আশাজাগানিয়া ব্রিটিশ আক্ষেপ

বিল অ্যাথে – আশি ও নব্বইয়ের দশকে ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটের বেশ পরিচিত এক নাম। একসময় ছিলেন বেশ সম্ভাবনাময়ী একজন। অল্প বয়সেই তাঁর পারফরম্যান্স দেখে অনেকে তাঁকে ভেবে ফেলেছিলেন ইংল্যান্ড ক্রিকেটের ভবিষ্যত! কিন্তু সময়ের বিবর্তনে সেই সম্ভাবনা পরিণত হয় আক্ষেপে। পাল্টে যায় অ্যাথের পুরো ক্যারিয়ার গ্রাফ!

মাত্র ১৯ বছর বয়সেই কাউন্টি ক্রিকেটে ইয়র্কশায়ারের প্রথম একাদশে সুযোগ পান তিনি। ঘরোয়া ক্রিকেট নিজেকে নিয়ে যাচ্ছিলেন সফলতার শীর্ষে। কিন্তু ভিন্ন চিত্র ছিলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে! স্টাইলিশ ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি ফিল্ডিংয়ে ছিলেন বেশ দুর্দান্ত। মাঝেসাঝে পার্ট টাইমার হিসেবে মিডিয়াম পেসারের কাজটাও করতেন।

ইয়র্কশায়ারে তিনি স্যার লিওনার্ড হাটন, জিওফ বয়কটের মতো তারকাদের সাথে ড্রেসিং রুম শেয়ার করেছেন। সেসময় অবশ্য ইয়র্কশায়ারের সবচেয়ে বড় তারকাই ছিলেন বয়কট। বয়কটের মতো মেন্টর দলে পেয়ে বেশ দ্রুতই ঘরোয়া ক্রিকেটে সফলতার মুখ দেখেন অ্যাথে। ১৯৭৬ সালে সেসময় টেস্ট ও কাউন্টি ক্রিকেট বোর্ড (বর্তমানে ইংল্যান্ড ও ওয়েলশ ক্রিকেট বোর্ড –  ইসিবি) দারুণ এক সুযোগ করে দেয় বেশ ক’জন সম্ভাবনাময় ক্রিকেটারকে।

মাইক গ্যাটিং, ইয়ান বোথাম, গ্রাহাম স্টিভেনসন ও বিল অ্যাথের মতো চার তরুনকে সেসময়ে ইংল্যান্ড ক্রিকেটের ভবিষ্যত চিন্তা করে স্কলারশিপে পাঠানো হয় অস্ট্রেলিয়ায়। তিন মাসের ওই কোর্সে বেশ কিছু শিক্ষা মাথায় নিয়ে ফিরেন অ্যাথে। ফেরার পরে সাত মৌসুমে ইয়র্কশায়ারের হয়ে ৬ হাজারের বেশি রান করেন তিনি! ছিলো ১০ সেঞ্চুরি। ইয়ান বোথাম অবশ্য ততোদিনে ইংল্যান্ড ক্রিকেটে বেশ পরিচিত এক নাম। ধীরে ধীরে বোথাম পেয়ে যান অধিনায়কত্ব!

২৮ আগস্ট, ১৯৮০। কমেন্ট্রি বক্সে সেদিন জন আর্লটের শেষদিন। মাইক ছেড়ে শেষ বয়সটা নিজের মতো করে কাটাতে চেয়েছিলেন আরলট; তাই এমন সিদ্ধান্ত। আর ওইদিনই ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে অভিষিক্ত হন বিল অ্যাথে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লর্ডসে ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্টে সুযোগ পান তিনি। অবশ্য বৃষ্টিতে ভেস্তে গিয়েছিলো প্রথম তিন দিন! এর সপ্তাহখানেক আগেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুই ওয়ানডেতে খেলেন তিনি।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের তখন দল নিয়ে ভাবনায় ইসিবি। সেসময়ে দলের অধিনায়ক ইয়ান বোথাম নির্বাচকদের কাছে বললেন অ্যাথেকে দলে রাখতে! কিন্তু, মিডলসেক্সের রোনাল্ড বুচারকে দলে নিতে বেশ মরিয়া ছিলেন নির্বাচকরা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে অ্যাথে দাঁড়াতে পারবে কিনা সে নিয়েও সন্দিহান ছিলেন অনেকে। বোথামের কথায় অ্যাথেকে দলে রাখা হলো যদিও স্রেফ রিজার্ভ প্লেয়ার হিসেবে! শেষ পর্যন্ত কপাল খুলে যায় অ্যাথের। ব্রায়ান রোজের ইনজুরিতে বাধ্য হয়েই দলে ডাকতে হয় অ্যাথেকে।

অ্যান্টিগা ও জ্যামাইকা টেস্টে দলে সুযোগও পেলেন। আর চার ইনিংসে তিনি করেছিলেন মোটে সাত রান! এরপরই দল থেকে বাদ পড়লেন লম্বা সময়ের জন্য। অ্যাথের পারফরম্যান্সে বেশ হতাশ হন বোথামও। পরের পাঁচ বছরের জন্য আর জাতীয় দলে ফিরতে পারেননি অ্যাথে। তবে, ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স করে ১৯৮৬ সালে আবারো কামব্যাক করেন তিনি। এর পরের দুই বছর ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে সেরা সময় পার করেন অ্যাথে!

