২০০৮-০৯ মৌসুমের রঞ্জি ট্রফির ফাইনাল ম্যাচ।
ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথমবার শূন্য রানে আউট হয়ে ফিরলেন দেশটির ক্রিকেট ঈশ্বর শচীন টেন্ডুলকার। শচীনকে সেদিন রানের খাতা খুলতে দেয়নি ১৮ বছর বয়সী ছোট্ট এক ছেলে। ছোট-খাটো গড়নের সেই বাচ্চা ছেলেটা কয়েক বছর পরেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পন করেন রাজার বেশে। পরবর্তীকালে যত দিন গিয়েছে নিজেকে তত শাণিত করেছেন সেদিনের ছোট্ট ভূবনেশ্বর কুমার।
উত্তর প্রদেশের প্রাচীন এক শহর মেরুটে ১৯৯০ সালে জন্মগ্রহণ করেন ভূবনেশ্বর। মেরুট শহর বিখ্যাত ক্রীড়া সামগ্রী তৈরির জন্য। বিশ্বের নামী-দামী ব্যাটসম্যানরা তাঁদের ব্যাট বানিয়ে নিয়ে যান মেরুট শহর থেকে। এসএস, এসএফ কিংবা এসজির মত জনপ্রিয় স্পোর্টস কোম্পানি গুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই মেরুট শহরে। তবে ছোট্ট ভূবির জন্য বোধহয় একটা ছোট্ট বলই বেশি পছন্দ হয়েছিল তাঁর বড় বোনের।
ভুবনেশ্বর কুমারের বড় বোনের নাম রেখা আধানা। তিনিই ছোট ভাইকে মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রথম ক্রিকেট কোচিংএ নিয়ে যান। বোনের হাত ধরে মেরুটের বড় মাঠটায় গিয়েছিলেন সেদিনের ভুবি। তবে সেই ভুবি আজ খেলে বেড়ান বিশ্বের ঐতিহাসিক সব মাঠে। তাঁর স্যুইং কাঁপন ধরায় বিশ্বের নামী-দামী ব্যাটসম্যানের বুকে।
সবার কাছে তিনি এখন বিশ্ব ক্রিকেটের মহাতারকা। বড় বোন রেখা আধানাও হয়তো বুঝতে পারেন ভুবি আর ছোট নেই। তবুও তো মেরুটের বুকের উপর দিয়ে যখন হেঁটে যান তখন নিশ্চই তাঁর হাত ধরে থাকা ছোট্ট ভুবির কথাই মনে পড়ে।
খুব দ্রুতই ক্রিকেটের নানা পরীক্ষা উৎরাতে থাকেন তিনি। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন উত্তর প্রদেশের হয়ে। বলের গতি খুব বেশি না হলেও স্যুইং দিয়ে আদায় করে নিয়েছিলেন ব্যাটসম্যানদের সমীহ। ঘরোয়া ক্রিকেটে দ্রুতই হয়ে ওঠেন পরিচিত নাম। ব্যাট হাতে প্রায়ই লোয়ার অর্ডারে রান করতে দেখা যেত তাঁকে। তবে বিস্ফোরণটা হয় যখন ভারতের প্রথম বোলার হিসেবে ঘরোয়া ক্রিকেটে শচীনকে শূন্য রানে আউট করলেন। তাও আবার রঞ্জি ট্রফির ফাইনাল ম্যাচে।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অভিষেক হয়ে ২২ বছর বয়সী ভুবির। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের প্রথম ওভারেই বোল্ড করেন নাসির জামসেদকে। এছাড়া ওই ম্যাচে চার ওভারে মাত্র ৯ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ৩ উইকেট। ওয়ানডে ক্রিকেটে নিজের প্রথম বলেই বোল্ড করেন মোহম্মদ হাফিজকে। ফলে আন্তর্জাতিক আঙিনায় ভুবির যাত্রাটা হয়েছিল নবাবী কায়দায়।
২০১৩ সালে বর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন ভুবি। সেই সিরিজে চার ম্যাচে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। চেন্নাইয়ের স্পিন সহায়ক উইকেটেও নিজের কার্যকারিতে দেখিয়েছিলেন। এছাড়া ওই সিরিজে নবম উইকেট জুটিতে মহেন্দ্র সিং ধোনির সাথে করেছিলেন রেকর্ড পার্টনারশিপ। দশ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে খেলেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ৩৮ রানের ইনিংস।
২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও দারুণ পারফর্মেন্স করেছিলেন তিনি। এছাড়া সে বছরই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ৮ রান দিয়ে নেন চার উইকেট। পরের বছর ইংল্যান্ড সফরে ব্যাট-বল দুই ডিপার্টমেন্টেই নিজের সেরাটা দিয়েছিলেন। প্রথম টেস্টে খেলেন ৫৮ ও ৬৩ রানের দুইটি ইনিংস। ওই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে বল হাতেও নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। পরের ম্যাচের আবার হাফ সেঞ্চুরি করার পাশাপাশি নেন ৫ উইকেট। লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৮২ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট।
২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও জাসপ্রিত বুমরাহর সাথে ভারতের বোলিং আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। ওই আসরে তাঁদের দুর্দান্ত বোলিং এ ফাইনাল খেলেছিল ভারত। ২০১৭ সালের বিশ্ব ওয়ানডে একাদশেও জায়গা করে নিয়েছিলেন এই পেসার। পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে নেন ৫ উইকেট।
সব মিলিয়ে সাদা বলের ক্রিকেটে ভারতের অনন্য এক আবিষ্কার ভূবনেশ্বর কুমার। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে নিয়মিত তিনি নিজেকে প্রমাণ করে যাচ্ছেন। আবার এর মানে যে তিনি টেস্টে অচল – সেটাও হলফ করে বলা যাবে না।
তবে এসবের বাইরের ভারতীয় ক্রিকেটের ভক্তদের জন্য ভুবি এক অন্য অনুভূতি। দুই দিকে বল স্যুইং করানো এই ভুবিই আবার ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের যম। ইনজুরির কারণে ক্যারিয়ারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে ছিটকে গিয়েছিলেন। তবুও তাঁর কদর ভিন্ন জায়গায়। এক সময় পেস খরার দেশ ভারত যে এখন পেসার তৈরির উর্বর ভূমিতে তৈরি হয়েছে তাঁর শুরুর দিককার প্রমাণ তো মেরুটের এই ভুবনেশ্বর কুমারই ।