১৪-ই ডিসেম্বর, ১৯৬৩ সাল।
সুনশান-নিস্তব্ধ রাস্তা, মাঝেমধ্যে একটি দুইটি গাড়ি শব্দ করে ছুটে যাচ্ছে, এরপর আবার নিস্তব্ধতার শুরু। টিমটিম করে হলুদ আলোগুলি জ্বলছে। দূরে তাকালে মূল শহরের ব্যস্ততা টের পাওয়া যায়, তাও দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর। এইমাত্র একটি বার বন্ধ হয়ে গেলো, হোমলেস একজন মানুষ দ্রুত জায়গা করে নিলো বন্ধ হওয়া বারটির পাশে মৃদু অন্ধকারাচ্ছন্ন ছোট একটি ফুটপাথে।
ঠিক এখান থেকেই হাতের ডানদিকে মাঝারি ধাঁচের যে হোটেলটি চুপ করে দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছে, গোড়ালি উঁচু করে উঁকি মারলেই দেখা যায় কষ্টেসৃষ্টে- সেই হোটেলের ভেতর একটি রুমের বাতি জ্বলছে। ভারী পর্দা ভেদ করে বিপন্ন যৌবনের মত আলো বের হয়ে আসার বৃথা চেষ্টা; রেকলেস এই আলোতে একজন যুবক ছোট একটা ম্যাগাজিনে সাদা-কালো ঘরে হাতি ঘোড়া আঁকা একটি ডায়াগ্রামের দিকে তাকিয়ে আছেন।
যুবকটির নাম রবার্ট জেমস ফিশার। এই বছরই তিনি বিশ বছর বয়েসে পদার্পণ করলেন। সদ্য টিনএজ ছাপিয়ে বেড়ে ওঠা শরীরে আলোর তীব্রতা খলবল করছে, আমরা অর্থাৎ যারা দর্শক আছি এই পুরো দৃশ্যের- তারা একটু মনোযোগী হলেই শুনতে পাবো রবার্টের বুকের নাটকীয় স্পন্দন। কাল, অর্থাৎ ১৫-ই ডিসেম্বর-ইউনাইটেড স্টেটস চেস চ্যাম্পিয়নশিপ!
রবার্ট এই ইউএস চ্যাম্পিয়নশিপ ছাড়াও পূর্বে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়নশিপগুলোর টানা চারটিতে জিতেছেন। সালগুলো হচ্ছে ১৯৫৭/৫৮, ১৯৫৮/৫৯, ১৯৫৯-৬০, ১৯৬০-৬১। ১৯৫৭ সালের যেটিতে তিনি জিতেছিলেন- তখন তার বয়েস শুনলে যে-কেউই ভীমড়ি খাবে। মাত্র ১৪ বছর বয়েস ছিলো তার।
ফর্টিন! এই বয়েসে এভারেজ একটি ছেলে কি করে? প্রিয় কার্টুন অথবা কমিক বই নিয়ে স্কুলে বন্ধুদের মুগ্ধ করতে চায়। সাইকেল চালাতে গিয়ে ব্যথা পায়, প্রথমবারের মত কোনো রোমান্টিক সিনেমা দেখে হয়তো লজ্জাও পায়। কিন্তু রবার্ট সম্পূর্ণ অন্যরকম। সাধারণ যেকোনো কিছুরই সে একদম বিপরীত। সহজদের কাতারে তাকে ফেলা যায় না, আবার কাঠিন্যের মাপকাঠিতেও তাকে আন্দাজ করা যায় না। সেই হিসেবে ১৪ বছর বয়েসে ইউএস চ্যাম্পিয়নশিপ জেতাটা তার জন্যে তুলনামূলক সোজাসাপ্টাই! এবং তিনিই ইতিহাসের সবচাইতে কমবয়সী ব্যক্তি যিনি ইউএস চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন!
