নেপাল ক্রিকেটের নিল আর্মস্ট্রং

নেপাল ক্রিকেটের এই আইকন নেপাল ক্রিকেটকে শূন্য থেকে আজ এতোদূর নিয়ে এসেছেন। নেপাল ক্রিকেটের এই পথ পাড়ি দেওয়ার অন্যতম কারিগর পরশ খাদকা। বেশিরভাগ ম্যাচেই নিজের একক পারফরম্যান্স দিয়ে দলকে জিতিয়েছেন তিনি। সহযোগী দেশের হয়ে খেলায় কখনোই সেভাবে সুযোগ-সুবিধা পাননি তিনি। হয়তো ফুটবলার হলে ক্যারিয়ারটা আরো সমৃদ্ধ হতে পারতে এই ভেবে একটা আক্ষেপ তিনি করতেই পারেন। তবে নেপাল ক্রিকেট যত উপরের দিকেই যাবে; এই উন্নতির পিছনে সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত হবে পরশ খাড়কার নাম।

১৯৯৬ সালে গঠিত হয় নেপাল ক্রিকেট বোর্ড। আইসিসির সহযোগী দেশ হিসেবেই ক্রিকেট পরিচালনা করতো নেপাল। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থা (আইসিসি) স্বীকৃত ক্রিকেট খেলতে দেশটির অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় ১৮ বছর! ২০১৪ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে হংকংয়ের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম স্বীকৃত ম্যাচ খেলে নেপাল। আর সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন পরশ খাড়কা।

সদ্যই তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন। ২০১৪ সালে আইসিসি স্বীকৃত ক্রিকেটে খেলা শুরু করলেও নেপালের হয়ে ২০০৪ সাল থেকেই জাতীয় দলে খেলছেন পরশ। সময়ের দিক থেকে প্রায় ১৭ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ার হলেও ম্যাচ সংখ্যায় সেটা বেশ ঠুনকোই বটে। সহযোগী দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলায় খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি তিনি। তবে ছোট দলের বড় তারকারদের একজন হিসেবে নিজেকে রেখে গেছেন এই অলরাউন্ডার। মূলত মিডিয়াম পেস বোলিংয়ের পাশাপাশি ছিলেন একজন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান।

২৪ অক্টোবর, ১৯৮৭। নেপালের কাঠমুন্ডুতে জন্মগ্রহণ করেন পরশ খাড়কা। ছেলেবেলা থেকেই খেলার নেশা ছিলো তাঁর। দিনের বেশিরভাগ সময়ই থাকতেন খেলার সাথে। স্কুলের আগে-পরে সবসময়ই খেলার দিকেই মনযোগ থাকতো তাঁর। ছেলেবেলার বেশিরভাগ সময়ই তিনি ক্রিকেট খেলে কাটিয়েছেন।

অবশ্য এটাকে তাঁর সৌভাগ্য বলা চলে! কারণ পরশের পরিবার তাঁকে কখনোই ক্রিকেট খেলতে বাধা দেয়নি। এমনকি বেশ সমর্থনও পেয়েছেন পরিবার থেকে। ছোটবেলায় ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক থাকলেও পরশ চেয়েছিলেন আর্কিটেকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। স্বপ্ন ছিলো একজন ইঞ্জিনিয়ার হবেন। তবে সময়ের কারণে ডিগ্রি সম্পূর্ণ করতে পারেননি তিনি। এমনকি এমবিএ করার ইচ্ছেও ছিলো তাঁর।

২০০২ সালের অনূর্দ্ধ-১৯ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশকে হারানোর পর নেপালে তখন ক্রিকেটকে বেশ প্রাধান্য দেওয়া শুরু হয়। পরশ খাড়কার বয়স তখন মাত্র ১৪। ওই সময়ে নেপাল অনূর্দ্ধ-১৯ দলের অধিনায়ক বিনোদ দাশকে দেখে ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন দেখেন তিনি। স্বপ্ন দেখতে থাকেন একদিন নেপালের ত্রিভুবন স্টেডিয়ামে খেলবেন! অবশ্য সেটি বাস্তবে রুপ নিতে খুব বেশি সময় নেয়নি। পরের বছরই সেই মাঠে খেলার সুযোগ পান পরশ।

