ম্যাচ নাকি খেলোয়াড়রা জেতায় ম্যানেজাররা নয়। আসলেই কি তাই? হ্যা, ম্যানেজার হয়তো মাঠে খেলোয়াড়দের মতন দৌড়ান না অথবা খেলোয়াড়দের মতো কোনো বিশেষ মুহূর্ত তৈরি করতে পারেন না। কিন্তু মাঠে খেলোয়াড়েরা যেসকল কারিকুরি দেখান তার পেছনের কারিগর হিসেবে থাকেন ম্যানেজারেরা।
একুশ শতকে এমন অনেক তারকা ম্যানেজার রয়েছেন যারা ভক্তদের মনে আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন। তাদের রয়েছে জহুরির চোখ, ম্যাচের পরিস্থিতি পড়তে পারেন অনায়াসে। আবার প্রয়োজন অনুযায়ী খেলা পরিচালনার অসাধারণ দক্ষতাও রয়েছে। এসব কিছুই তাদের আলাদা করেছে বাকিদের থেকে।
- পেপ গার্দিওলা (স্পেন)
পেপ গার্দিওলা তার ম্যানেজেরিয়াল ক্যারিয়ারের মাধ্যমে ফুটবলকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছেন। একুশ শতকের অন্যতম সফল ম্যানেজার তিনি। তিনি যেই দলের ডাগআউটে ছিলেন সেই দলকেই তিনি নিয়ে গেছেন সাফল্যের অন্যতম স্তরে।
তিনি তার ক্যারিয়ারে মোট ১৪টি লিগ শিরোপা জিতেছেন। তার অধীনস্ত দল লালিগা এবং প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষ স্থানে ছিলেন ইতিহাসের সর্বাধিক পয়েন্ট নিয়ে। বুন্দেসলিগার সবথেকে দ্রুততম লিগ জিতে নেওয়ার রেকর্ডটিও রয়েছে তার নামে। তিনি ইতিহাসের একমাত্র ম্যানেজার যিনি এক মৌসুমে ‘সেক্সটুপল’ জিতেছেন।
তিনি বার্সেলোনার এবং সিটির হয়ে ট্রেবল জিতেছেন। ম্যানচেস্টার সিটিকে পেপ তাদের ইতিহাসের প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে সহায়তা করেছেন। এই স্প্যানিশ ম্যানেজার প্রতিনিয়তই তার কৌশলকে শাণিত করে চলেছেন। তিনি তার দলের জন্য নিত্য নতুন কৌশল তৈরিতে পটু।
- কার্লো আনচেলত্তি (ইতালি)
কার্লো আনচেলত্তি একটি বই লিখেছেন, যার নাম-‘Quite Leadership’। এই নামটিই ব্যক্ত করে তার সম্পূর্ণ ম্যানেজেরিয়াল ক্যারিয়ারকে। তার বিপক্ষে হয়েছে অনেক সমালোচনা, খেলার মাঠেও তার বিপক্ষে গিয়েছে অনেক সিদ্ধান্ত। কিন্তু তিনি কখনও টু শব্দটিও করেননি বরং তিনি সবাইকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জবাব দিয়েছেন তার সাফল্য দিয়ে।
তিনি ইতিহাসের একমাত্র ম্যানেজার যিনি ইউরোপের শীর্ষ পাঁচটি লিগের প্রত্যেকটির শিরোপা জিতেছেন। এছাড়াও তিনিই বিশ্বের সর্বাধিক চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জয়ী ম্যানেজার। তিনি মোট ৫টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন ম্যানেজার হিসেবে।
এই ইতালিয়ান ম্যানেজার তার কৌশলগত শক্তিমত্তার বদলে একজন অসাধারণ ম্যান ম্যানেজার হিসেবে সুপরিচিত। যারাই কাজ করেছেন তার সাথে কেবল তারাই জানেন কতটা অসাধারণ দক্ষতার অধিকারী তিনি।
- স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন (স্কটল্যান্ড)
স্যার অ্যালেক্স ফর্গুসন ১৯৯৩ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ২৬ বছর পর লিগ শিরোপা জিততে সহায়তা করেন। তিনি ইউনাইটেডকে ২৭ বছরে ১৩টি লিগ, ৫টি এফএ কাপ এবং ২টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিততে সহায়তা করেছেন। যদি শুধু একুশ শতকের হিসাব করা হয় তাহলেও তিনি অন্য বেশিরভাগ ম্যানেজারের থেকে অধিক শিরোপা জিতেছেন।
তার শূন্যতা আজও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ভোগাচ্ছে। তিনি চলে যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড লিগ শিরোপা এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপার দেখা পায়নি। ঠিক যেমন ফার্গুসন আসার আগে ইউনাইটেডের ২৬ বছর লেগেছিল লিগ শিরোপা জিততে, ঠিক তেমনই হয়তো আবারও ২৬ বছর লাগবে তাদের একই সাফল্য পেতে।
- হোসে মরিনহো (পর্তুগাল)
বিশ্ব ফুটবলে হোসে মরিনহোর একটি আলাদা জায়গা রয়েছে। এই ম্যানেজারের ঝুলিতে রয়েছে অসংখ্য শিরোপা। তিনি পোর্তোর ম্যানেজার হিসেবে অবিশ্বাস্য ভাবে ২০০৪ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিতেছিলেন। গোটা বিশ্ব তখন হয়েছিল বিস্মিত।
‘দ্য স্পেশাল ওয়ান’ খ্যাত এই পর্তুগিজ তার ম্যানেজেরিয়াল ক্যারিয়ারে পোর্তো এবং ইন্টার মিলানের হয়ে ২টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন। তিনি মোট ৮টি লিগ শিরোপা জিতেছেন। যদিও তার ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তিনি বর্তমানে নেই, তবে তার অবদান ফুটবল বিশ্বে অতুলনীয়।
- ইয়ুর্গেন ক্লপ (জার্মানি)
ইয়ুর্গেন ক্লপ তার ম্যানেজেরিয়াল ক্যারিয়ারে ডর্টমুন্ড এবং লিভারপুলের মত ক্লাবগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। তিনি এই দুই ক্লাবকে পরিণত করেছিলেন এক অসামান্য শক্তিতে। তার হাই প্রেসিং এবং দ্রুতগতির খেলা ফুটবল বিশ্বে অন্যতম প্রভাব ফেলেছে।
তিনি ‘গেগেন প্রেসিং’ নামে এক নতুন ধরনের প্রেসিং ফুটবল উদ্ভাবন করেছিলেন। তার এই অসাধারণ কৌশল লিভারপুলকে ৩০ বছর পর লিগ শিরোপা জিততে সাহায্য করেছিল। তিনি লিভারপুলকে ৩ বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে তুলেছিলেন, যার মধ্যে একবার শিরোপা উঠেছিল অলরেডদের হাতে।
ক্লপ তার ম্যানেজেরিয়াল ক্যারিয়ারে মোট ১৩টি শিরোপা জিতেছেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, একটি ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ, দুইটি বুন্দেসলিগা, একটি প্রিমিয়ার লিগ, একটি এফএ কাপ।
একুশ শতকে এই সকল ম্যানেজারেরা ফুটবলের জন্য এক নতুন মানদণ্ড তৈরি করেছেন। তাদের এই অভাবনীয় অবদান ফুটবল বিশ্বের জন্য এক বড় উপহার। এদের মধ্যে অনেকেই প্রতিনিয়ত নিজেদেরকে বিবর্তনে দিয়েছেন মনোযোগ। এখন শুধু দেখার অপেক্ষা তাদের এই যাত্রা কতটা প্রসারিত হয়।