১৯৮৬ এর অ্যাশেজ সিরিজে মিডল অর্ডার থেকে ওপেনিংয়ে জায়গা পান অ্যাথে। ক্রিস ব্রডের সাথে ওপেনিংয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেন তিনি। ব্রিসবেনে প্রথম টেস্টে ফিফটির পর দ্বিতীয় টেস্টে পার্থে খেলেন ৯৬ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। অবশ্য মাত্র ৪ রানের জন্য ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি বঞ্চিত হন তিনি। এমনকি পরের অ্যাডিলেড টেস্টেও ফিফটির দেখান পান অ্যাথে। শেষ টেস্টে মেলবোর্নে জয়ে ইংলিশরা সেবার অ্যাশেজ নিজেদের করে নেয়। ওই টেস্টে মাত্র ২১ রান করলেও অ্যাথের কাছে ওই সিরিজই সেরা স্মৃতি।

ওই সিরিজে ৪ টেস্টে ৩৩.৬৬ গড়ে ৩০৩ রান করেন অ্যাথে। ওই সিরিজে তার আরেক ওপেনিং পার্টনার ক্রিস ব্রড ৬৯ গড়ে করেন ৪৮৭ রান। এই দুই ওপেনারের কল্যানেই সেবার অ্যাশেজে দুর্দান্ত পারফরম করে ইংলিশরা। ওয়ানডেতেও ছিলেন দারুন ফর্মে। কামব্যাক করার বছরই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জুড়ে দেন ১৪২ রানের দাপুটে ইনিংস। ওই সময়ের জন্য যা ছিল অবিশ্বাস্য এক ইনিংস। এরপর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেঞ্চুরি ও আরেক সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে করেন ফিফটি।

১৯৮৭ বিশ্বকাপের আগে পাকিস্তানের মাটিতে মেইডেন টেস্ট সেঞ্চুরির দেখা পান অ্যাথে। অবশ্য এটি তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ সেঞ্চুরিও ছিলো! পরে বিশ্বকাপের মঞ্চে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮৬ রানের ইনিংসের পাশাপাশি বেশ কিছু ইমপ্যাক্টফুল ইনিংসও খেলেন তিনি। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৫৮ রানের ইনিংস খেললেও দলকে জেতাতে পারেননি শিরোপা।

১৯৮৬-৮৮ এই দুই বছরে ২০ টেস্টে মোটে এক টেস্ট মিস করেন অ্যাথে। এছাড়া বাকি সময় দলের নিয়মিত মুখ ছিলেন তিনি। ইংল্যান্ডের হয়ে ২৩ টেস্টে ২৩ গড়ে ৯১৯ রান করেন অ্যাথে। অপরদিকে, ৪৬৭ ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচে প্রায় ৩৬ গড়ে ২৫ হাজারের বেশি রান করেছেন তিনি। সাদা পোশাকের মতো রঙিন জার্সিতেও খেলতে পারেননি খুব বেশি ম্যাচ। ৩১ ম্যাচে ৩১ গড়ে করেছেন ৮৪৮ রান!

১৯৮৭ বিশ্বকাপের পর অ্যাথের পারফরম্যান্স ক্রমাগত নিচে নামতে থাকে। পরের পাঁচ ওয়ানডেতে করেন মোটে ৩০ রান। টেস্টে ওই সময়ের কয়েক ম্যাচে সর্বোচ্চ ছিলো মাত্র ৩৭ রান! তখনি নতুনদের সুযোগ দিতে দলে কিছু পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিলো ইসিবি। হতাশাজনক পারফরম্যান্সে দল থেকে বাদ পড়লেন অ্যাথে। আট বছরের ক্যারিয়ারে খেলেন মাত্র ২৩ টেস্ট! এরপর আর কখনোই জাতীয় দলে ফিরতে পারেননি তিনি।

তবে, ঘরোয়া ক্রিকেটে আরো প্রায় বছর দশেক খেলা চালিয়ে যান! ইয়র্কশায়ার থেকে ১৯৮৪ সালে এক বিবাদে পাড়ি দেন গ্লষ্টারশায়ারে। সেখানে ১৯৮৯ সালে গ্লষ্টারশায়ারের হয়ে অধিনায়কের দায়িত্ব পান তিনি। টানা চার সেঞ্চুরিও করেন তিনি! সবশেষে ১৯৯৩ সালে যান সাসেক্সে। সেখানেই ঘরোয়া ক্রিকেটে ২৫ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। ১৯৯৭ সালে ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে বিদায় জানান ঘরোয়া ক্রিকেটের এই তারকা।

ক্যারিয়ারের শুরুতে অনেক আশা দেখালেও ক্যারিয়ার শেষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অর্জনটা সামর্থ্যের তুলনায় ছিলো সামান্যই! একই সাথে স্কলারশিপে ক্রিকেট প্রশিক্ষণ নিতে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়া বোথাম নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা ক্রিকেট ব্যক্তিত্বে। শুধু হারিয়ে যান অ্যাথেই! যিনি ইংল্যান্ড ক্রিকেটের এক আশাজাগানিয়া আক্ষেপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link