ডার্ক হর্স নাকি শিরোপার দাবিদার!

ডার্ক হর্স তকমা কিংবা নিজেদের ইতিহাসের সোনালি প্রজন্ম নিয়েও আন্তর্জাতিক কোনো টুর্নামেন্টের শিরোপা জেতা হয়নি বেলজিয়ামের। অথচ শিরোপা জেতার মতই দল ছিল তাঁদের। ধারাবাহিকভাবে ভাল ফুটবল খেলে র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষেও উঠেছিল দলটি। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে বিশ্বকাপে মেলে ধরতে পারেনি নিজেদের। ২০১৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা এবং ২০১৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়েছে ফাইনালের আগেই। 

পূর্বের দুই বিশ্বকাপের বেলজিয়ামের সাথে বর্তমানে বেলজিয়ামের যেন আকাশপাতাল তফাৎ। ভিনসেন্ট কোম্পানি, মার্ক ভারমিউলেনরা অবসর নিয়েছেন, ফর্ম হারিয়ে গড়পড়তা মানের ফুটবলারে পরিণত হয়েছেন এডেন হ্যাজার্ড, রোমেলু লুকাকুরা। সব মিলিয়ে বর্তমানের বেলজিয়ামকে বিশ্বকাপের দাবিদার কিংবা ডার্কহর্স হিসেবে মানতে চায় না কেউই। তবুও সোনালি প্রজন্মের শেষ সুযোগ হিসেবে এবারের বিশ্বকাপে মরণকামড় দিতে চায় রেড ডেভিলরা। 

বেলজিয়ামের দলটাকে একদম শুরু থেকে গড়ে তুলেছেন রবার্তো মার্টিনেজ। একদম গোড়া থেকেই কোচ এবং টেকনিক্যাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছয় বছরের যাত্রায় নানা ঝড়ঝাপটা ব্যর্থতা এলেও বেলজিয়ান ফুটবল ফেডারেশন আস্থা হারায়নি। এ বছরের শেষেই চুক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে রবার্তো মার্টিনেজের। চুক্তি নবায়ন করার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। স্প্যানিশ এই কোচ চাইবেন বিশ্বকাপ জিতেই এই লম্বা যাত্রার ইতি টানতে। 

বেলজিয়ামের এবারের বিশ্বকাপ দলে গোলরক্ষক হিসেবে তিনজন থাকলেও শুরুর একাদশে থিবো কোর্তোয়ার জায়গা নিশ্চিত। ২০১৮ বিশ্বকাপে গোল্ডেন গ্লাভস জেতা কোর্তোয়া বরবারই এক ভরসার নাম। তাছাড়া রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে তাঁর সাম্প্রতিক ফর্মটাও দুর্দান্ত। সবমিলিয়ে তিনি ইনজুরিতে না পড়লে সিমন মিগনোলেট এবং কোয়েন কাস্টেলসের মাঠে নামার সম্ভাবনা নেই। ডিফেন্সে তরুণদের চাইতে বরং অভিজ্ঞ বর্ষীয়ানদেরই ডেকেছেন মার্টিনেজ।

তিন বর্ষীয়ান ইয়ান ভার্টোঙ্গেন, টবি অল্ডারওয়েল্ড এবং লিয়েন্দার ডেনায়ের। এই তিনজনের কাঁধেই থাকবে বেলজিয়ামের রক্ষণভাগকে আগলে রাখার দায়িত্ব। বেঞ্চে থাকা অন্য তিনজনই বেলজিয়াম লিগে খেলায় বিশ্ব ফুটবলে তেমন পরিচিত নাম নন। হাতে অপশন না থাকায় মার্টিনেজকে তাই ভরসা করতে হচ্ছে যেন ডিবাস্ট, আর্থুর থিয়েটে, ওয়ুট ফায়েসদের উপরেই। 

চার মিডফিল্ডার খেলানোয় বেলজিয়ামের মিডফিল্ডারের লিস্টটা বেশ লম্বা। ক্লাবে উইংব্যাক হিসেবে খেলা ইয়ানিক কারাস্কো, টিমোথি কাস্তাগনে, থমাস মুনিয়েররা জাতীয় দলে খেলবেন মিডফিল্ডার হিসেবেই। মূলত মিডফিল্ডে বল দখলের লড়াইতে এগিয়ে থাকার জন্যই মার্টিনেজের এমন ভাবনা।

মিডফিল্ডের মাঝের জায়গাটা নিয়ে অবশ্য দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই তাঁর। বিশ্বের অন্যতম সেরা দুই মিডফিল্ডার কেভিন ডি ব্রুইনা এবং ইউরি টিয়েলম্যান্স সামলাবেন বেলজিয়ামের মাঝমাঠ। কেভিন ডি ব্রুইনার ব্যাপারে নতুন করে কিছু বলার নেই, গোল করার পাশাপাশি গোল বানিয়ে  দিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। গত মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটিকে জিতিয়েছেন প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা। মিডফিল্ডে তাঁর পার্টনার টিয়েলম্যান্সও আছেন ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে, লেসটার সিটিকে এই মৌসুমে টানছেন একা হাতে।

