এরপর কোহলিও টেস্ট ছাড়েন।

এই অস্থির সময়টাকে সামলানো আগারকারের জন্য সবচেয়ে কঠিন ছিল। তাঁকে নায়ক হতে হবে এমন নয়, কিন্তু অপরিহার্য ডার্টি ওয়ার্ক সামলানোর দায়িত্ব তো তাঁরই। যদিও রোহিতের ওয়ানডে অধিনায়কত্বের সময়ে হয়তো আরও একটু ধৈর্য দেখানো যেত—গিল তখনও শেখার পর্যায়ে ছিলেন, রোহিতের কাছ থেকে নেতৃত্ব শেখার সুযোগ পেলে হয়তো পরিস্থিতি আরও মসৃণ হতো।

ঘরোয়া ক্রিকেট খেলাকে বাধ্যতামূলক করা হয়তো অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নয়। বিশ্বকাপ এখনও দুই বছর দূরে—ফর্ম ধরে রাখতে ভিজয় হাজারে খেলা মোটেও খারাপ ভাবনা নয়। কিন্তু, বিষয়টি যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা এখন একেবারে সংঘাতে পরিণত হয়েছে।

গম্ভীরও এই ঝড়ের ভেতর দিশেহারা। দক্ষিণ আফ্রিকার সিরিজে দলে অতিরিক্ত পরিবর্তন, কলকাতার উইকেট বিষয়ক আলোচনা—সব মিলিয়ে ০-২ হারের পর তাঁর অবস্থান দুর্বল হয়েছে। কোহলি-রোহিতের ওয়ানডে সাফল্য এখন তাঁর বিপরীতে ব্যবহৃত হচ্ছে, টেস্ট ব্যর্থতা ভুলে যাওয়া হয়েছে।

জনমতের চশমায় আঁকা চিত্র আরও জটিল—কোহলির সঙ্গে গম্ভীরের পুরনো অস্বস্তির ইতিহাস, ধোনির সঙ্গেও সম্পর্কের তিক্ততা, আর তার সঙ্গে গম্ভীরের একরোখা ব্যক্তিত্ব মিলিয়ে এই নাটককে আরও উত্তপ্ত করেছে। অন্যদিকে কোহলির নিজেকে বিশ্ববিপ্লবী যোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মানসিকতা যেন গল্পটায় আরও আগুন ঢালে।

শেষমেশ ক্ষতিটা হচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেটেরই। বোর্ড যদি হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদলায়, তাহলে কি বার্তা যাবে—কোহলি জিতলেন, আগারকার-গম্ভীর হারলেন? আর যদি কোনো সমাধান না আসে? কোহলি কি তবে সরে যাবেন?

প্রশ্ন হল, দলে এর প্রভাব কী? নিশ্চয়ই নেতিবাচক। এমন পরিবেশে তরুণরা বেড়ে ওঠে না। যখন ব্যক্তিগত ইগো সামনে চলে আসে, দলগত দৃষ্টিভঙ্গি হারিয়ে যায়। এখন জরুরী বিষয়—বোর্ডের শীর্ষ কর্তাদের হস্তক্ষেপ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনলে ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য এর মূল্য দিতে হবে আরও অনেক বেশি।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Share via
Copy link