একটা সময় মনে হতো, এটা সাধারণ একটা মিথ। কিন্তু ৫৮টি বছর পার করে ফেলার এখন অন্তত মনে হয়, আসলেই কী তাহলে অভিশাপের ফলে এই অবস্থা বেনফিকার? বেলা গাটম্যানের অভিশাপই কী দলটাকে ইউরোপের ট্রফি বঞ্চিত করে রেখেছে?
বেলা গাটম্যানের অভিশাপের ৫৮ বছর কেটে গেলো। কিন্তু এখনো বেনফিকা জিততে পারেনি কোনো ইউরোপিয়ান কোনো ট্রফি।
ফুটবল বোদ্ধারা কখনই জানতে পারেননি কিংবা জানতে পারবেনও না, গাটম্যান আসলে কি বলেছিলেন বেনফিকাকে। তবে ধারণা করা হয় ক্লাব ছাড়ার সময় ১৯৬২ সালে রাগ করে বলেছিলেন, ‘আগামী ১০০ বছরে বেনফিকা ইউরোপিয়ান কোনো শিরোপা জিততে পারবে না।’
কিন্তু কেন এই অভিশাপ দেয়া? এটা নিয়ে জানতে হলে ফিরতে হবে ১৯৬০ এর দশকে।
আমরা যারা ফুটবল দেখি কিংবা ফুটবলের খোঁজ খবর রাখি তাদের কাছে বেনফিকা নামটি বেশ পরিচিত। কিন্তু বেলা গাটম্যানের নাম না জানা টাই স্বাভাবিক।
গাটম্যান ছিলেন একজন হাঙ্গেরিয়ান ফুটবলার এবং কোচ। তাঁকে ঠিক ফুটবলার কিংবা কোচ না বলে যাযাবর বলাটাই ভালো। কারণ তিনি ফুটবল ক্যারিয়ার কিংবা কোচিং ক্যারিয়ারে কখনোই এক ক্লাবে দুই মৌসুমের বেশি সময় কাটাননি। তিনি বিশ্বাস করতেন তৃতীয় মৌসুম তাঁর জন্য পয়মন্ত নয়। তাই দুই মৌসুম পরই বিদায় জানাতেন ক্লাবকে। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন বেনফিকাতে। এখানে কোচিং করিয়েছিলেন তিন মৌসুম।
গাটম্যানের বাবা-মা ছিলেন নাচের জগতের মানুষ। সেই সূ্ত্রেই মাত্র ১৬ বছর বয়সে নাচের শিক্ষকের ভূমিকায় চলে আসেন তিনি। ওইসময়ে হাঙ্গেরী পরিণত হচ্ছিলো ফুটবল পরাশক্তিতে। তখনই সিদ্ধান্ত নেন ফুটবলে ক্যারিয়ার গড়বেন। প্রথমে যোগ দেন বুদাপেস্টের সবচেয়ে বড় ইহুদী ক্লাব বুদাপেস্টে। আর সেখানে নজর কাড়া পারফর্ম করে জায়গা করে নেন হাঙ্গেরিয়া জাতীয় দলে। খেলেন ১৯২৪ অলিম্পিকে।
কিন্তু তাঁর নীতিবোধের কারণে ফুটবল ফেডারেশনের চক্ষুশূল হয়ে দল থেকে বাদ পড়তে সময় লাগে নি। আর এর ফলেই অসময়েই শেষ হয়ে যায় তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ার। এরপর হাঙ্গেরি ছেড়ে অস্ট্রিয়া, আমেরিকা ঘুরে আবারো অস্ট্রিয়ায় ফিরে ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানেন তিনি। ১৪ বছরের খেলোয়াড়ী জীবনে কোনো ক্লাবেই দীর্ঘ সময় থাকতে পারেননি। এই কারণেই তাঁকে বলা যেতে পারে তিনি শুধু একজন ফুটবলারই নন একজন যাযাবরও বটে।
খেলোয়াড়ী জীবন ইতি টানার পর ফুটবলের সাথেই মিশে যান গাটম্যান। প্রায় ৪০ বছরের কোচিং জীবনে কোচিং করিয়েছেন ২৮ টি ক্লাবে।
তাঁর মত যাযাবরের জন্য এক ক্লাবে দীর্ঘ দিন থাকা টা ছিলো বেশ কঠিন। তিনি একের পর এক ক্লাবকে কোচিং করিয়েছেন। জন্মভূমি হাঙ্গেরির এ মাথা থেকে ও মাথা, অস্টিয়া, রোমানিয়াতে কোচিং করিয়েছেন। শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি। কোচিং করিয়েছেন আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলে। এছাড়াও গ্রিস, ইতালিতেও কোচিং করিয়েছেন। এর পর তিনি আসেন ভাস্কো ডা গামার দেশ পর্তুগালে। এখানে এসেই পরিণত হন কিংবদন্তিতে।