এই ফাঁকে, পাঠক, চলুন একটু সংক্ষেপে ঘুরে আসি রবার্টের পরিচিতি পর্বে।
মার্চ মাসের ৯ তারিখ, শিকাগো-ইলিনয়ের মাইকেল রিজ হসপিটালে জন্মগ্রহন করেন তিনি, সালটা ১৯৪৩। রবার্টের মা, রেজিনা ওয়েন্ডার ফিশার, ছিলেন আমেরিকান নাগরিক। ফিশারের জন্ম-সনদে বাবার নাম হিসেবে ‘অন্তর্ভুক্ত’ করা হয় যাকে, তার নাম হান্স-জেরার্ড ফিশার, যিনি পরিচিত ছিলেন জেরার্ডো লিয়েবশার নামে। ভদ্রলোক একজন জার্মান বায়োফিজিসিস্ট। হান্স জেরার্ডের সাথে রেজিনার বিয়ে হয় ১৯৩৩’এর নভেম্বরে। রেজিনা তখন রাশিয়ার ‘আইএম সেশেনভ ফার্স্ট মস্কো স্টেট মেডিকেল ইউনিভার্সিটি’তে পড়ছিলেন। সেখানেই তাদের পরিচয়, প্রণয়। ইনাদের গর্ভে একটি মেয়ে জন্মায়, নাম রাখা হয় জোয়ান ফিশার। সময় পার হয়।
১৯৩৯ সালে রেজিনা তার কন্যাকে নিয়ে চলে আসেন ইউএস’এ। জার্মান নাগরিকত্বের কারনে হান্স-জেরার্ড ইউএস’তে ঢুকতে পারেননি। অবশ্যম্ভাবীভাবে, রেজিনা আর হান্সের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
যেই সময়ে রেজিনা পুত্র সন্তানের জন্ম দেন, সেই সময়টায় তিনি গৃহহীন ছিলেন। পরিবারের জন্য তিনি নানা রকম চাকরির চেষ্টা-চরিত্র করেন। এই ফাঁকে জড়িয়ে যান রাজনৈতিক কাজকর্মের সাথে।
২০০২ এ ঘুরে আসা যাক। ‘দি ফিলাডেলফিয়া ইনকোয়ারার’ একটি অনুসন্ধানমূলক রিপোর্ট প্রকাশ করে, এবং যাবতীয় প্রমাণসহ তারা জানায়- রবার্ট জেমস ফিশারের বায়োলজিক্যাল পিতা হচ্ছেন জনৈক ‘পল নেমেনি’, তিনি একজন হাঙ্গেরিয়ান ম্যাথমেটেশিয়ান এবং পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি একইসাথে ‘ফ্লুইড এবং এপ্লাইড মেকানিকস’এ বিশেষজ্ঞ। পল নেমেনি ফিশারের যাবতীয় খরচ বহন করেন ১৯৫২ সাল-তক। এরপর তিনি মৃত্যুবরন করেন।
১৯৪৯ সাল। ফিশারের বয়স তখন ছয়। এলাকার এক ক্যান্ডি শপ থেকে ফিশার ও তার বোন দাবার বোর্ড কিনে শেখা শুরু করেন। তবে, দাবার প্রতি যখন তার বোন আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং তার মায়েরও সময় ছিল না ফিশারকে সঙ্গ দেয়ার জন্য, তখন ফিশারকে মূলত একাই খেলতে হয়। তিনি খেলতেন নিজের সাথে। নিজের সাথে খেলে নিজেই জিততেন। হেরে যাওয়াটাকে বড্ড অপছন্দ করতেন। ছিলেন একরোখা, জেদী৷ খুব ছোটবেলা থেকেই এমনটা। আজন্ম জানতেন তার বাবা একজন খ্রিষ্টান ব্যক্তি, মায়ের রাজনৈতিক কর্মকান্ড এবং পরিবারের সাথে ব্যক্তি ফিশারের যোগাযোগ কম থাকার কারণেই বোধহয় তার চরিত্র দ্বৈততাপূর্ণ। দাবা পছন্দ করতেন তীব্রভাবে। দাবার চালগুলো যেন ফিশারেরই কাছের বন্ধু, একদম কাছের- যেন দীর্ঘদিনের চিনপরিচয়! সবচাইতে ভালো বুঝতেন দাবার চাল, সেজন্যে একদা বলেওছিলেন, ‘আমি সাইকোলজিতে বিশ্বাস করি না, কিন্তু বিশ্বাস করি একটি ভালো চালে!’
