অলিম্পিক জ্বরে আপাতত ক্রিকেটের ভাইরাসটা কোথায় লুকিয়ে আছে কে জানে? পতৌদি ট্রফি শুরু, সে খেয়ালই যেন নেই কারোর। না, অলিম্পিকের জ্বরটা বেশ ভালোই লাগছে। তবে ক্রিকেটটা সেই পুরোনো অভ্যাসগুলোর মতোই। কিছুতেই যেন পিছন ছাড়ে না।
তাই স্বভাব বশে (নাকি স্বভাবদোষে?) ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজ শুরুর আগে একটু স্মৃতি মন্থন করেই ফেললাম। বেছে নিচ্ছি আমার দেখা সেরা পাঁচ ভারত ইংল্যান্ড টেস্ট। যেহেতু আমার দেখা, কাজেই সময়কাল ২০০২ সালের জুন মাস পরবর্তী হবে। শুরু করা যাক।
- ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্ট, ২০০২: ফলাফল ড্র
এই টেস্ট আমার জীবনে লাইভ দেখা দ্বিতীয় টেস্ট। তখন সদ্য ক্লাস ২ এর ছাত্র। জীবনের প্রথম টেস্ট দেখার অভিজ্ঞতা খুব তিক্ত। যে মাঠে সপ্তাহ দুয়েক আগে (তৎকালীন) স্বপ্নের নায়ককে জামা উড়িয়ে জয়োল্লাস করতে দেখেছি, সেই একই মাঠে টেস্ট ম্যাচে একেবারে ল্যাজে গোবরে। হয়তো ভাবা শুরুই করে দিয়েছি, ধুর ক্রিকেট দেখে হবে কোন লবডঙ্কা?
ঠিক তখনই টিভির পর্দায় আগমন ঘটলো এই ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টের। এবং টেস্ট ক্রিকেট আমার জীবনের একটা বড়ো অংশ চিরকালীন চুক্তিতে লিজ নিয়ে নেয়। প্রথমেই সেহবাগের সেঞ্চুরি। তারপর শচীন টেন্ডুলকার ও রাহুল দ্রাবিড়ের দ্বিতীয় ইনিংসে চোয়াল চাপা লড়াই। এবং সর্বোপরি সৌরভকে দুই ইনিংসেই দারুন ব্যাট করতে দেখা। যে পরিস্থিতি থেকে ভারত এই টেস্ট বাঁচায়, কয়েক বছর আগে হলে বোধহয় পারতো না। এবং যে ভঙ্গিতে বাঁচায়!
ম্যাচ বাঁচাতে ১১৫ ওভার খেলতে হবে। সেই ১১৫ ওভারে ভারতের রান ৪২৪। প্রায় চারের কাছাকাছি রানরেট। সম্ভবত, মানুষ এই টেস্টের চেয়ে পরের হেডিংলি টেস্টকে মনে রেখেছে বেশি। কিন্তু প্রভাবে এই টেস্ট কম যায় না। হেডিংলি বিস্ফোরণের বারুদ বোধহয় এই ম্যাচ থেকেই সঞ্চয় করে সৌরভের ভারত। শিল্ড বেরি তো লিখেওছেন, ‘ইংল্যান্ডের মাঠে ভারতের ক্রিকেট স্বাধীনতা এই ২০০২-এর ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্ট। ১৯৮৩-এর লর্ডস না, ১৯৭১ এর ওভাল না, কিংবা ১৯৯০ এর ম্যানচেস্টারও না।’
- মুম্বাই টেস্ট, ২০১২: ফলাফল ইংল্যান্ডের জয়
প্রথম টেস্টে স্পিনের সামনে ‘ফুল’ বেইজ্জতি। দ্বিতীয় টেস্টে একেবারে অর্ডারি পিচ। প্রথম দিন থেকেই এক হাত করে ঘুরবে। টসে জিতে ব্যাটিং। আর কি চাই? বিদেশে ৮-০ এর ক্ষতে এর চেয়ে ভালো প্রলেপের ফর্মুলা আর হয় না। কিন্তু মুশকিল হলো, পিটারসেনের মতো জিনিয়াসরা আবার ফর্মুলার ধার ধরেন না।
ঘূর্ণি পিচে সোয়ান ও পানেসার ভালো করবেন এতে আশ্চর্য্যের কিছু নেই। কিন্তু এতদিন ধরে বাঁহাতি স্পিনারের ভয়ে কাঁপতে থাকা পিটারসেন সেদিন যে কি খেয়ে নামলেন! সাথে অ্যালিস্টেয়ার কুকের সংগ্রাম তো আছেই। ভারতের দেশের মাটিতে শেষ বার সিরিজ হারের সূচনা এই টেস্ট থেকেই। এবং ধোনির ঘূর্ণি পিচের ওপর অনাস্থাও বোধহয় ওই ম্যাচ থেকেই।