২০০২ সালে আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৫ দলে প্রথমবার নেপালের জার্সি গায়ে মাঠে নামেন তিনি। এরপর ২০০৪ সালেই নেপাল অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলেন তিনি। টানা তিন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলার পথে নেপাল ক্রিকেটকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেন পরশ। ওই তিন টুর্নামেন্টে ১৭ ম্যাচে ২৩ উইকেট শিকার করেন তিনি। এবং ১৩ ম্যাচে ব্যাট হাতে ২২.৮৩ গড়ে ২৭৪ রান করেন।

২০০৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ২০০৬ সালে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে এই টুর্নামেন্টে প্লেট চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করে নেপাল। ২০০৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে প্লেট জয়ের পর প্রত্যেক নেপালি ক্রিকেটারকেই মোটরবাইক দেওয়া হয় দেশটির পক্ষ থেকে।

১৬ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন পরশ। তখন থেকেই নেপাল ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অস্ত্র তিনি। ২০০৪, ২০০৬ এবং ২০০৮ টানা তিনটি অনূর্দ্ধ-১৯ বিশ্বকাপে খেলেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নেপালের এই প্রথম অধিনায়ক বল হাতেও নেপালের হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক উইকেট শিকার করেন!

ক্রিকেট ছাড়াও বাস্কেটবল এবং ফুটবলের প্রতি বেশ ঝোঁক ছিলো পরশের। ক্রিকেটের অফ মৌসুমে তিনি প্রায় বাস্কেটবল খেলে থাকেন। পরশের মতে বাস্কেটবল তাঁর ফিটনেস ধরে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া অষ্টম গ্রেডে পড়ার সময় তিনি জাতীয় ফুটবল দলে খেলার চেষ্টাও করেন। ট্রায়ালও দিয়েছিলেন! তবে ক্রিকেটের প্রতি বেশি সিরিয়াস থাকায় সেখান থেকে চলে আসেন তিনি।

২০১৪ সালে নেপালের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে ব্যাট হাতে ৩৭ বলে ৪১ রানের পাশাপাশি বল হাতে এক উইকেট শিকার করেন পরশ। সেই সাথে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচেই দলকে ৮০ রানের বড় জয় এনে দেন তিনি। সেই ম্যাচে ইনিংসের প্রথম বলও করেন তিনি! এবং প্রথম বলেই হংকং ওপেনার ইরফান আহমেদকে ফেরান তিনি। টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের দশম ক্রিকেটার হিসেবে ক্যারিয়ারের প্রথম বলে উইকেট শিকার করেন তিনি।

খাড়কার সবচেয়ে প্রিয় ক্রিকেটারদের একজন হলেন অজি গ্রেট অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। এছাড়া আরো আছেন শচীন টেন্ডুলকার এবং ব্রায়ান লারা। লর্ডসে এমসিসির (মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব) বিপক্ষে ম্যাচের সময় লন্ডনে শচীনের দেখা পান তিনি। অজি ক্রিকেটের বড় ভক্ত তিনি। এছাড়া ফুটবলে ইংলিশ ক্লাব লিভারপুলের একজন সমর্থক পরশ ।

২০১২ এসিসি ট্রফিতে ৬ষ্ঠ নেপালি ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। কুয়েতের বিপক্ষে ৭৭ বলে ১০৬ রানের দাপুটে এক ইনিংস খেলেন পরশ। তার অধীনেই ২০১০ আইসিসি ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট ডিভিশন লিগ ফাইভে জয়লাভ করে নেপাল।

এছাড়া মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ২০১২ আইসিসি ওয়ার্ল্ডকাপ ডিভিশন লিগ ফোর, আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত ২০১২ এসিসি ট্রফি এলিট, ২০১২ আইসিসি ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগ ডিভিশন থ্রি-তে তারই অধীনে জয় পায় নেপাল। ২০১৩ এসিসি টি-টোয়েন্টিকাপে ৪১ গড়ে ২০৭ রান করে ম্যান অব দ্যা টুর্নামেন্ট নির্বাচিত হন। পবর্তীতে ২০১৪ আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টি-টোয়েন্টি স্ট্যাটাস লাভ করে নেপাল।

