পর্দার আড়ালে রূপান্তর

পঞ্চদশ আসরের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) ব্যাট হাতে দুর্দান্ত ফর্মে লখনৌ সুপার জায়েন্টসের ব্যাটার দি পক হুডা। অথচ গেল আসরে ছিলেন ব্যর্থ। এর আগে গেক বছরের শুরুতে বরোদায় নিজ দলের অধিনায়ক ক্রুনাল পান্ডিয়ার সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে দল থেকে বেরিয়ে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছিলেন এই ব্যাটার।

গেল আসরে পাঞ্জাবের জার্সি গায়ে ১২ ম্যাচে ১৬ গড়ে করেছিলেন মাত্র ১৬০ রান। এরপর পঞ্চদশ আসরের মেগা নিলামে ৫.৭৫ কোটি রুপিতে তাঁকে দলে ভেড়ায় লখনৌ সুপার জায়েন্টস। লখনৌ জার্সি গায়ে এবার তিনি আছেন উড়ন্ত ফর্মে। ১৫ ম্যাচে ৩২ গড় আর ১৩৬ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ৪৫১ রান; আছে চার ফিফটি।

সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে রাজস্থানের হয়ে খেলেন হুডা। ২০২১-২২ আসরে তিনি টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। ৬ ম্যাচে ৭৩ গড়ে ৪ ফিফটিতে ২৯৪ রান করেছেন রাজস্থানের এই তারকা ব্যাটার।

আইপিএলে দুর্দান্ত এই ফর্ম নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে হুডা বলেন, ‘খুব ভাল অনুভব করছি। দীর্ঘদিন পর এত ভাল লাগছে। আমি আশা করি এটা ধরে রাখবো, আরও ভাল করবো।’

তবে রাজস্থানের প্রধান কোচ নিখিল ডরু বলেছেন কঠোর পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বাসেই সমালোচনার বৃত্ত থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দুর্দান্ত পারফরম করছেন হুডা। লেগ সাইডেই বেশিরভাগ সময় শটস খেলা হুডার ব্যাটিংয়ে কৌশলগত কিছু পরিবর্তন এনেছেন রাজস্থানের এই কোচ।

তিনি বলেন, ‘আগে সে লেগ সাইডে খুব ভাল খেলতো, অফ সাইডে একটু দূর্বল ছিল। এবার সে অফ সাইডে শটস খেলেছস, এটা নিয়ে অনেক কাজ করেছে। কভারের উপর দিয়ে শটস খেলেছে, মিড অফের উপর দিয়ে ছক্কা হাঁকিয়েছে। সে আমাকে বলেছিল, আমি দীর্ঘদিন ধরে আইপিএলে খেলছি; সবাই জানে আমি লেগ সাইডে ভাল। তাই সে অফ সাইডেও কাজ করেছে, উন্নতি করেছে অনেক। সে সুইপ, রিভার্স সুইপও খেলেছে; সে এখন ৩৬০ ডিগ্রি খেলোয়াড়। সে তাঁর ম্যুভমেন্ট নিয়েও কাজ করেছে। আগে তাঁর দাঁড়ানোটা লেগ সাইড মুখী ছিল এখন ঠিক আছে।’

নেটে অনুশীলন ছাড়াও নিজ বাসায় সময় পেলেই অনুশীলন করেছেন হুডা। যখনই সুযোগ হয়েছে নিখিল ছুঁটে গেছেন হুডাকে সাহায্য করতে। নিখিল বলেন, ‘যখন সে রাজস্থানে আসলো আমার মতে তার মাইন্ডসেট ছিল সে ভারতের হয়ে খেলবে। সে নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছে। সে প্রথম যেদিন আসলো – সকালেই অনুশীলন শেষ করে আমার কাছে সন্ধ্যা এসেছিল অতিরিক্ত অনুশীলনের জন্য। সে সবসময়ই অতিরিক্ত অনুশীলন করতে চায়। সে নেটে লম্বা সময় ব্যাটিং অনুশীলন করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তাঁর অনুশীলন, কঠোর পরিশ্রম, এটিটিউড – সব মিলিয়ে গেল বছরের তুলনায় বেশ পরিবর্তন এসেছে। অতিরিক্ত অনুশীলন করেছে, সে বাসায় অনুশীলন করে আমাকে ভিডিও করে পাঠাত। এমনকি যখন আমরা কোয়ারেন্টাইনে ছিলাম সে আমাকে বাগানে নিয়ে যেত; বাইরে জিম করতো অনুশীলন করতো। আমাদের দলের আর কেউ তাঁর মত অনুশীলন করে না।’

আইপিএলে মূলত ফিনিশার ভূমিকাতেই খেলতেন তিনি। এরপর গেল আসরের সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে চারে ব্যাট করে সফল হয়েছিলেন। সেখান থেকে লখনৌর হয়ে এবারের আইপিএলেও উপরের দিকে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেলেন; করলেন দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। তিন থেকে সাত নম্বর পজিশনে এবারের আসরে খেলেছেন তিনি।