পর্তুগালে প্রথম মৌসুমে কোচিং করিয়েছিলেন এফসি পোর্তোকে। শুধু কোচিং করাননি, জিতিয়েছেন পর্তুগিজ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা। এর পরের মৌসুমেই কোচ হিসেবে যোগ দেন আরেক পর্তুগিজ ক্লাব বেনফিকাতে। এখানে এসেই বিদায় করেন মূল দলের ২০ জন ফুটবলারকে।
হ্যাঁ, ২০ জন ফুটবলার। একাডেমির ফুটবলারদের নিয়ে গড়ে তোলেন নতুন বেনফিকা দল। আর সেই দলই প্রথম মৌসুমেই দলকে জিতিয়েছিলো পর্তুগিজ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা। এছাড়াও গাটম্যান বেনফিকাকে এনে দেন ইউরোপিয়ান লিগের প্রথম শিরোপা। রিয়াল মাদ্রিদ বিহীন প্রথম ইউরোপীয়ান লিগের ফাইনালে বেনফিকাকে তুলেন। ফাইনালে বার্সেলোনাকে হারিয়ে দ্বিতীয় দল হিসেবে জিতে নেয় ইউরোপিয়ান লিগের শিরোপা।
১৯৬২ সালে আবারো ইউরোপিয়ান লিগের ফাইনালে তুলেন দলকে। এবার ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিলো রিয়াল মাদ্রিদ। তাদেরকে প্রথমবারের মত ইউরোপিয়ান লিগের ফাইনালে হারের স্বাদ দেয় গাটম্যানের বেনফিকা। জিতে নেয় ইউরোপিয়ান লিগের দ্বিতীয় শিরোপা। পরপর দুই মৌসুমে দলকে ইউরোপিয়ান লিগের ফাইনাল জেতানোর পর বেতন বৃদ্ধির দাবি করতেই পারেন যেকোনো কোচ। ঠিক সেই দাবিটাই করেছিলেন বেলা গাটম্যান।
বেনফিকা বোর্ড বেতন বৃদ্ধি না করে বরং তাঁকে চলে যেতে বলে। আর এই সময়েই স্টেডিয়ামে বলে যান, ‘আগামী ১০০ বছরে বেনফিকা আর কোনো ইউরোপিয়ান শিরোপা জিততে পারবে না।’
এরপর আবারো বেনফিকাতে ফিরেছিলেন বেলা গাটম্যান। কিন্তু সরে আসেননি তাঁর অভিশাপ থেকে। অনেকেই হয়তো কথাটাকে নগন্য ভেবেছিলেন। কিন্তু ১৯৬২ সালের পর আজ পর্যন্ত আট বার ইউরোপিয়ান বিভিন্ন টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলেছে বেনফিকা। কিন্তু কোনো বারই ট্রফিকেসে যোগ করতে পারে নি কোনো ইউরোপিয়ান শিরোপা।
শুধু সাফল্য নয় বেনফিকা দলকে গড়ে তুলেছিলেন নিজ হাতে। সেই দল একসাথে প্রায় ১১ বছর বেনফিকাতে খেলে গিয়েছিলো। কিন্তু সেই দলকে একত্রিত করার নায়ক গাটম্যান থাকতে পারেননি দলের সাথে।
গাটম্যান ছিলেন ৪-৪-২ ফর্মেশনের জনক। যেই ফর্মেশন মেনেই ১৯৫৮ সালে বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তুলেছিলো ব্রাজিল।
গুতম্যান চলে যাবার পর ইউরোপিয়ান লিগের ফাইনাল হারার পর ক্ষমা চেতে তাঁর সমাধিতে যান তারই প্রিয় শিষ্য ইউসেবিও। ১৯৯০ সালে ইউরোপিয়ান লিগের ফাইনালের আগে গাটম্যানের সমাধিতে গিয়ে কান্না করে ক্ষমা চেয়ে আসেন তাঁরই প্রিয় শিষ্য ইউসেবিও। কিন্তু তাও কি ক্ষমা করেছেন গ্যাটম্যান? মনে হয় করেননি। হয়তো উপর থেকেই বলছেন, ‘সবুর করো।’