ইংলিশ ক্রিকেটারদের বাইরে যুবরাজ সিং ছাড়া পরশ একমাত্র ক্রিকেটার যিনি ২০১৫ এমসিসি স্কোয়াডের হয়ে খেলেন। অবশ্য এর পেছনে একটা কারণও ছিলো। ২০১৫ সালের শুরুতে লন্ডনে বন্ধুর সাথে একদিন ঘুরাফেরা করছিলেন পরশ। সেসময় হটাৎ করে তারা লর্ডস স্টেডিয়ামে ঘুরতে যায়।

সেখানে এমসিসির প্রেসিডেন্ট মাইক গ্যাটিং ও এমসিসির আরেক কর্মকর্তা জন স্টিফেনসনের সাথে দেখা হয় তাঁর। সেই কল্যানেই তিনি স্কোয়াডে সুযোগ পেয়েছিলেন বলে শোনা যায়। এরপর ২০১৭ সালে জুলাইতে লর্ডসে খাড়কার নেতৃত্বে ওয়ানডেতে মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবকে হারায় নেপাল। পরশের ব্যক্তিগত ৩০ রানে ৪১ রানের জয় পায় নেপাল।

১৫ মার্চ, ২০১৮। প্রথমবার ওয়ানডে স্ট্যাটাস লাভ করে নেপাল ক্রিকেট। একই সাথে ২০১৫ বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব পর্যন্ত পাওয়া টি-টোয়েন্টি স্ট্যাটাসও পুনরায় লাভ করে তারা। এর প্রায় চার মাস পরই ওই বছর ১ আগস্ট নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ খেলে নেপাল। টি-টোয়েন্টির পর নিজেদের প্রথম ওয়ানডেতেও দলকে নেতৃত্ব দেন পরশ। ওই ম্যাচে নেপাল ৫৪ রানে হারলেও ২৬ রানে চার উইকেট শিকার করেন পরশ।

পরশ নেপালের হয়ে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডেতে সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন। ওয়ানডেতে ১০ ম্যাচে ৩৫ গড়ে ৩১৫ রান করেন তিনি। আছে ১ সেঞ্চুরি ও ১ ফিফটি। ৩৩ টি-টোয়েন্টিতে প্রায় ২৮ গড়ে করেছেন ৭৯৯ রান। যার মধ্যে করেছেন ১ সেঞ্চুরি ও ৪ ফিফটি।

এছাড়া ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রায় শ’খানেক ম্যাচ খেলে করেছেন ৩ হাজারের কাছাকাছি রান। বল হাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শিকার করেছেন ১৮ উইকেট। যার মাঝে ওয়ানডেতে আছে ক্যারিয়ার সেরা নেদারল্যান্ডসে বিপক্ষে সেই ২৬ রানে ৪ উইকেট।

নেপাল ক্রিকেটের এই আইকন নেপাল ক্রিকেটকে শূন্য থেকে আজ এতোদূর নিয়ে এসেছেন। নেপাল ক্রিকেটের এই পথ পাড়ি দেওয়ার অন্যতম কারিগর পরশ খাড়কা। বেশিরভাগ ম্যাচেই নিজের একক পারফরম্যান্স দিয়ে দলকে জিতিয়েছেন তিনি।

সহযোগী দেশের হয়ে খেলায় কখনোই সেভাবে সুযোগ-সুবিধা পাননি তিনি। হয়তো ফুটবলার হলে ক্যারিয়ারটা আরো সমৃদ্ধ হতে পারতে এই ভেবে একটা আক্ষেপ তিনি করতেই পারেন। তবে নেপাল ক্রিকেট যত উপরের দিকেই যাবে; এই উন্নতির পিছনে সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত হবে পরশ খাড়কার নাম।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...