নিখিল বলেন, ‘বরোদাতেও সম্ভত একই সমস্যা ছিল। সে উপরের দিকে ব্যাট করতে চেয়েছে; কিন্তু তারা মানে নি। আমাদের গত কয়েক বছর ধরে সমস্যা হচ্ছে আমারা কোয়ালিফাই করা সত্ত্বেও ভাল ফিনিশার পাচ্ছি না। আমি তাকে বললাম ৫ অথবা ৬ এ খেলতে হবে। সে আমাকে বলল সে চারে খেলতে চায় এবং আমাকে প্রতিজ্ঞা করলো সে শেষ করে আসবে। ঝাড়খণ্ডের বিপক্ষে আমাদের শেষ ৬ ওভারে ৬৬ রান দরকার ছিল। সে দুই ওভার বাকি থাকতেই ম্যাচ জিতিয়ে দেয় (৩৯ বলে ৭৫ করেন হুডা)। আমরা হুডাকে চারেই রাখলাম। সে ওই পজিশনে আমাদের জন্য দুইটা ভূমিকাই পালন করেছে।’

হুডা বলেন, ‘সত্যি বলতে আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছিল আমি উপরে ব্যাট করতে পারবো। আমি ব্যাটার হিসেবে স্কিলের অনেক উন্নতি করেছি। আমার কাছে মনে হয় আমি অলরাউন্ডার হিসেবে এখন পূর্ণ। আমি সবসময়ই পরিস্থিতি বুঝে ব্যাট করি, দলের যেমন প্রয়োজন। আমি গত আসরে যেটা করতে পারিনি এই আসরে করেছি। আমি পরিস্থিতি আগের চেয়েও ভাল বুঝি এখন। আমি ভাল ইন্টেন্ট নিয়ে খেলতে চাই।’

২০১৫ সালে আইপিএলে অভিষেক। এরপর ব্যাট হাতে অনেকটাই নিষ্প্রভ ছিলেন তিনি। দিতে পারেননি নিজের সেরাটা। তবে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন বেশ, শিক্ষা নিয়েছেন। আর সেটি কাজে লাগিয়ে সফলও হয়েছেন।

লখনৌর এই ব্যাটার বলেন, ‘আমার ২০ বছর বয়সে অভিষেক হয়। আমার এই সফরে অনেক উত্থান-পতন ছিল। তরুণ ক্রিকেটার হিসেবে আমি অনেক কিছু শিখেছি। আমি আমার জায়গা থেকে কাজ করেছি। ব্যক্তি হিসেবেও নিজের মধ্যে অনেক উন্নতি হয়েছে। রাজস্থান রয়্যালস, সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ, পাঞ্জাব কিংস এবং লখনৌর হয়ে আমি খেলেছি। আমার সফর শুরু হয় রাজস্থানের সাথে। প্রথম মৌসুমে খেলতে পারিনি। পরের মৌসুমে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচেই ম্যাচ সেরা হই। আমি হায়দ্রাবাদে গেলাম, সেখানে শিরোপা জিতলাম। লোয়ার অর্ডারে বিশ্বের প্রথম ও দ্বিতীয় সেরা অলরাউন্ডারের (সাকিব আল হাসান ও মোহাম্মদ নবী) সাথে খেলেছি। আমি শিখেছি কিভাবে খেলা শেষ করে আসতে হয়। পাঞ্জাবের সাথে আমার পারফরম্যান্স একটু খারাপ ছিল। এখন লখনৌর সাথে ভাল খেলছি। তারা আমার উপর আস্থা রেখেছে। আমার আত্মবিশ্বাসও অনেক বেড়েছে।’

বিজয় হাজারে ট্রফিতে রাজস্থানের হয়ে অধিনায়কত্ব করেছেন তিনি। রাজস্থানে হুডা আসায় কোচ নিখিল মনে করেন দলের শক্তিমত্তা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। নিখিল বলেন, ‘যদি আপনি রাজস্থানের দিকে তাকান। আমাদের বেশ কিছু বোলার ভারতের হয়ে খেলেছে। সে আসায় আমাদের ব্যাটিংয়ে আরও উন্নতি হয়েছে। আমরা বোলিং দিয়ে ম্যাচ জিততাম, কিন্তু সে আসায় ব্যাটারদের দ্বারাও আমরা ম্যাচ জিততেছি। বিজয় হাজারে ট্রফিতে আমরা সফলতা পেয়েছি। সে যদি ৩-৪ বছর রাজস্থানের হয়ে খেলে তাহলে আমরা ভারতের জন্য ভাল কিছু ব্যাটার তৈরি করতে পারবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘যখনই সে ব্যাট করতে যায় মনে হয় সে অতিরিক্ত সময় পাচ্ছে। সে যখন মুশতাক আলী ট্রফিতে ভাল করলো তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস আরও বেড়েছে।’

ঘরোয়া ক্রিকেট ও আইপিএলে ভাল করা সত্ত্বেও খুব বেশি প্রশংসা কুড়াতে পারেননি হুডা। তবে হুডা নিজের স্বাভাবিক খেলা ধরে রাখতে চান, সংখ্যা নিয়ে মোটেও ভাবতে চান না তিনি। হুডা বলেন, ‘আমি আমার ব্যাটিংয়ে খুব বেশি পরিবর্তন করিনি। আমি ঘরোয়া ক্রিকেটে তিন, চার, পাঁচে খেলেছি। সংখ্যাটা আমার কাছে খুব বড় না। আমি আমার খেলাটা সবসময়ই সাধারণ রাখতে চাই। আমি আমার নীতিতে ঠিক থাকতে চাই। আমার একটা ভাল মৌসুম কেটেছে আইপিএলে এবং আমি এটা ধরে রাখতে চাই।’

লখনৌর হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর হুডার চোখ এখন জাতীয় দলে। হয়ত জাতীয় দলের সবুজ গালিচায় দেখা যেতে পারে উড়ন্ত ফর্মে থাকা এই তারকা ব্যাটারকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link