জার্মান মেশিনের দায়িত্ব নিচ্ছেন কে?

১৭ বছর জার্মানি দলের কোচ হিসেবে ছিলেন জোয়াকিম লো। এবারের ইউরো শেষেই দল ছাড়ছেন তিনি। এরপর জার্মান দলের কোচ হবেন কে? এ নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। আসুন সেই স্রোতে গা ভাসানো যাক, কে নিচ্ছে জার্মান রোবটদের দায়িত্ব?

গ্যারি লিনেকার একবার বলেছিলেন, ‘ফুটবল খুবই সোজা একটা খেলা। ২২ জনে মিলে ৯০ মিনিট একটা বলের পেছনে দৌড়ায়, আর দিনশেষে জিতে জার্মানি’।

লিনেকারের কথাটা খুব একটা ভুল ছিল না। ফুটবল বিশ্বে জার্মানদের মতন দৌরাত্ম দেখাতে পেরেছে খুব কম দলই। আর গত এক দশক ধরে তো জার্মান মেশিনের সামনে দাঁড়ানোর সামর্থ্যই ছিল না কারো। প্রায় দুই দশক বিশ্বকাপহীন থাকার পর অবশেষে ২০১৪ সালে নিজের পরম আরাধ্য কাপটি নিজেদের করে নেয় তারা। আর সেটা সম্ভব হয়েছিল জোয়াকিম লোর জন্যই।

কী করেননি লো? হুট করে জার্মানি দলের দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাওয়া জার্গেন ক্লিন্সম্যানের উত্তরসূরি হয়েছিলেন তিনি। খেলোয়াড় হিসেবে জার্মানির জার্সি কোনোদিন গায়ে জড়াতে পারেননি। এমনকি কোচ হিসেবেও ছিলেন না হাই প্রোফাইল, কিন্তু কিছু একটা দেখে ক্লিন্সম্যান তাকে নিয়েছিলেন নিজের ছায়াতলে। এরপর এঁকে এঁকে কেটে গিয়েছে ১৭ বছর; ৩ বিশ্বকাপ, ৪ ইউরো (২০২১ ইউরো ধরে) জার্মান দলের কোচিং হটসিটে ছিলেন একজনই। ৫০০০+ দিন কাটিয়েছেন এই হটসিটে। কিন্তু একদিন না একদিন তো এই পদ থেকে তাকে সরতেই হতো, এমনিতেও জার্মান দলের অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। তাই কন্ট্রাক্টের ১ বছর থাকতেই ইউরো শেষে পদত্যাগ করেন জোয়াকিম লো।

১৭ বছর জার্মানির কোচ হিসেবে থাকা লোর উত্তরসূরি কে হবে? জল্পনা-কল্পনা জার্মান মিডিয়ায়। আসুক দেখে নেওয়া যাক কারা আছেন এই তালিকার উপরে।

  • হ্যান্সি ফ্লিক

স্বভাবতই হ্যান্সি ফ্লিকের নাম সবার উপরে থাকবে। জার্গেন ক্লিন্সম্যানের হাত ধরে জার্মানি দলের সহকারী কোচ হয়েছিলেন জোয়াকিম লো। আর লোর হাত ধরেই জার্মানির সহকারী কোচ হয়েছিলেন ফ্লিক। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে লুভের সহকারী ছিলেন ফ্লিক। এরপর স্পোর্টিং ডিরেক্টর হিসেবেও দুই বছর কাজ করা শেষে ২০১৭ সালে যোগ দেন বায়ার্ন দলে ফার্স্ট হ্যান্ড এক্সপেরিয়ান্সের জন্য। আর সেটাই কাজে এসেছে গত মৌসুমে। বায়ার্ন দলকে নিয়ে অসম্ভব সম্ভব করেছেন ফ্লিক। হারের বৃত্তে ঘুরতে থাকা একটা দলকে নিয়ে জিতেছেন ট্রেবল। ফুটবল ইতিহাসে দ্বিতীয় ক্লাব হিসেবে দুইবার ট্রেবল জেতার রেকর্ডে বার্সার সহযোগী বায়ার্ন।

