পেস-বাউন্স এবং আমাদের টপ অর্ডার

নিউজিল্যান্ডের সাথে প্রথম ওয়ানডেতে বাংলাদেশের টপ অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যান- তামিম ইকবাল, লিটন দাস আর সৌম্য সরকার করেছেন যথাক্রমে ১৩, ১৯ আর ০!

টপ অর্ডার ভাল করেনি; বাংলাদেশও আর ম্যাচ জেতেনি কিন্তু মজার ব্যাপার হল এই দৃশ্য নতুন হয়নি। উপমহাদেশের কথা ছেড়ে দিলাম,  সেখানে এই তিনজনের বেশ কিছু ভাল ইনিংস আছে। উপমহাদেশের বাইরে আরব আমিরাতেও  একেবারে খারাপ করেন এরা এমন নয়। কিন্তু যদি কন্ডিশন হয় বাউন্সি আর সুইংয়িং- টপ অর্ডারের এই তিনজন যেন খেলতেই পারেন না। আলোচনার সুবিধার্থে আমরা এ ধরণের কন্ডিশনের জন্যে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা আর নিউজিল্যান্ডকে বেছে নেব।  সময়ের হিসাবে পরিসংখ্যান দিতে আমরা শুরু করব ১লা জানুয়ারি ২০১৫ থেকে।

  • তামিম ইকবাল

এই দেশগুলোর মাঠে ওয়ানডেতে তামিম মাঠে নেমেছেন ২৬ ম্যাচে। এই ২৬ ম্যাচে তামিম করেছেন ৩১.৬২ গড়ে ৮৫৪ রান; যার মধ্যে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে করা ইংল্যান্ডের সাথে সেই সেঞ্চুরিটাও আছে। এই সেঞ্চুরিটা বাদ দিলে তামিমের বাকি ২৫ ম্যাচের রান দাঁড়াবে ৭২৬।

তামিম বাউন্সি পিচে খেলতে পারেন কিনা সে জবাব জানতে আমরা যদি এ দেশগুলোতে আলাদাভাবে তামিমের পারফরম্যান্স বিবেচনা করি তাহলেও একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায়। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে  তামিমের ব্যাটিং গড় ২৫.৭০। নিউজিল্যান্ডের সাথে যেটা ৮ ম্যাচ খেলার পর ১৮। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রে যেটা কিনা ২৩। ইংল্যান্ডের মাটিতে অবশ্য ব্যাটিং গড়টা বেশ ভাল চিত্র দিচ্ছে কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সেটা আবার ১১.৫০!

এবার যদি এসব দেশের মাটিতে স্বাগতিক ছাড়া যেকোন প্রতিপক্ষ বিবেচনা করি তাহলে তামিমের ব্যাটিং গড় নিউজিল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে যথাক্রমে ১৭ আর ১৯। অস্ট্রেলিয়ার সাথে ২ ম্যাচ খেলে এক ম্যাচে ৯৫ করার সুবাদে সেটা অবশ্য ভালর দিকেই আছে।

  • লিটন দাস

লিটন দাসের ওয়ানডে ক্যারিয়ার শুরু হয়েছে অনেকদিন। ওয়ানডে দলে তিনি থিতুও হয়েছেন অনেকদিন। তা হলেও এই বাউন্সি কন্ডিশনের চার দেশে তিনি ওয়ানডে খেলেছেন সাকল্যে ১২টা। এই ১২ ওয়ানডেতে লিটন দাস রান করেছেন ২২.১৬ গড়ে ২৬৬।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ৯৪ রানের ইনিংসটা বাদ দিলে যেটা কিনা দাঁড়াচ্ছে ১১ ম্যাচে ১৭২। যেহেতু ৯৪ রানের ইনিংসটাতে তিনি অপরাজিত ছিলেন, তাই সেটা বাদ দিলে লিটনের ব্যাটিং গড়ের যে তথৈবচ অবস্থা হবে সেটা গুনে আর লিটনকে লজ্জা দিলাম না।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচাইতে সলিড ব্যাটসম্যানের গড় তো ২৩-ও ছুঁতে পারেনি, যদি দেশ হিসেবে আলাদাভাবে চিন্তা করি তবে সেটা নিউজিল্যান্ডে ৯ ও ছুঁতে পারবে না। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে এখন অব্দি ৪ ওয়ানডে খেলে লিটনের ব্যাটিং গড় ৮.২০! দক্ষিণ আফ্রিকা আর ইংল্যান্ডে যেটা ১৩.৬৬ আর ৪৬। ইংল্যান্ডের মাটিতে এই গড়ের কারণ অবশ্য উনিশ বিশ্বকাপ আর ঐ অপরাজিত ৯৪ রানের ইনিংস। সে হিসেবে তাই এই গড় নিয়ে খুব বেশি সুখানুভূতি পাওয়ার কোন কারণ নেই।

