স্বর্গসুখের সন্ধানে, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে

খেলাপিপাসুর মধ্যে এমন কেউ কেউ থেকেই যায়, যারা প্রতিটা বাঁকে শিল্প খোঁজে। রাত জেগে কফি বানিয়ে টিভির সামনে বসে স্রেফ একটা শৈল্পিক ডজ, একটা ছোট্ট টার্ন – এসব দেখবে বলে। ভারতবর্ষের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে একসময় প্রচণ্ড জনপ্রিয় ছিলেন চুনী গোস্বামী। তারপর সুরজিত সেনগুপ্ত, পদাঙ্ক অনুসরণ করে তারপরে কৃশানু দে।

১৯৮৬-র পরে বাঙালি দু’ভাগ হয়ে গেল শুধু ম্যারাডোনার কারণে। একটাই কারণ। নান্দনিকতার বাহার প্রতি বাঙালি মাত্রই আকর্ষণে বিষয়বস্তু। তা যেমন মারাদোনার সাতজন ইংরেজকে কাটিয়ে গোল করার মধ্যে পাওয়া যায়, তেমনই বাংলার মাঠে কৃশানুর পা’তেও পাওয়া যায়। একটা অসাধারণ ডিফেন্স চেরা পাস মূহূর্তে আমজনতাকে টিভিমুখো করিয়ে দিতে পারে।

এইরকম ট্যালেন্ট একসময় লাতিন আমেরিকার একটা দেশে ভুরি ভুরি এসেছে। কেউ পারফেক্ট নাম্বার নাইন, কেউ তুখোড় অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার অর্থাৎ নাম্বার টেন। ব্রাজিল দেশের পথে পথে ছোট ছেলেরা ফুটবলের স্কিল দেখিয়ে পয়সা রোজগারের রাস্তা খুঁজে বেড়ায়, সেখানে এ ধরণের শিল্প বড় বেমানান ঠেকে। তা সত্বেও, বারে বারে ব্রাজিল দেখিয়ে দিয়ে গেছে তারা শুধুই নান্দনিক আলাপে বিশ্বাসী। চৌরাসিয়ার ভোরের আলাপে ঘুম ভাঙায় বিশ্বাসী।

রিভেলিনোর স্কিল সেদিন ইউটিউবে দেখছিলাম। ডানদিক থেকে তিনজনকে প্রায় ছিটকে দিয়ে বেরোল। ডান পায়ে ইনস্টেপ-আউটস্টেপ করতে করতে চকিতে নিজের শরীরকে টার্ন করিয়ে ঐ যে ক্রসটা তুলল, তারপর সে ক্রসে গোল হল কি হল না – ওসব আর খেয়াল থাকে না। ওইটুকু ডজ মন কেড়ে নিয়ে চলে গেল। অথচ রিভেলিনোকে নিয়ে খুব কম লেখা দেখতে পেয়েছি। এত স্কিলফুল প্লেয়ারকে নিয়ে মানুষ কেন লেখে না, তার খেলার ইউটিউব লিঙ্ক দেয় না, ভেবে বড় আশ্চর্য হয়েছিলাম। এর উত্তর সত্যি নেই বোধহয়।

তেমনই জিকো-সক্রেটিস। নাম্বার টেন এবং এইট। দুজনেরই পজিশন অ্যাটাকিং মিডফিল্ড। আর দুজনেই ব্রাজিল ফুটবলের নান্দনিকতায় প্রথম সারির শিল্পী। সক্রেটিস সম্পর্কে স্প্যানিশ মিডিয়া ‘৮২-র বিশ্বকাপে বলেছিল – নট অ্যান অ্যাথলিট, জাস্ট অ্যান আর্টিস্ট! ‘পাসিং দ্য বল’ ব্যাপারটাকে দ্য ভিঞ্চির পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে খেলা যায়, সক্রেটিস জানালেন।

লং শটে গোল করাটা তো অভ্যাসে পরিণত করেছিলেন। জিকো পর্যন্ত নিজের ক্যাপ্টেন সম্পর্কে বলেছিলেন যে সক্রেটিস বিশ্বকাপ পেলে ম্যারাডোনার সঙ্গে একত্রে উচ্চারিত হতেন। সক্রেটিসের দুর্ভাগ্য, ব্রাজিলের দুর্ভাগ্য যে অত সুন্দর টিম, অত শৈল্পিক ফুটবল খেলেও দ্য গ্রেটেস্ট ব্রাজিল টিমের কখনও বিশ্বকাপ পাওয়া হয়নি!

