মোস্ট আনসেলিব্রেটেড জায়ান্ট

কিং কমিশনের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়া হ্যানসি ক্রনিয়ের সঙ্গে যেন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটের। ক্রনিয়ে শুধু একজন সাধারণ ক্রিকেটারই ছিলেন না, ছিলেন একজন ক্যারিশমাটিক অধিনায়ক, দলের মধ্যমণি।

কিং কমিশনের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়া হ্যানসি ক্রনিয়ের সঙ্গে যেন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটের। ক্রনিয়ে শুধু একজন সাধারণ ক্রিকেটারই ছিলেন না, ছিলেন একজন ক্যারিশমাটিক অধিনায়ক, দলের মধ্যমণি।

পুরো ক্রিকেটবিশ্ব যখন ক্রনিয়ে কেলেঙ্কারির বিস্ময়ে হতবিহ্বল, দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দল তখন শ্রীলঙ্কায়। ক্রনিয়েকে হারিয়ে ক্রিকেটারদের মনোবল তখন শূন্যের কোঠায়। সিরিজের প্রথম টেস্টে রীতিমতো দক্ষিণ আফ্রিকাকে উড়িয়ে দিল শ্রীলঙ্কা। শঙ্কা, অনিশ্চয়তা আর হতাশার সাগরে তখন নিমজ্জিত দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট।

ইনিংস ব্যবধানে হারের পর সফরের দ্বিতীয় টেস্টেও প্রথম ইনিংসে ৩৪ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে প্রোটিয়ারা। ল্যান্স ক্লুজনার ও মার্ক বাউচারের দারুণ প্রতিরোধও শ্রীলঙ্কাকে লিড নেয়া থেকে আটকাতে পারেনি ৷ দ্বিতীয় ইনিংসেও দুঃস্বপ্নের শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা। নীল ম্যাকেঞ্জি ১, গ্যারি কারস্টেন ১৩ ও ড্যারিল কালিনান ৬ রান করে সাজঘরে ফিরে গেলে আবারও বিপর্যয়ে পড়ে সফরকারীরা।

স্কোরবোর্ড তখন বলছে ৫০ রানে ৩ উইকেট। সামনে বিপদ ভবিতব্য। চোখের সামনে যেন নাটকের স্ক্রিপ্ট ভেসে উঠছে। ৫৫ রানে যাবে ৪ উইকেট, ৭০ রানে ৭টা, তারপর ১২০ রানে অলআউট। হয়তো হার্শেল গিবস, হানসি ক্রনিয়ে থাকলে কিছু একটা প্রতিরোধ করা গড়া যেত। কিন্তু মুত্তিয়া মুরালিধরনের ‘বক্স অফ ট্রিকস’ এর সামনে কে দাঁড়াবে ব্যাট হাতে? কে এড়াবে এই অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যৎ?

তবে ৫৫ রানে চতুর্থ উইকেট পড়েনি, পড়েছিল ১২১ রানে। ১৫৩ রানে পড়েছিল ষষ্ঠ উইকেট, সেখান থেকে ২৩১ রানে অলআউট। চার ঘন্টা ধৈর্য্যের প্রবল পরীক্ষা দিয়ে অবিচল দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন। ভুরিভুরি শতক করেছেন তিনি এরপরে। কিন্তু এই ইনিংসের মাহাত্ম্য অনস্বীকার্য। অথচ যে ইনিংসটি তিন অঙ্কেও পৌঁছায়নি, সেই ৮৭ রানের ইনিংস দিয়ে ডুবতে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য লাইফবোট নিয়ে আবির্ভাব ঘটল জ্যাক হেনরি ক্যালিসের।

ম্যাচটা নাটকীয়ভাবে জিতে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা, শেষপর্যন্ত সিরিজ ড্র হয় ১-১ ব্যবধানে। মুরালির মুলুক থেকে সদ্য নিষিদ্ধ হ্যানসি ক্রনিয়েবিহীন দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট সিরিজ ড্র করা ছিল সম্মানজনক অর্জন৷ আর এই অর্জনের অন্যতম প্রধান কারিগর ছিলেন ক্যালিস।

টালমাটাল দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটকে শক্ত অবস্থানে দাঁড় করানোর জন্য প্রয়োজন ছিল একজন দৃঢ়চিত্ত পারফর্মারের৷ সে সময় ত্রাতা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ক্যালিস। ক্যালিস যদি না থাকতেন তবে কী হত?

