কুর্নিশ ওয়ার্নিকে

তাঁর শেষ টুইটটাও থেকে গেল মৃত্যু শোকেরই। যে যাওয়ার সে তো চলেই গেলেন। আর রেখে গেলেন জ্বলন্ত কিছু স্মৃতি, কিছু ইতিহাস। সেটাই সম্বল আগামী প্রজন্মের কাছে। বাকিটা টুপি বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছবির। যার মাঝে হারিয়ে যাওয়া আমাদের মতো হাজার হাজার পাগল মন নীরবে এক তোরা ফুল রাখবে তাঁর পায়ের কাছে।

২০০৭-এ প্রথম ২০ ওভারের, আর পরে ২০১১-তে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ কাপ দেখা জেনারেশনটা তাঁকে আর দেখল কই। বড়ো দাদা দিদিদের মুখেই যা শোনা। দানব নাকি জাদুকর? কেউ ঠিক করতে পারে না। এই জেনারেশন গল্প শুনেছে, আর ইউ টিউবে হাইলাইটস- কিছুটা ঝাপসা, কিন্তু মারাত্মক।

লিসা স্টালেকারকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তৎকালীন অজি অধিনায়ক রিকি পন্টিং প্রায় কেঁদেই ফেললেন, ‘সপ্তাহ দুয়েক আগেই কথা হয়েছিল ওর সাথে। যদি একবার বলতে পারতাম কতটা ভালোবাসি! বলা হল না!’

শেন কিথ ওয়ার্ন। ১৯৯২ থেকে টানা ১৫ বছর টেস্ট জগতে দাপিয়ে বেরিয়েছেন তিনি। মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের ভারতের বিরুদ্ধে সিডনির মাঠে প্রথম বার বল ছুঁড়েছিলেন তিনি। পকেটস্ত করেছিলেন তাঁর প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্ট উইকেট- রবি শাস্ত্রী, যিনি তখন ৪২৭ বলে ২০৬ রানে খেলছিলেন।

সেই শুরু যাত্রা। পরের বছর, ১৯৯৩-র মার্চ মাসে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সীমিত ওভারের খেলায় অভিষেক। নয় নয় করে হাজারের ওপর আন্তর্জাতিক উইকেট তুলে নিয়েছেন ‘ওয়ার্নি’। ২০০৭ অবধি ৭০৮ টি উইকেট নিয়ে সর্বাধিক উইকেটের মালিক ছিলেন শেন। সাদা বলে নেন ২৯৫ উইকেট। নিচের দিকে অন্যতম বিশ্বাসযোগ্য ব্যাটসম্যান- বারোটি অর্ধশত রান রয়েছে তার নামে, সব নিয়ে ৩১৫৪।

শেষের দিকে ২০০৮-এ ভারতের আইপিএলে আসা, রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে প্রথম এবং আপাতো শেষ ট্রফি এনে দেওয়া- আমাদের এই ‘বাচ্চা’ জেনারেশনটার মাথায় হাতুরি মেরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি কি জিনিস। লেখা থাকে এই সব নোটবুকে। লেখা থাকে ফাইফারের হিসাব।

কিন্তু যেটা লেখা থাকে না- পাড়ার মোড়ে লেগ স্পিন করার হিড়িক; বিগ বাবুলের ওপর প্রিয় ‘ওয়ার্নি’-র ছবি; ঘরের দেওয়ালে আটকানো লুকিয়ে জমানো টাকা দিয়ে কেনা একটা ছবি; আর বাবা কাকাদের কলার উঁচু করা ডায়লগ, ‘রাখ তোর নাথান লিঁও, ওয়ার্নকে দেখবি, উফ, কোথা থেকে বল ঘুরে কোথায় পরবে, ধরতে পারবি না!’

২০১৯ বিশ্বকাপে আমাদের কুলদীপ যাদব একটা বল করেছিলেন বটে পাকিস্তানের বাবর আজমকে। সেই খোঁজার শুরু ‘বল অফ দ্য সেঞ্চুরি’র। ১৯৯৩-তে ওল্ড ট্রাফোর্ডে ইংল্যান্ডের মাইক গ্যাটিংকে করা সেই বিস্ময়কর বল। যা লেগ স্টাম্পের অনেক বাইরে ছিল। গ্যাটিং ডিফেন্ড করতে গেলেন, কিন্তু বল পড়ল পেসারদের ফুটমার্কসের ওপর, ফ্রিকশনটা বেশিই হল, লাগল অফ স্টাম্পে- ব্যাস, গল্প শেষ। বল অফ দ্য সেঞ্চুরির খোঁজ পেয়ে গেলাম। মালিক শেন ওয়ার্ন!

বাবা, কাকাদের বা বড়ো দাদাদের কাছে ওনার ভিলেন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি, কিন্তু এই জেনারেশনটা, যে কুল-চা জুটির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকেছে, তাদের কাছে টুপি বাড়িয়ে হালকা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকা শেন ওয়ার্ন জাদুকরই বটে! সেদিনের ১৯ বছরের ছেলেটাকে ‘রকস্টার’ আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, ‘keep an eye on him, he’s going to be a rockstar.’

আজ সেই ৩৩ বছরের ছেলেটা সকলের কাছে ‘স্যার জাদেজা’। আজও বেঞ্চ সরিয়ে অল্প জায়গা করে ক্লাসের মধ্যে ওয়ার্নকে নকল করার চেষ্টা হবে, কোনো এক নেট পিচে, কোনো এক কোচ ছাত্র/ছাত্রীর মাথায় গাঁট্টা মেরে বলবে, ‘শেন কে দেখিসনি!’ শেন ওয়ার্নরা যায় না, যতদিন মানুষ থাকবে, হৃদয় থাকবে, ক্রিকেট থাকবে, শেন ওয়ার্নরা ততদিন থাকবেন।

অতীতটা আজও বড্ড জ্যান্ত। আর বর্তমান কিছুটা যেন বিস্ময়ে মোরা, মাত্র ৫২! সেদিন পাকিস্তান-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট দেখছিলেন নিজের ফার্ম হাউসে বসে। তার আগেই আর এক অজি তারকা রড মার্শের মৃত্যুর খবরে শোক প্রকাশ করেছিলেন টুইট করে। ১২ ঘন্টার মধ্যে জাদুকরের নিজের হৃদযন্ত্রটাই কাজ করা বন্ধ করে দিল নিভৃতে!

তাঁর শেষ টুইটটাও থেকে গেল মৃত্যু শোকেরই। যে যাওয়ার সে তো চলেই গেলেন। আর রেখে গেলেন জ্বলন্ত কিছু স্মৃতি, কিছু ইতিহাস। সেটাই সম্বল আগামী প্রজন্মের কাছে। বাকিটা টুপি বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছবির। যার মাঝে হারিয়ে যাওয়া আমাদের মতো হাজার হাজার পাগল মন নীরবে এক তোরা ফুল রাখবে তাঁর পায়ের কাছে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...