কোপা আমেরিকার গতবারের দুই ফাইনালিস্ট মুখোমুখি এবার সেমিফাইনালেই। পেরুর অপেক্ষাকে দীর্ঘায়িত করে আবারো ফাইনালে নেইমারের ব্রাজিল। লুকাস পাকুয়েতার একমাত্র গোলে পেরুকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে গেছে সেলেসাওরা।
১৯১৯ সালে চার দলের অংশগ্রহণে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর এই মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। সেবার উরুগুয়েকে হারিয়ে বিজয়ের বরমাল্য পড়ে স্বাগতিক ব্রাজিল। এরপর ব্রাজিল স্বাগতিক হয়েছে আরো চারবার এবং প্রতিবারই তারা শিরোপা রেখে দিয়েছে নিজেদের দেশেই।
একবারো শিরোপা তাদের কাছ থেকে নিয়ে আসতে পারেনি অন্যরা। ১৯২২ এর আমিলগা-নেকো কিংবা ১৯৪৯ সালের জিজিনহো-সিমাওরা ধরে রেখেছিলেন স্বাগতিক দাপট। ১৯৮৯ সালে বেবেতো দেখিয়েছিলেন গোল কিভাবে করতে হয়। গতবারের কোপাতেও নেইমারবিহীন ব্রাজিল হতাশ করেনি পূর্বসূরিদের, জেসুস-এভারটন-রিচার্লিসন ত্রয়ী দেখিয়েছিল নিজেদের দাপট।
রোনালদিনহোর প্রস্থানের পর ব্রাজিল ঠিক সেই মানের তারকা পাচ্ছিলো না। রবিনহো, পাতো, আদ্রিয়ানোরা আশা জাগিয়েছিলেন, কিন্তু ধরে রাখতে পারেননি। কাকা অনেকটা রোনালদিনহোর কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন কিন্তু ইনজুরি নামক বাঁধার কারণে আকাশছোঁয়া হয়নি তাঁর।
অবশেষে ব্রাজিল পায় তাদের রাজকুমারকে। অভিষেকের পর থেকেই ব্রাজিল দলের মধ্যমণি। দুঙ্গা, মেনেজেস থেকে বর্তমান কোচ তিতে সবার দল সাজিয়েছেন তাকে কেন্দ্র করেই। তাদের আস্থার প্রতিদানও দিয়েছেন তিনি, ২০১৩ সালে ব্রাজিলকে জেতান কনফেডারেশন্স কাপের শিরোপা। চার গোল করে জিতে নেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব।
পরের বছর ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দলকে নিয়ে যান কোয়ার্টার ফাইনালে। তার কাঁধে চেপে ব্রাজিল বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখলেও জুনিগার এক ফাউলে তার ক্যারিয়ারটাই হুমকির মধ্যে পড়ে যায়। কিন্তু থেমে থাকেননি তিনি, ফিরে এসেছেন প্রবল বিক্রমে।
ব্রাজিলের হয়ে নিয়মিত ভালো খেললেও কেন যেন ট্রফির দেখা পাচ্ছিলেন না নেইমার। অবশেষে ব্রাজিলের শতবছরের আক্ষেপ ঘুচিয়ে ঘরের মাঠে অলিম্পিক ফুটবলের শিরোপা জেতান এই তারকা। কিন্তু সেটা তো অনুর্ধ্ব-২৩ দলের টুর্নামেন্ট, ব্রাজিলের সেরা তালিকায় জায়গা পেতে যে দরকার বৈশ্বিক কিংবা মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্ব।
সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছিলেন কিন্তু গত কোপার ঠিক আগমুহূর্তে ইনজুরির কারণে ছিটকে যান টুর্নামেন্ট থেকে। পরে ব্রাজিল শিরোপা জিতে আক্ষেপ বাড়ায় নেইমারের। এবারের কোপা জিততে তাই দেখা মিলেছে দৃঢ়প্রত্যয়ী এক নেইমারের। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই দলকে টানছেন একা হাতে। দারুণ গতির পাশাপাশি অনবদ্য ড্রিবলিং করে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ছিটকে ফেলে ত্রাস ছড়াচ্ছেন প্রতিপক্ষ রক্ষণভাগে।
তাঁকে ছাড়া ব্রাজিল কতটা দুর্বল সেটা বুঝা গিয়েছিল ইকুয়েডরের বিপক্ষে গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে, সেদিন কোচ তিতে বিশ্রাম দিয়েছিলেন তাকে। তার অনুপস্থিতিতে নখদন্তহীন ব্রাজিল ড্র করে দুর্বল ইকুয়েডরের সাথে। অথচ কোয়ার্টার ফাইনালে নেইমার ফিরতেই পুরনো চেহারায় সেলেসাওরা। নেইমার আত্ননির্ভর ফুটবল খেলেন এমন একটা গুঞ্জন চারিদিকে থাকলেও এবারের টুর্নামেন্টে সেটা ঝেড়ে ফেলেছেন এই তারকা।
দলের আক্রমণে অনেক বেশি একাত্ম হয়েছেন, নিজে গোল করার পাশাপাশি সতীর্থদের দিয়ে গোল করাচ্ছেন। বিশেষ করে লুকাস পাকুয়েতার সাথে তার জুটি বেশ জমে উঠেছে। নেইমারের দারুণ পাস থেকে পাকুয়েতার সহজ ফিনিশিং নিয়মিত দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এবারের কোপাতে। কোয়ার্টার আর সেমিফাইনাল দুই ম্যাচেই দেখা গেছে একই দৃশ্য।
পেরুর বিপক্ষে সেমিফাইনালের গোলের কথাই ধরুন না, তিন পেরুভিয়ান ডিফেন্ডার ঘিরে ধরেছিলেন নেইমারকে। কিন্তু সেই জটলার মাঝে থেকে দারুণ দক্ষতায় বল বের করে গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে বল বাড়ালেন ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা পাকুয়েতাকে। পাকুয়েতা আলতো ছোঁয়ায় বলকে দিলে জালের স্পর্শ।
ফাইনালে ব্রাজিলের মুখোমুখি হবে আর্জেন্টিনা বনাম কলম্বিয়ার মাঝে জয়ী দল। মারকানার ফাইনালে নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রেখে ছয়ে ছয় করতে পারে কিনা সেটার জন্য কেবল রবিবারের অপেক্ষা।