এই মৌসুমে মাত্র ৩৯১ মিনিট মাঠে থেকে তিন গোলের পাশাপাশি করেছেন এক অ্যাসিস্ট। এছাড়া প্রতিপক্ষের পা  থেকে বল কেড়ে নিতেও দারুণ দক্ষ এই মিডফিল্ডার। বেঞ্চে থাকা অ্যাক্সেল উইটজেল, আমাদু ওনানাও বদলি হিসেবে নেমে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেবার সামর্থ্য রাখেন। বেলজিয়ামের উইংগার হিসেবে খেলবেন জেরেমি ডকু, এডেন হ্যাজার্ড, ড্রিস মের্টেন্স, লিয়ান্দ্রো ট্রসার্ড, চার্লস ডে কেটেলাররা। আর মাঝে স্ট্রাইকার হিসেবে থাকবেন রোমেলু লুকাকু, মিচি বাতশুয়াইরা।

তবে বেলজিয়ামের মূল দুশ্চিন্তাটা তাঁদের দুই মূল তারকা লুকাকু এবং হ্যাজার্ডকে নিয়ে। দুইজনেরই সমস্যার শুরুটা ক্লাব ছাড়ার পর থেকে। একজন চেলসি ছেড়ে ফর্ম হারিয়েছেন, অন্যজন চেলসিতে এসে। রিয়াল মাদ্রিদে আসার পর থেকেই ইনজুরি, ফর্মহীনতা, ফিটনেসজনিত সমস্যায় খেলার পুরনো ধার হারিয়ে ফেলেছেন হ্যাজার্ড। গত মৌসুমের প্রায়  পুরোটা ইনজুরিতে কাটিয়ে ধুঁকছেন এই মৌসুমেও, জায়গা হারিয়েছেন প্রথম একাদশ থেকে।

অন্যদিকে ইন্টার মিলানে রীতিমত স্বপ্নের মত এক মৌসুম কাটিয়ে রেকর্ড ট্রান্সফার ফি’তে চেলসিতে যোগ দেন স্ট্রাইকার লুকাকু। কিন্তু দুঃস্বপ্নের মত এক মৌসুম কাটিয়েছেন, ৪৪ ম্যাচে মাঠে নেমে করেছেন মোটে ১৫ গোল। ভুল বুঝতে পেরে পুরনো ক্লাবে ফিরলেও এখনও পুরনো ফর্ম ফিরে পাননি, এ মৌসুমে প্রথম একাদশে ছিলেন মাত্র চার ম্যাচে। তবে রবার্তো মার্টিনেজকে আশা জোগাবে লিয়ান্দ্রো ট্রসার্ডের ফর্ম। ইপিএলের ক্লাব ব্রাইটনে খেলা এই ফুটবলার রীতিমত উড়ছেন, সাত গোলের পাশাপাশি করেছেন তিন অ্যাসিস্ট।

তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ হল তাঁর ভার্সেটাইলিটি, আক্রমণভাগের সকল পজিশনেই খেলতে জানেন তিনি। উইংগার হিসেবে খেলা শুরু করলেও ফলস নাইন কিংবা আক্রমণাত্নক মিডফিল্ডার হিসেবেও সমান সাবলীল তিনি। এখন দেখার বিষয় রবার্তো মার্টিনেজ কতোটা ভালভাবে ব্যবহার করতে পারেন এই কুশলী ফুটবলারকে। 

এবারের বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের সবচেয়ে বড় তারকা অবশ্যই কেভিন ডি ব্রুইনা। তাঁর মত ফুটবলার দলে থাকা যে কোনো কোচের জন্যই আশীর্বাদ। তাঁর মানের প্লেমেকিং অ্যাবিলিটি সম্পন্ন ফুটবলার বর্তমান বিশ্বে বিরল। এই মৌসুমে ১৪ ম্যাচ খেলে ইতোমধ্যেই তিন গোলের পাশাপাশি অ্যাসিস্ট করেছেন ১০ গোলে।

বেলজিয়ামের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আক্রমণ ভাগের তারকাদের ফর্ম এবং ডিফেন্ডারদের বয়স। ফর্মহীন লুকাকু এবং হ্যাজার্ড ছিলেন আগের বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের সবচেয়ে বড় তারকা। সুতরাং বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের ভাল করতে এই দুজনের জ্বলে উঠার বিকল্প নেই। এছাড়া রেড ডেভিলদের ডিফেন্ডারদের তিনজনই বেশ বুড়িয়ে গিয়েছেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে গতি কমে যাওয়ায় প্রতিপক্ষের দ্রুতগতির প্রেসিং ফুটবলের বিপক্ষে কতটা কার্যকর হবেন তাঁরা সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। 

কানাডা, মরক্কো এবং ক্রোয়াশিয়ার সাথে একই গ্রুপে রয়েছে বেলজিয়াম। তুলনামূলক সহজ গ্রুপ থেকে পরের রাউন্ডে উঠতে পারলেও দ্বিতীয় রাউন্ডেই সম্ভাবনা রয়েছে স্পেন কিংবা জার্মানির মুখোমুখি হওয়ার। তবে বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্ম খুব করে চাইবে ডার্ক হর্স তকমা ঝেড়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েই মধুর এক সমাপ্তি টানতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link