দাবায় গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছিলেন খুব কম বয়েসে, মাত্র পনেরো! যা তখনকার ইউএস আমেরিকায় ‘ইয়ঙগেস্ট এভার’। গ্র্যান্ডমাস্টার হবার আগেও চৌষট্টি বর্গের বোর্ডে দেখিয়েছিলেন নিজের মেধা, সাহস এবং ধৃষ্টতা৷
১৯৫৬ সালের একটি ইভেন্টের কথা বলা যেতে পারে।
আমেরিকার অন্যতম চেস মাস্টার ডোনাল্ড ব্রায়ান, বয়েস তখন তার ২৬। আজকে বোর্ডে খেলা পড়েছে রবার্ট জেমস ফিশারের সাথে, ফিশার তখন বয়েসে ডোনাল্ডের অর্ধেক অর্থাৎ মাত্র তেরো! বয়েসে অর্ধেক হলে কি হয়েছে! বোর্ডে যে তিনি ডোনাল্ডের দ্বিগুণ – তা প্রমাণ করে ছাড়লেন। অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট একটি ম্যাচ খেলে জিতলেন, সেই গেমটি এখনও ‘গেম অফ দ্যা সেঞ্চুরি’ নামে বিখ্যাত!
রবার্ট জেমস ফিশার- বিশ্ব দাবায় পরিচিত ববি ফিশার নামে। এমনই এক নাম- যে নাম সম্পর্কে লেখা যাবে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, তবুও ফুরোবে না। আমরা বরং দ্রুত পাশ কেটে ফিরে যাই সেই হোটেল রুমে, যেখানে বসে বসে ডায়াগ্রাম কষছেন সদ্য বিশ হওয়া ফিশার। আগামীকাল অর্থাৎ ১৫-ই ডিসেম্বর ইউএস চ্যাম্পিয়নশিপ খেলা।
রাউন্ড রবিন পদ্ধতির এ খেলায় ফিশার ছাড়াও অংশ নিচ্ছেন আরো ১১ জন গ্র্যান্ডমাস্টার। এদের কেউ কেউ সাবেক স্টেটস চ্যাম্পিয়ন, কেউ বা ভবিষ্যৎ চ্যাম্পিয়ন। নামগুলো শুনে নেয়া যাকঃ
ল্যারি মেলভিন এভানস, পল বেংকো, স্যামুয়েল রেশেভেস্কি, এন্থনি সাইদি, রবার্ট ইউজিন বায়ার্ন, রেমন্ড ওয়াইনস্টাইন, আর্থার বিসগায়ার, উইলিয়াম এডিসন, এডমার মেডনিস, আর এইচ স্টেইনমেয়ার এবং সেই ডোনাল্ট বায়ার্ন!
এদের প্রত্যেকেই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দাবাকে এরা সাজিয়েছেন থিওরি দিয়ে, খেলাটাকে একটা মডার্ণ রূপ দিয়েছেন৷
উক্ত টুর্নামেন্টে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সাথে খেলবেন। অর্থাৎ রাউন্ড রবিন পদ্ধতিতে। ১৫-ই ডিসেম্বর খেলা শুরু হয়ে চললো জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ অবধি। রেজাল্ট যখন বের হলো- পুরো দাবা বিশ্ব থতমত চেহারায়! কারণ, এই টুর্নামেন্টে পার্ফেক্ট স্কোর করেছেন ববি ফিশার! মোটামাট ১১ টা গেমের প্রত্যেকটিই তিনি জিতেছেন- এবং এই রেকর্ড আজ অবধি কেউ ভাঙতে পারেনি!
মজার বিষয় হচ্ছে- টুর্নামেন্টের শেষ খেলায় ববি ফিশারের সাথে খেলেছিলেন এন্থনি সাইদি। ডক্টর এন্থনি সাইদি, যিনি জ্যামাইকায় একজন চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শুধুমাত্র ইউএস চ্যাম্পিয়নশিপ খেলবার জন্য তিনি সাময়িক বিরতি নেন কর্মস্থল থেকে। এই বিরতি নেয়াটা অবশ্য বৃথা যায়নি৷ তিনি অধিকার করেছিলেন চতুর্থ স্থান, এবং ববি ফিশারের সাথে শেষ ম্যাচে তিনি ফিশারকে রুখে দিতে পারতেন পার্ফেক্ট স্কোর করা থেকে! কিন্তু সেটা হয়নি। ববি ফিশার টুর্নামেন্ট শেষে ডক্টর সাইদি’র সাথে বসে খেলা বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন কোন চালটা দিলে খেলাটা ড্র হতে পারতো।
টুর্নামেন্ট শেষে ঘটলো আরো একটি মজার ঘটনা। ফলাফল ঘোষণার সময় টুর্নামেন্ট নির্দেশক হান্স মখ মজা করে রানার্স আপ স্থান অধিকারী ল্যারি মেলভিন এভানস’কে ‘টুর্নামেন্ট জয়ী’ হিসেবে এবং ববি ফিশারকে ‘পুরো প্রদর্শনী জয়ী’ হিসেবে ঘোষণা করেন!