সেই মৌসুমের শেষে অস্ট্রেলিয়াকে যে ভারত হারায়, তা ভালো উইকেটে ভালো ক্রিকেট খেলেই। তাই শুধু সচিনকে বোল্ড করার বলটা নয়, এই টেস্ট মনে রয়ে গেছে ভারতের মাটিতে হওয়া একটি অন্যতম প্রভাবশালী টেস্ট ম্যাচ হিসাবে।
- এজবাস্টন টেস্ট, ২০১৮: ফলাফল ইংল্যান্ডের জয়
আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় এই টেস্ট দিয়ে তাঁর ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেন। চার বছর আগে লজ্জার আলকাতরা মাখা পারফরম্যান্স ভুলিয়ে সূচনা হয় বিলেতে বিরাট কোহলি সাম্রাজ্যের। জেমস অ্যান্ডারসন, ব্রড সামলে ১৪৯ ও ৫১। অসাধারণ বিশেষণটা না হয় কোনো সাধারণ ইনিংসের জন্যে রাখা থাক।
এটির জন্য আমার কাছে ভাষা নেই। টেস্ট ম্যাচটিও হয়েছিল জমাটি। কিন্তু বাকি সিরিজে কি হতে চলেছে তার একটা আলগা দিকনির্দেশ এই ম্যাচেই ছিল। ভারত দারুণ বল করে টপ-অর্ডারকে শুইয়ে দেবে। কিন্তু ল্যাজের ঝাপটায় ক্ষতবিক্ষত হবে। এবং কঠিন সময়ে ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায়, প্রায় জেতা ম্যাচ জলাঞ্জলি দিয়ে আসবে। সেই সমস্যা এই তিন বছর পরেও পুরোদমে চলছে। দেখা যাক এবার কোনো বদল হয় কিনা।
- লর্ডস টেস্ট, ২০১৪: ফলাফল ভারতের জয়
২৮ বছর পরে লর্ডসে জয়। তাও প্রায় হেরে যাওয়া অবস্থা থেকে। ধোনিকে টেস্ট ম্যাচে কখনোই ভালো অধিনায়ক মনে করি না। কিন্তু ওই একবার তিনি ভালো সিদ্ধান্ত নেন। তখনও অব্দি জনসনের ভূত তাড়া করে বেড়ানো ইংরেজদের আবারো একই ভয়ের সামনে কঠিন সময়ে ফেলে দেয়া।
ইশান্ত শর্মার ক্রিকেট জীবনের সেরা স্পেল। মুরালি বিজয়ের ক্রিকেট জীবনের সেরা ইনিংস। আজিঙ্কা রাহানের অন্যতম সেরা (নাকি সেরাই?) সেঞ্চুরি। এতো কিছুর পরেও কি এই টেস্ট না জিতে উপায় ছিল? বাকি সিরিজে অবশ্য ভারতীয় দল পুনর্মুষিকভব। তবুও তাপপ্রবাহের আগে কালবৈশাখীর আমেজ ছিল এই টেস্ট জয়।
- চেন্নাই টেস্ট, ২০০৮: ফলাফল ভারতের জয়
২৬/১১ পরবর্তী প্রথম টেস্ট। শচীন টেন্ডুলকারের চতুর্থ ইনিংসের মাস্টারক্লাস। তারিখটা এখনও মনে আছে। ডিসেম্বর ১৫। এমনিতে ক্রিকেট ও বলিউড ভারতের নেশার বস্তু। কিন্তু ওই একবারই বোধহয় ক্রিকেট ওষুধ হয়ে ওঠে। ২৬/১১ এর শোক কাটানোর এন্টি ডিপ্রেসেন্ট। সেই ম্যাচ টাই যেন অন্যরকম। অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস স্পিন খেলতে দারুণ দক্ষ, এটা বোধহয় তিনি নিজেও ভাবেন না।অথচ তিনিই কিনা দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি।
বীরেন্দ্র শেবাগ বরাবর চতুর্থ ইনিংসে ছড়ান। সেবারই যেন কিভাবে অনবদ্য খেললেন। আর সচিন তো সেইসময়ে সোনার সময় কাটাচ্ছেন। দেশের মাটিতে তাঁর খেলা অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইনিংস। ভারতের মাটিতে রান তাড়া করে জেতার রেকর্ড। আসলে প্রিয় মাদ্রাজে শচীন বোধহয় ক্রিকেট খেলছিলেন না। তাঁর শহরের শোকের টিউমারে ওই এম.আর.এফ নামক যন্ত্র দিয়ে সার্জারি করছিলেন।