বিচিত্র উদযাপনের বিচক্ষণ বেবেতো

তিনি তাঁর বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারকে বোকা বানিয়ে নিজেকে মুক্ত করতে পারতেন তাঁদের মার্কিং থেকে। তবে তাঁর ইনজুরি প্রবণতা এবং শারীরিক গঢ়ন তাঁকে বিশ্বের অন্যতম সেরা একজন স্ট্রাইকারে পরিণত হতে দিয়েছে বাঁধা। শারীরিক গড়নের অপ্রুলতা তিনি পূরণ করে দিতেন তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, খরগোশের ন্যায় দ্রুত গতি, অসাধারণ বল কন্ট্রোল দিয়ে। তাছাড়া মাঠে তিনি সর্বদাই থাকতেন চনমনে। শিকারি বাজপাখির মত অপেক্ষায় থাকতেন সঠিক সময়ে প্রতিপক্ষের দূর্গভেদের।

একজন ব্রাজিল ফুটবল ভক্ত যখন তাঁর ছোট্ট শিশুটিকে কোলে নিয়ে দোলান তখন তাঁর মনে নিশ্চয়ই ভেসে উঠে ১৯৯৪ বিশ্বকাপের কথা। বিশ্ব ফুটবলে শিশুকে কোলে নিয়ে দোলানোর ভঙ্গিমায় যে গোল উদযাপন করা যায় তা হয়ত প্রথম বারের মত দেখিয়েছিলেন ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার বেবেতো। আইকনিক বেবেতো সেলিব্রেশন।

বেবেতো যার পুরো নাম হোসে রবার্তো গামা দে অলিভিয়েরা ছিলেন ১৯৯৪ বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম কাণ্ডারি। বেবেতো হয়ত শৈশবে ভাবেননি তিনি কখনো সেই স্বর্ণালী ট্রফিটি হাতে নিয়ে উঁচু করে তুলে ধরতে পারবেন বিশ্বের কাছে। ১৬ বছরে স্কুলের পাঠ শেষ করে তিনি সাধারণ ব্রাজিলিয়ান কিশোরদের পথ অনুসরণ করে যোগ দিয়েছিলেন সালভাদোরের স্থানীয় ক্লাবে।

ব্রাজিলের সব কিশোরের মনে একটু আধটু আশা কিংবা প্রত্যাশা থাকেই হলুদ-নীল জার্সি পরে বিশ্বকাপের মঞ্চে ফুটবলের কারুকার্যে মাতিয়ে তুলবে দর্শক-সমর্থকদের। হতে পারে সেই আশা কিংবা প্রত্যাশা অত্যন্ত ক্ষীণ। তবুও আর দশটা ছেলের মত এই স্বপ্ন হয়ত নিজের মধ্যে ধারণ করতো বেবেতো। তাই তো মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে স্থানীয় ক্লাব থেকে পৌঁছে যান ব্রাজিলের অন্যতম সেরা ক্লাব ফ্ল্যামেঙ্গোতে। সেখান থেকেই উত্থান।

১৯৮৩ থেকে ১৯৮৯ সাল অবধি তিনি ছিলেন ফ্ল্যামেঙ্গোর প্রধান স্ট্রাইকার। বেবেতোর অসাধারণ আক্রমণাত্মক খেলার ধরণেই ছিল ফ্লেমেঙ্গোর আস্থা। তিনি এই দীর্ঘ ছয় বছরে দলটির হয়ে ম্যাচ খেলেছেন ৮০টি। এই ৮০ ম্যাচের মধ্যে তিনি ফ্লেমেঙ্গোর জার্সিতে প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়েছেন ৩৪ বার।

তারপর খানিক মনোমালিন্য নিয়ে তিনি চলে যান ফ্ল্যামেঙ্গোর শহর প্রতিদ্বন্দী ভাস্কো দা গামা ক্লাবে। সেখানে কাটান তিন বছর ম্যাচ খেলেন ৫৩টি। গোলের সংখ্যা ২৮। ব্রাজিলের পাট চুকিয়ে তিনি রওনা হলেন স্পেনের উদ্দেশ্যে। খেললেন ডেপোর্তিভো লা করুনার হয়ে ৪ বছর।

সেই সময়ই নিজের মনে সুপ্ত স্বপ্নের সাথে মেলবন্ধন ঘটে বেবেতোর। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের হয়ে খেলার আরো একটি সুযোগ চলে আসে তাঁর কাছে। ১৯৯০ এর অধরা স্বপ্নকে অর্জন করার হাতছানি। তাছাড়া বঞ্চনার জবাব দেওয়ার মোক্ষম সুযোগ।

তিনি সেবার পৌঁছুলেন যুক্তরাষ্ট্রে ব্রাজিল জাতীয় ফুটবল দলের সাথে। জুঁটি বাধলেন আরেক তুখোড় স্ট্রাইকার রোমারিওর সাথে। তাঁদের অনবদ্যতায় ব্রাজিল ফাইনালে পৌঁছেছিল অপরাজিত থেকেই। গ্রুপ পর্বে একটি মাত্র ড্র করেছিল সুইডেনের বিপক্ষে। রোমারিও ও বেবেতোর যুগলবন্ধি ছিল উপভোগের চূড়ান্ত উপাদান। দ্বিতীয় রাউন্ড ব্রাজিল পার করে বেবতোর একটি মাত্র গোলে। অন্যদিকে, সেমিফাইনালে করা রোমারিওর একটি মাত্র গোলেই ফাইনালে উঠতে পেরেছিল ব্রাজিল।