তবে এই ৫৬-বছর বয়সী কোচকে জার্মানিতে আনতে বেশ ভালোই কাঠখড় পোড়াতে হবে জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে। প্রথমত সহকারী কোচ থাকাকালীন সময়ে একবার দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন বোর্ডের সাথে। যদিও সে অনেক পুরোনো কথা। কিন্তু বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দাড়িয়েছে তার বর্তমান জব। বায়ার্নের সাথে বড় চুক্তি করেছেন ফ্লিক। জার্মানির কোচ হিসেবে তাকে পাওয়ার সম্ভাবনা তাই খুবই ক্ষীণ।

  • রালফ রাংনিক

কয়েক বছর আগে আরবি লাইপজিগের নাম শুনেছেন? না, যে ক্লাবের জন্মই হয়েছে ২০০৯ সালে সেই দলের হুট করেই ফার্স্ট ডিভিশনে আসা চমকই বটে। তবে সেই চমকের পেছনে যে লোকটার অবদান তার নাম রালফ রাংনিক। ৬২ বছর বয়সী এই জার্মান শুরু থেকেই ছিলেন আরবি লাইপজিগের ডিরেক্টর অফ ফুটবল।

লোথার ম্যাথিউসের মতে রালফই হবেন লুভের যোগ্য উত্তরসূরি। জার্গেন ক্লিন্সম্যানের সহকারী হওয়ার দৌড়ে লোর কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন রালফ। এরপর থেকে জার্মানির চাকুরিটা তার কাছে অনেক বড়। আশির দশকের মাঝমাঝি থেকে কোচিং করানো রালফ অবশ্য অনেকদিন ধরেই কোচিং করাচ্ছেন না। ক্রনিক ফ্যাটিগ সিন্ড্রমের কারণে কোচ হিসেবে লিগে ডাগ-আউটে দাঁড়ান না তিনি। বরং ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন লাইপজিগে। বর্তমান জার্মানির জন্য ঠিক যা যা প্রয়োজন তা করতে সিদ্ধহস্ত রালফ। তরুণ তারকা বের করে এনে দলে স্ট্যাবলিশ করে দেখিয়েছেন যেখানেই কাজ করেছেন।

এ বছর তাকে ম্যানেজার হিসেবে চেয়েছিল তার পুরোনো ক্লাব শালকে। এমনিতে তাদের অবস্থা সূচণীয়। গত দুই বছরে হাতে গুনে ম্যাচ জিতেছে দুইটি। কিন্তু জার্মানি চাকরির জন্য এখনও তা ঝুলিয়ে রেখেছেন রালফ। বলা বাহুল্য চাকরিটা পেলে তার মতো আনন্দিত খুব কম লোকই হবে। জার্মান দলের কোচ হওয়ার জন্য তার ১৭ বছরের প্রতীক্ষার অবসান হবে অবশেষে।

রালফের সামনে বাঁধা বলতে একমাত্র অলিভিয়ার বিয়েরহফ। জার্মান ফুটবল ডিরেক্টরের সঙ্গে অনেকদিন ধরেই শীতল সম্পর্ক তার। এ কারণে হাতের কাছে থেকেও ডাগ-আউটে বসার সুযোগ হারাতে হতে পারে তাকে।

  • জুলিয়ান নাগেলসম্যান

এই বয়সে লিওনেল মেসি, করিম বেনজেমা সমানতালে লড়াই করছেন লা লিগার সেরা গোলদাতা হওয়ার জন্য। লেফট উইং দিয়ে আগুনঝড়া রান নিচ্ছেন ডি মারিয়া। আর সে বয়সে কিনা নাগেলসম্যান সামলাচ্ছেন তার থেকেও বয়সে বড় খেলোয়াড়দের। মাত্র ২৮ বছর বয়সে কোচিংয়ে হাতেখড়ি হয় নাগেলসম্যানের। কার্টিলেজ ইঞ্জুরির কারণে মাত্র ২১ বছর বয়সেই ফুটবল ক্যারিয়ারের ইতি টানতে হয় নাগেলসম্যানকে। কিন্তু ফুটবলের নেশা তাকে ছাড়েনি, তাই সে সময় দলের কোচ থমাস টুখেলের কাছ থেকে টুকটাক ম্যানেজারিং শিখতে থাকেন তিনি।