পরে যখন রোমারিও, বেবেতো, মাজিনহো, লিওনার্দো, ব্র্যাঙ্কো, দুঙ্গা এল, ১৯৯৪-র বিশ্বকাপ জিতল ব্রাজিল। তাতে কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল মুখোমুখি হয়েছিল নেদারল্যান্ডসের। সেখানে ম্যাচের শেষ মূহূর্তে ব্র্যাঙ্কো একটি গোল করেছিল, ফ্রিকিকে। ফ্রি-কিকটা দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়, ঐ ফ্রি-কিকটা ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্র্যাকটিস করলেও আসবে না। ঐ বাঁক খাওয়ানো বলটা গোলের মধ্যে ঢুকেছিল, শুধু ব্র্যাঙ্কোর শৈল্পিক শটে। ওটাই দৃষ্টিসুখ, ওটার জন্যই সব কাজ ছেড়ে টিভির সামনে রাত জেগে বসে থাকা।

আর আমাদের ছোটবেলা কেটেছে একজন ঈশ্বরকে দেখে। যার নাম রোনাল্ডিনহো। যার পায়ের ছন্দে কবিতা লেখা হয়, যার ডান পায়ের তালে তালে দর্শকও মাততে থাকে। খেলা চলতে চলতে হঠাৎ একটা টার্ন, হঠাৎ একটা রুলেট, একটা নাটমেগ – চোখে ঝলক খেলিয়ে রোনাল্ডিনহো এগিয়ে যায়! কাকা ২০০৭ এ যখন ব্যালন ডি অর পায়, তার আগে থেকেই কাকার প্রতি মুগ্ধতা। আর নাজারিও কে নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই।

আজ লেওয়ানডস্কিকে নিয়ে মানুষ লেখে, সেরা স্ট্রাইকারের আখ্যা দেয়। রোনাল্ডোর মত পারফেক্ট নাম্বার নাইন স্ট্রাইকার আর আসেনি, আর আসবে না। ডি বক্সের শিল্পী। যা ইচ্ছে তাই করতে পারত ডি বক্সে। পেনিট্রেটিভ জোনে বল পেলে রনিকে রোখাই মুশকিল হত। এককথায় সেরা সেন্টার ফরোয়ার্ড, যার গোল এখনও চোখে লেগে আছে। ২০০২-র ফাইনালে সেকেন্ড গোলটা যেমন। শটটাই অনবদ্য ছিল। রোনালদো চিরকালের ফেভারিট, চিরকালের।

আবারো ফুটবলের বড় আসর, আবারও মাঠে নেমেছে ব্রাজিল, প্রত্যাশা আবারো নান্দনিক ফুটবলের। আবার রাত জাগা, টিভির সামনে বসে থাকা শুধু ঐ আশায়। ঐ নান্দনিকতা, ঐ শৈল্পিক সৌন্দর্য খুঁজে বেড়ানো। সেই ছেলেবেলা খুঁজে ফেরা নেইমার, কুটিনহোর পায়ে। কোপা আমেরিকা দেখতে বসা শুধু এই একটা কারণে। কারণ ব্রাজিল কখনও হতাশ করে না, ব্রাজিল কখনও সৃষ্টিশীলতা থেকে বঞ্চিত হয় না, ব্রাজিল কখনও শৈল্পিক সত্তা থেকে সরে আসে  না। সেলেকাওদের ম্যাজিক দেখার জন্য আবার রাত জাগা শুরু। গো, ব্রাজিল!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link