ডেনমার্ক সম্ভবত ইউরোতে আসে রূপকথার গল্প লিখবার জন্যই । ১৯৯২ সালের কথাই ধরুন নাহ, ইউরো শুরু হবার মাত্র দুই সপ্তাহ আগে উয়েফা থেকে জানানো হয় ইউরো খেলার সুযোগ পাচ্ছে ডেনিশরা। বিস্মিত হয় সবাই, কারণ ওরা যে বাছাইপর্বই উৎরাতে পারেনি।
কিন্তু, ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডান, টুর্নামেন্টের ঠিক আগ মুহুর্তে যুগোস্লাভিয়া নিষিদ্ধ হলে সুযোগ পেয়ে যায় ডেনমার্ক। অন্যদিকে সুযোগ পেয়ে ডেনমার্ক ফুটবল ফেডারেশনের কর্তাদের তখন মাথায় হাত, খেলোয়াড়েরা সবাই ব্যস্ত ইউরোপীয় মৌসুম কাটিয়ে পরিবারের সাথে ছুটি কাটাচ্ছে। সেখান থেকে কোনোরকমে একটা দল পাঠায় ডেনমার্ক। কে জানত এক মাস পর অসাধারণ এক রূপকথার গল্প লিখবে ডেনমার্ক।
কিম ভেলফোর্টের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন, বাকিরা যখন ছুটি কাটাচ্ছিলো তিনি তখন হাসপাতালে। রাত কাটাচ্ছেন ৭ বয়সী কন্যা লিনের পাশে। লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত লিনের শারীরিক অবস্থা তখন সংকটাপন্ন। এমতাবস্থায় জাতীয় দলের ডাক আসলে কন্যার অনুরোধেই সে ডাকে সাড়া দেন।
টুর্নামেন্টের মাঝেই দুবার ফিরে আসলেও লিনের জোরাজুরিতেই পুনরায় দলের সাথে যোগ দেন। ফাইনালে ভেলফোর্টের পায়েই রচিত হয় ইতিহাস, এই এক গোলেই ডেনমার্ক ফুটবলের সর্বশ্রেষ্ঠ স্মৃতির অংশ হয়ে যান তিনি। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! শিরোপা জেতার তিন সপ্তাহ পর মারা যান লিন।
এবার বর্তমানে ফিরে আসি। করোনার ভয়ংকর থাবা থেকে রক্ষা পায়নি ফুটবলও, এক বছর পিছিয়ে দিয়ে শুরু হয়েছে ইউরো’২০। এবার ডেনমার্ক আগেরবারের মতো ভাগ্যের জোরে খেলতে আসেনি, বাছাইপর্বে রীতিমতো নিজেদের গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে খেলতে এসেছে।
কোপেনহেগেনের পার্কেন স্টেডিয়ামটাও দারুণ, ম্যাচের আগে স্বাগতিক দর্শকদের উল্লাসে কান পাতা দায়। নিজেদের প্রথম ম্যাচে ফিনল্যান্ডের মুখোমুখি হয় ডেনমার্ক। কখনো কখনো খেলার চেয়েও বড় কিছু ঘটে যায় মাঠে, ৪২ মিনিটের ঘটনাটা সম্ভবত কখনোই ভুলবে না সেদিনের কেউ।
ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন মাঠের মধ্যেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে লুটিয়ে পড়েন, তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। এরপর এরিকসেন সুস্থ আছেন এমন খবর পেয়ে মাঠে নামে ডেনিশরা। কিন্তু ম্যাচের লাগাম তো ছুটে গেছে সেই ঘটনাতেই, মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ডেনমার্ক হেরে যায় ১-০ গোলে।
পরের ম্যাচে হতবিহবল ভাবটা কাটিয়ে উঠা গেলেও বেলজিয়ামের বিপক্ষে পেরে উঠা হয় নাহ কেভিন ডি ব্রুইনা নামের এক অতিমানবের জন্য। ২-১ গোলে হেরে যাবার পর বাড়ি ফেরা হয়ে যায় নিয়তি। কিন্তু সিমোন কায়েরের দল যে হারার আগে হারতে জানে নাহ, মাঠে লড়াই করে যায় শেষ অবধি।
ম্যাচের আগে কায়ের জানিয়েছিলেন ম্যাচটি তাফা খেলবেন এরিকসেনের জন্যই। ম্যাচের মাঝেও দেখা যায় তার প্রতিফলন, ৩৮ মিনিটে ডেনিশ উইঙ্গার মিকেল ড্রামসগার্ডের দূরপাল্লার দারুণ এক গোলে শুরু করে ডেনমার্ক। ৫৯ মিনিটে রাশিয়ান ডিফেন্সের ভুলে লিড দ্বিগুণ করে পৌলসেন। মাঝে রাশিয়া এক গোল পরিশোধ করলেও ৭৯ থেকে ৮১ এই তিন মিনিটের মাঝে দুই গোল করে ৪-১ গোলের বড় জয় নিশ্চিত করে ডেনমার্ক। কিন্তু কেবল নিজেরা জিতলেই তো হবে নাহ, ওদিকে বেলজিয়ামের কাছে হারতে হবে ফিনল্যান্ডকে।
‘ভাগ্য সবসময় সাহসীদের পক্ষে থাকে’ অমোঘ সত্য এই বাক্যের সত্যতা প্রমাণ করতেই যেন শেষের দশ মিনিটে বেলজিয়ামের কাছে হেরে যায় ফিনিশরা। গ্রুপে দ্বিতীয় হয়ে নকআউট পর্বে উঠে যায় ডেনমার্ক। আরো একবার রচিত হয় ডেনিশ রূপকথা।
শেষ বাঁশি বাজার পর তুমুল উল্লাসে ফেটে পড়েন মাঠে উপস্থিত দর্শক এবং খেলোয়াড়েরা। ফুটবলের সৌন্দর্য এখানেই, গ্রুপে শেষ অবস্থানে থেকে ম্যাচ শুরু করা ডেনমার্ক কিনা উঠে গেল পরের রাউন্ডে। আশা করি ডেনমার্কের এই রূপকথার যাত্রা এখানেই শেষ হবে নাহ, তারা যাবে আরো অনেক দূর। এরিকসেনের জন্য হলেও যে জিততে হবে তাঁদের।