বেবেতো এবং রোমারিওর জুঁটি ব্রাজিলের ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে জয়ে ঠিক কতটুকু অবদান রেখেছেন তা এই ছোট্ট দুইটি তথ্য থেকেই অনুমেয়। দুইজনে মিলে সেই এক টুর্নামেন্টে করেছিলেন আট গোল। বেবেতোর তিন রোমারিওর পাঁচ। তবে বেবেতো যেই এক গোল উদযাপনের জন্য় হয়েছেন ফুটবল অঙ্গণে সুপরিচিত সেই উদযাপনের ম্যাচটি ছিল নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে।

কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল নেদারল্যান্ড ও ব্রাজিল। বেশ ভালই বেগ পোহাতে হয়েছিল সেবার দারুণ ছন্দে থাকা ব্রাজিলের জয় ছিনিয়ে নিতে। ব্রাজিল ম্যাচটি জিতেছিল ৩-২ গোলে। সেই ম্যাচে দ্বিতীয় গোলটি করেই বেবেতো ছুটেছিলেন তাঁর সেই আইকনিক গোল উদযাপনে। তিনি আসলে তাঁর সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া ছেলে সন্তান ম্যাথুস অলিভিয়েরাকে উৎসর্গ করতেই অমন ভিন্নধর্মী পন্থা অবলম্বন করেন।

বড় হয়ে সেই ছেলেও খেলেছিল পেশাদার ফুটবল। তবে বাবার মত খুব একটা সাফল্যের ছোঁয়া তিনি পাননি। বেবেতো তাঁর জাতীয় দলের জার্সি গায়ে সম্ভাব্য সব কিছুই জিতেছেন। বিশ্বকাপ, কোপা আমেরিকা, কনফেডারেশন্স কাপ, অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ। ব্রাজিলের সেই হলুদ জার্সি গায়ে তিনি মাঠ মাতিয়েছেন দীর্ঘ তেরটি বছর। এই তের বছরে দেশের হয়ে শিরোপা জেতাতে অনন্য অবদান রেখে গিয়েছেন আক্রমণভাগের এই খেলোয়াড়। জাতীয় দলের হয়ে ৭৫ম্যাচে করেছেন ৩৯ গোল।

তবে শুধু গোল দিয়ে মাঠে বেবেতোর উপস্থিতি কিংবা ইমপ্যাক্ট পুরোপুরি তুলে ধরা সম্ভব নয়। তিনি তাঁর ফুটবলীয় শৈলীতে ভক্ত-সমর্থক কিংবা সমালোচকদের কাছ থেকে ব্রাজিলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব পেয়েছেন। বেবেতো ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত গোলস্কোরার।

তিনি তাঁর বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারকে বোকা বানিয়ে নিজেকে মুক্ত করতে পারতেন তাঁদের মার্কিং থেকে। তবে তাঁর ইনজুরি প্রবণতা এবং শারীরিক গঢ়ন তাঁকে বিশ্বের অন্যতম সেরা একজন স্ট্রাইকারে পরিণত হতে দিয়েছে বাঁধা।

শারীরিক গড়নের অপ্রুলতা তিনি পূরণ করে দিতেন তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, খরগোশের ন্যায় দ্রুত গতি, অসাধারণ বল কন্ট্রোল দিয়ে। তাছাড়া মাঠে তিনি সর্বদাই থাকতেন চনমনে। শিকারি বাজপাখির মত অপেক্ষায় থাকতেন সঠিক সময়ে প্রতিপক্ষের দূর্গভেদের।

মূলত একজন স্ট্রাইকার হলেও তাঁকে দলের প্রয়োজনে দ্বিতীয় স্ট্রাইকার কিংবা প্লে-মেকিং অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবেও খেলতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। মোদ্দাকথা বেবেতো ছিলেন একজন ভার্সেটাইল আক্রমণাত্মক বুদ্ধিমান ফুটবলার। তিনি জানতেন মাঠে তাঁর কাজটা ঠিক কি এবং দলের প্রয়োজন মেটাতে ছিলেন সদা প্রস্তুত।

২০০২ সালে বেবেতো ইতি টেনে নিয়েছিলেন তাঁর ফুটবলীয় ক্যারিয়ারের। এখন তিনি পুরোদস্তুর একজন রাজনীতিবিদ। ব্রাজিলিয়ান রাজনৈতিক দল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য তিনি। মাঝে দুই বছর কোচিং ক্যারিয়ারেও যুক্ত হয়েছিলেন বেবেতো।

তবে জীবনের শেষ বয়সে এসে যৌবনে ফুটবল মাঠের সদা চনমনে বেবেতো হয়ত থিতু হতে চান একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে। তবে তিনি ফুটবলের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রইবেন তাঁর শিশু কোলে নিয়ে দোলানো অঙ্গভঙ্গিতে করা গোল উদযাপনের জন্য কিংবা ব্রাজিলের ইতিহাসের একজন বিশ্বকাপ জয়ী কিংবদন্তি হিসেবে।

 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...