এরপর ২০১০ সালে এসে হফেনহেইম ইয়ুথ টিমের দায়িত্ব পান তিনি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১৫ সালে এসে মাত্র ২৮ বছর বয়সে প্রথম মূল দলের দায়িত্ব পান তিনি। আর তাতেই বদলে দেন হফেনহেইমের চিত্র। ২০১৯ সালে এসে আরবি লাইপজিগের দায়িত্ব নেন নাগেলসম্যান। যদিও ২০২৩ সালে পর্যন্ত তার সাথে কন্ট্রাক্ট আছে, সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন কয়েকদিন আগে। যদিও সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

  • ইয়ুর্গেন ক্লপ

জার্মানি সমর্থকেরা যদি কাউকে কোচ হতে দেখার জন্য উন্মুইখ হয়ে বসে থাকে, তবে সেটা অবশ্যই ইয়ুর্গেন ক্লপ। দুজনের মিলটাও হয়েছিল ভালোমতোই। ক্লপের কন্ট্রাক্ট শেষ হবে ২০২২-এ, ইওয়াখিম লুভও বিদায় বলবেন ২০২২-এ। এমন ঠিক সময়ে ঠিক লোকটাকে হাতের কাছে পাওয়া বেশ ভাগ্যের ব্যাপারও বটে। কিন্তু লিভারপুলকে সর্বজয়ী করা ক্লপকে কেনই বা ছাড়বে অল রেডরা? তাই তো চুক্তি বাড়িয়ে নিয়েছে ২০২৪ পর্যন্ত। আর লোও একবছর আগেই বাজাচ্ছেন বিদায় ঘন্টা। ফলে ক্লপের এই মূহুর্তে কোচ হয়ে আসাটা বেশ চাপে পরে গিয়েছে।

ক্লপও অবশ্য সেই ইঙ্গিতই দিয়েছেন। ‘আপনার হাতে যখন তিন বছরের কন্ট্রাক্ট থাকে, তখন আপনি সামান্য হলেও সেটাকে একটু সম্মান দিবেন, তাই না?” ক্লপ লিভারপুলের জবটাকেই এগিয়ে রাখছেন জার্মান দলের থেকে। বর্তমানে অতল সাগরে হাবুডুবু খাওয়া লিভারপুলকে এই অবস্থায় যে ক্লপ ছাড়বেন না, তা বোঝা যাচ্ছে ভালোমতোই।

  • স্টেফান কুনস

সবদিক মিলিয়ে একেবারে পারফেক্ট পর্যায়ে যদি কেউ থাকে জার্মান দলের দায়িত্ব নেওয়ার, তিনি হলেন স্টেফান কুনস। ৫৮-বছর বয়সী জার্মান বর্তমানে জার্মানি অনুর্ধ্ব-২১ দলের কোচ।

খেলোয়াড়ি জীবনে ছিলেন জার্মান দলের মধ্যমনি। স্ট্রাইকার হিসেবেও ছিলেন বেশ লিথাল। ১৯৯৬ ইউরোজয়ী জার্মান দলের সদস্যও ছিলেন কুনস। ২০১৬ সালে তাকে পাকাপাকিভাবে জার্মানি অনুর্ধ্ব-২১ দলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব পেয়েই আপাদমস্তক পাল্টয়ে ফেলতে শুরু করেন দলকে। ২০১৭ সালে জেতান অনুর্ধ্ব-২১ বিশ্বকাপ। গত পাঁচ বছর ধরে অনুর্ধ্ব-২১ দলের কোচ তিনি। বর্তমান কোচ লুভ আর জার্মান বোর্ডের সুনজরেও আছেন তিনি। জার্মান দলের অনুর্ধ্ব দল থেকে কোচ আনার ইতিহাস প্রচুর। সে হিসেবে এই দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে তিনি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...