তা না-করবেনই বা কেন? এ যে ববি ফিশার যে কিনা পুরো বিশ্ব বিস্মিত করেছেন, মাতিয়েছেন চৌষট্টি বর্গ আর ঘুম হারাম করে দিয়েছিলেন প্রতিপক্ষের।
১৯৬৩\৬৪ সালের মত নাটকীয় বছর দাবা বিশ্ব আর কখনো দেখেনি। তবে চূড়ান্ত নাটকীয় ঘটনা তখনও এসে উপস্থিত হয়নি। সেই সালটি ১৯৭২ সাল! বিশ্ব দাবার একছত্র আধিপত্য তখনকার দিনে ছিল কেবল রাশিয়ানদের। রাশিয়ানরাই সবকিছুর চ্যাম্পিয়ন তখন। এমনকি কন্সপিরেসি থিওরি আছে এমনঃ শিরোপা নিজেদের মধ্যে রাখবার জন্য রাশিয়ানরা নাকি পাতানো খেলা খেলতো। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে খেলা ড্র করতো বা এমন পদ্ধতি তৈরি করে রাখতো যেন রাশিয়ান ভিন্ন অন্যকোনো গোষ্ঠীর কাছে কোনোপ্রকার শিরোপা না যায়! এমনই এক সিস্টেমের ভেতর দিয়ে ববি ফিশার চ্যাম্পিয়নশীপ মুকুটের জন্য লড়াইয়ে নামলেন।
চ্যাম্পিয়নশীপে অংশগ্রহণ করতে হলে বেশকিছু রিকোয়ার্মেন্ট বা প্রয়োজনীয় জিনিস সেরে আসতে হয়। এদের অন্যতম হলো- ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট খেলা। ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হলেই কেবল একজন দাবাড়ু শিরোপাধারী বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে ‘চ্যালেঞ্জ’ করতে পারবেন।
১৯৭২ সালের চ্যাম্পিয়নশীপ ম্যাচ নিয়ে কিছু বলা যাক। ম্যাচটা খেলা হয়েছিল কোল্ড ওয়ার তথা স্নায়ু যুদ্ধের সময়ে। সোভিয়েত আর ইউনাইটেড স্টেটসের মধ্যকার রাজনৈতিক বিরোধ তখন একটা পাতলা সুতোয় দাঁড়িয়ে আছে। আর সোভিয়েত দাবার একচ্ছত্র আধিপত্য তখন, সেই আধিপত্যে নতুন চ্যাম্পিয়ন বরিস স্প্যাস্কি। তিনিই তৎকালীন চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু এদিকে ববি ফিশার তখন ২৯ বছরের বেপরোয়া যুবক, সোভিয়েতদের কারচুপি তিনি মানতে পারলেন না। তিনি খেলায় সোভিয়েতদের ‘খুব তাড়াতাড়ি ড্র করা’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।
১৯৬২ সালে আমেরিকান ম্যাগাজিন ‘স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড’ এবং জর্মন ম্যাগাজিন ‘Der Spiegel’ ফিশারের একটা আর্টিকেল প্রকাশ করে যার শিরোনাম ছিল ‘দ্যা রাশিয়ানস হ্যাভ ফিক্সড ওয়ার্ল্ড চেস’, অর্থাৎ ফিশার বলতে চাইছেনঃ রাশিয়ানরা পাতানো খেলা খেলছে!
দুই দেশের মধ্যকার বিরাজমান যাবতীয় দ্বন্দ্বের হাওয়া দাবার গায়ে এসেও লাগে। চ্যাম্পিয়নশীপের ম্যাচ জেতার জন্য বরিস স্প্যাসকিকে সরাসরি চাপ দেয়া হয়। অপরদিকে, ববি ফিশারের হয়েছে আরেক দশা। তাঁর আগে আর কোনো দাবাড়ু টাইটেল জেতার এত কাছাকাছি যায়নি কখনো। ফলস্বরূপ তিনি নিজেও একটা রাজনৈতিক চাপ অনুভব করতে শুরু করেন। অর্থাৎ খেলাটা পুরোপুরি রাজনৈতিক অবস্থায় মোড় নিয়ে ফেললো!