অ্যালান ডোনাল্ড যখন অবসর নেন, তখন টেস্ট ক্রিকেটে ১২৬৬ ওভার বল করে ফেলেছিলেন ক্যালিস৷ ক্যালিস না থাকলে ডোনাল্ডকে হয়তো তারও দু’বছর আগে থেকে উইকেট পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করতে হতো। কেননা অপরপ্রান্ত থেকে সমর্থনটা দেয়ার কেউ থাকত না। কিংবা ক্যালিসবিহীন দক্ষিণ আফ্রিকা দলে শন পোলককে ব্যাট হাতে নিতে হত আরও বড় দায়িত্ব। কে জানে তখন বল হাতে এতটা সফল হতে পারতেন কি না, হয়তো বা অবসর নিয়ে নিতেন আরও তিন বছর আগেই।

২২ বছর বয়সী গ্রায়েম স্মিথের কথা চিন্তা করুন। ডেল স্টেইন-মাখায়া এনটিনির তারুণ্যদীপ্ত গতিকে সমর্থন দেয়ার জন্য তার প্রয়োজন ছিল একজন শক্তসামর্থ ব্যাটসম্যান।

জ্যাক ক্যালিস কিন্তু নিজের সামর্থ্যের সবটুকুই দিয়েছিলেন। তবে কেন তাকে ঘিরে এতটা আলোচনা নেই? কেন দক্ষিণ আফ্রিকানদের ভালোবাসা সেভাবে পান না ক্যালিস?

নিজের শেষ টেস্টে ক্যারিয়ারের ৪৫ তম সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে যখন ব্যাট উঁচিয়ে ধরেছিলেন, তখন ডারবানের কিংসমিডে হাততালি দেয়ার জন্য ছিল কেবলমাত্র হাজার সাতেক দর্শক। একাই ব্যাট হাতে রাহুল দ্রাবিড় আর বল হাতে ডেরেক আন্ডারউডের সমকক্ষ জ্যাক ক্যালিসকে বিদায় দিতে মাঠে কেবল সাত হাজার দর্শক!

তাঁদের অভিযোগ একবিংশ শতাব্দীতে ক্রিকেটের আধুনিকায়নের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি ক্যালিস৷ সবাই যখন আক্রমণাত্মক ক্রিকেটকে মনেপ্রাণে আঁকড়ে ধরেছিল, তখন ক্যালিস কেন ধ্রুপদী রক্ষণাত্মক ক্রিকেটকে বেছে নিলেন?

চলুন উত্তর খোঁজা যাক। রিকি পন্টিং যখন অস্ট্রেলিয়া দলে আসেন, তখন তার সামনে-পেছনে কারা ছিলেন? মার্ক টেইলর, মাইকেল স্ল্যাটার, ওয়াহ ভ্রাতৃদ্বয়। ফলে ব্যর্থ হলেও সম্ভাবনাময় তরুণ পন্টিংকে সুযোগ না দেয়ার কোন কারণ ছিল না।

কিন্তু জ্যাক ক্যালিস কী পেয়েছিলেন? এমন একটা ব্যাটিং লাইনআপ যারা একরকম জানতোই না কীভাবে টেস্টে ব্যাট করতে হয়। সেক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলার চেয়ে উইকেট বাঁচিয়ে খেলাটাই কি যুক্তিযুক্ত ছিল না?

পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই। ইনিংসের ৪৯ রানের মধ্যে দুই উইকেট চলে গিয়েছে এমন পরিস্থিতিতে চার নাম্বার ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্যালিস করেছেন ১৪ সেঞ্চুরি ও ১০ হাফ সেঞ্চুরি। অর্থাৎ অধিকাংশ সময়েই বিপর্যয়ের মুখে ক্যালিস অর্ধশতককে রূপান্তর করেছেন শতকে।

তার সমসাময়িক ব্যাটসম্যানদের পারফরম্যান্স কিছুটা পর্যালোচনা করা যাক। ১৯৯৯ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহক ছিলেন ক্যালিস। এসময়টাতে ৬৫ গড়ে রান করেছিলেন তিনি। নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যারি কারস্টেনের সাথে তার গড়ের পার্থক্য ১৪। এ সময়ে দলের রানের শতকরা ১৬ শতাংশ এসেছিল ক্যালিসের ব্যাট থেকে, যা দলের যেকোন ব্যাটসম্যানের চাইতে অন্তত পাঁচ শতাংশ বেশি।

ক্যালিস বছরের পর বছর রান করেছেন, উইকেট নিয়েছেন। কিন্তু রানে এগিয়ে ছিলেন শচীন, ভালোবাসায়ও তাই। ক্যালিসের ব্যাটিং ছিল চোখের জন্য শান্তিদায়ক, কিন্তু এখানেও তাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন ব্রায়ান লারা। তার নিজের দলে ছিলেন সফল অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ, ততদিনে দলে থিতু হয়ে গিয়েছিলেন চিরধারাবাহিক হাশিম আমলা, বিধ্বংসী এবি ডি ভিলিয়ার্স। এত জনের মাঝে ভালোবাসা বাঁটতে গিয়ে বোধহয় ক্যালিসের জন্য তেমন কিছু অবশিষ্ট ছিল না। তাই তো পঁচিশ হাজার আন্তর্জাতিক রান আর সাড়ে পাঁচশো আন্তর্জাতিক উইকেট নেয়া কিংবদন্তি ক্রিকেটারকে বিদায় দিতে এল কেবল সাত হাজার অনুরাগী?

জেমস অ্যান্ডারসন ওল্ড ট্রাফোর্ডে ‘জেমস অ্যান্ডারসন’ প্রান্ত থেকে বোলিং করতে পারেন, সেন্ট লুসিয়ায় ড্যারেন স্যামি তার নামে নামান্তরিত স্টেডিয়ামে খেলতে পারেন। কেনসিংটন ওভালের দুই প্রান্তের একটি নামকরণ করা হয়েছে জোয়েল গার্নার, অপরটি ম্যালকম মার্শালের নামে। তারপর একটা স্ট্যান্ডের নামকরণ করা হয়েছে স্যার গ্যারি সোবার্সের নামে। ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে আছে শচীন টেন্ডুলকারের স্ট্যান্ড।

অথচ নিউল্যান্ডসে কোথাও কেন নেই জ্যাক ক্যালিসের নাম? রাজনীতি, সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য? ক্রীড়ামন্ত্রীর তথা সরকারের অন্যায় নিয়মের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার জন্য? হবে হয়তো তাই। খেলোয়াড়ি জীবনে তো তাই শিখেছেন ক্যালিস; স্বচ্ছতা ও সততার ওপরে কিছু নেই। তাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে একপ্রস্থ ভাবার প্রয়োজন হয়নি তার।

জ্যাক ক্যালিস ব্যাট হাতে, বল হাতে অনুপ্রাণিত করে গিয়েছেন একটা প্রজন্মকে৷ ভাবুন সে সময় ক্যালিস না থাকলে কীভাবে তলিয়ে যেত দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট? কুইন্টন ডি কক হয়তো কাজ করতেন টেলিফোন অপারেটর হিসেবে, এইডেন মার্করাম হয়তো পাড়ি জমাতেন অস্ট্রেলিয়ায়, ভারনন ফিল্যান্ডার হয়তো এতদিনে ইংল্যান্ডের হয়ে অবসরও নিয়ে ফেলতেন।

তবু দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটের মেরুদণ্ড সে অনুপাতে পাননি ভালোবাসা। তাই পরিসংখ্যানের পাতায় অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা আর রেকর্ড নিয়ে জ্যাক হেনরি ক্যালিস হয়ে থাকবেন ক্রিকেটের ‘মোস্ট আনসেলিব্রেটেড জায়ান্ট’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link