আরেকটা মজার তথ্য দিয়ে শেষ করি, এসব দেশে খেলা ওয়ানডেতে পাকিস্তান (৩২) ছাড়া আর কোন দলের সাথেই লিটনের ব্যাটিং গড় ২৩ ছাড়ায়নি। উইন্ডিজের সাথে এক ম্যাচ খেলে সেই ম্যাচেই অপরাজিত ছিলেন বলে সেটা গড়ের হিসাবে আসছে না।

  • সৌম্য সরকার

কন্ডিশন পেস আর বাউন্সি হলে সবার আগে আসে সৌম্য সরকারে নাম। একেবারে অভিষেকের শুরু থেকে শোনা যায় এসব কন্ডিশনেই নাকি সৌম্য ভাল খেলেন। সেই ‘ভাল খেলা’ সৌম্য ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা আর নিউজিল্যান্ডে খেলেছেন মোট ২৪ ম্যাচ, এই ২৪ ম্যাচে সৌম্য সরকার ৪৩৬ রান করেছেন মাত্র ১৭.৪৪ ব্যাটিং গড়ে!

একজন ব্যাটসম্যানের যখন এসব দেশে সব মিলিয়ে ব্যাটিং গড় ১৭.৪৪ হয়, তাকে নিয়ে আসলে আলাদা আলাদা প্রতিপক্ষ ধরে আলোচনা করাটা বোকামি। কিন্তু একই ধরণের আলোচনা যেহেতু লিটন আর তামিমের ক্ষেত্রে করা হয়েছে, সৌম্যের ক্ষেত্রে তাই ‘ন্যায় বিচার’ না দেওয়া ঠিক হবেনা। আলোচনা করা যাক।

অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিন আফ্রিকা আর নিউজিল্যান্ডে সৌম্য সরকারের ব্যাটিং গড় যথাক্রমে ৩০.৫০, ১৬.৬৬, ৮ আর ১৩.২৫। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়াতে গড়টা একটু ভাল হওয়ার কারণ ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে তিনি তিন নম্বরে নেমে সেখানে নিয়মিতভাবেই ৩০ এর আশেপাশে কিছু ইনিংস খেলতেন। সেটাকে তাই এই হিসাবে খুব বেশি ধর্তব্যে ধরা যায়না। কিন্তু আমরা যেহেতু আজকের সব পরিসংখ্যান ১লা জানুয়ারি, ২০১৫ থেকে খোঁজার চেষ্টা করেছি, সৌম্যের ক্ষেত্রে তাই ২০১৫ বিশ্বকাপটা আনতেই হল।

পেস আর বাউন্সি কন্ডিশনে ‘পেস বল ভাল খেলা’ সৌম্য পেসারদের দেশের সাথে কেমন করেছেন সেটাও একটু জেনে নেয়া যাক এবার। এসব দেশে সৌম্যর ব্যাটিং গড় অস্ট্রেলিয়ার সাথে ৬.৫০, ইংল্যান্ডের সাথে ২৩.৩৩, নিউজিল্যান্ডের সাথে ১৪.৬৬, দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে ২৫ আর স্কটল্যান্ডের সাথে ২!

তামিম ইকবাল দেশের ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান, লিটন দাসের দেশের সবচাইতে টেকনিক্যালি সলিড ব্যাটসম্যান আর সৌম্য সরকার সবচাইতে ভাল পারেন পেস খেলতে। এই নানা রকমের বিশেষণধারীরা যদি দেশের বাইরে গিয়ে সেই বিশেষণের প্রতি ন্যূনতম সম্মান না দেখাতে পারেন তাহলে তাদের নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। দেশের সেরা ব্যাটসম্যান সুইং সামলাতে পারবেন না, টেকনিক্যালি সলিড ব্যাটসম্যান কন্ডিশন পাল্টালে আর ব্যাট চালাতে পারবেন না আর পেস বল ভাল খেলা কেউ পেস বল চোখেই দেখতে পারবেন না।

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link