স্প্যাসকি ১৯৬৬ এবং ১৯৬৯ এই দুটি বছরে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের জন্য কোয়ালিফাই করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি চ্যাম্পিয়নশীপের ম্যাচ হেরে যান টাইগ্রান পেট্রোসিয়ানের কাছে। আবার ১৯৬৯ সালে পেট্রোসিয়ানের বিরুদ্ধে খেলবার জন্য যোগ্যতা অর্জন করলে ঠিকই জিতে যান তাঁর বিরুদ্ধে, তখন থেকে চ্যাম্পিয়নশীপের মুকুট তারই মাথায়। স্প্যাসকি খুবই ঠান্ডা মাথার খেলোয়াড়। তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত ছিলো- তাঁর খেলা বাহারি ধরনের, যেকোনো ওপেনিং-র বিরুদ্ধে প্রায় সব ডিফেন্সই খেলতে পারেন। এছাড়া কৌশলগত দিক থেকে তিনি ছিলেন যথেষ্ট শার্প!
কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, স্প্যাসকির থেকে ফিশারের রেটিং ছিল যথেষ্ট বেশি! ফিদে ১৯৭২ সালের জুলাই মাস অবধি ফিশারের রেটিং ছিল ২৭৮৫ আর স্প্যাসকির ২৬৬০, ১২৫ রেটিং পয়েন্টের ব্যবধান! এই ব্যবধানই ফিশারকে ম্যাচের আগেই ফেভারিট করে তোলে। কিন্তু সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি, তা হচ্ছে- চ্যাম্পিয়নশীপ ম্যাচের আগে ফিশার বনাম স্প্যাসকির যত ম্যাচ খেলা হয়েছে তাঁর একটিতেও ফিশার জেতেনি। মোটমাট ৫ টি খেলার ভেতরে ড্র হয়েছে ২টিতে আর ফিশার হেরেছেন ৩ টি খেলা।
যাইহোক, ১৯৭২ সালের ম্যাচের কথা আসি। খেলা শুরুর আগে ফিশার আচমকা টাকার বণ্টন এবং পরিমাণ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করেন। তিনি দাবি করে বসেন, মোটা ১২৫০০ ডলার (আট ভাগের পাঁচ ভাগ জয়ী পাবেন, এবং তিন ভাগ পাবেন বিজেতা), টেলিভিশন ব্রডকাস্ট এবং বস অফিস আয় থেকে ৩০% করে টাকা দিতে হবে- যা একেবারে অসম্ভব অকল্পনীয় একটা দাবি। খেলা হবে আইসল্যান্ডে, ফিশার ওপেনিং অনুষ্ঠানে আসতেই পারলেন না। অনুষ্ঠিতব্য ম্যাচ ২ দিন পিছিয়ে দেয়া হলো, একজন ব্রিটিশ ব্যাংকার ফিশারের দাবিদাওয়া মেনে প্রাইজ ফান্ড ডাবল করে দিলেন এবং হেনরি কিসিঞ্জারের একান্ত অনুরোধে ফিশার খেলতে আসলেন।
এরপরের পুরো ঘটনা সবার জানা। ববি ফিশার, দাবা বিশ্বের বাদশা, ব্রুকলিনের একরোখা এবং জেদী ছেলেটা সবাইকে বিস্মিত করে দিতে বরিস স্প্যাসকিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরিধান করলেন! জয়ের রাস্তাটা সহজ ছিলো না ফিশারের জন্য, ছিলো কাঠিন্যে আর বাঁধা বিপত্তিতে ভরপুর। সেসব উৎরে গেছেন শক্তি, সাহস আর জেদী মনোভাব দিয়ে। নিজের সত্তাকে নিয়ে হয়তো দ্বিধায় ভুগতেন, যেজন্যে রাশিয়ানদের বোঝার জন্য, ওদের ম্যাগাজিন পড়বার জন্য শিখেছেন রাশিয়ান ভাষা, রাত জেগে জেগে খেলা বিশ্লেষণ করেছেন, সহজে ড্র অফার মেনে নেননি, কারণ তিনি জিততে চাইতেন।
জিতেছেনও।