একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি।
শেফিল্ড শিল্ডের ম্যাচ চলছে। মাত্রই উইকেটে এসেছেন স্টিভ ওয়াহ। স্লিপে দাঁড়িয়ে সিডন্স।
স্টিভ স্টান্স নিতে একটু বেশিই সময় নিচ্ছিলেন। সিডন্স পেছন থেকে টিপ্পনি কেটে বলেন, ‘স্টিভ, ওপরওয়ালার দোহাই, এটা তো আর টেস্ট ম্যাচ নয়।’
স্টিভ ওয়াহ সুযোগটা ছাড়লেন না। পাল্টা খোঁচা দিলেন, ‘অবশ্যই এটা টেস্ট নয়। কারণ, এখানে তুমি আছো!’
এটাই হয়ত হয়ে রইবে জেমি সিডন্সের চিরকালীন এক আক্ষেপ। বাংলাদেশ জাতীয় দলের বর্তমান ব্যাটিং কোচ সিডন্স একটা সময় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেট। ২৫ এপ্রিল ১৯৬৪ সালে তিনি জন্মেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়াতে।
সময়ের পরিক্রমায় একটা পর্যায়ে তিনি ক্রিকেটকে ভালবেসে ফেলেন। সেই থেকে অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটের নিজেকে বিকশিত করবার কাজটা শুরু করেন তিনি। এরপর ক্রমবর্ধমান সিড়ি বেয়ে নিজের ক্যারিয়ারটা সমৃদ্ধ করতে শুরু করেন। তিনি যখন প্রায় জাতীয় দলে খেলার জন্য প্রস্তুত, তখন অজিদের ব্যাটিং লাইন আপটা ছিল বেশ কম্প্যাক্ট।
অ্যালান বোর্ডার, স্টিভ ওয়াহ, মার্ক ওয়াহ, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, রিকি পন্টিংদের মত তারকা ব্যাটারদের দখলে তখন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইন আপ। একেবারে সব আলো কেড়ে নেওয়ার শক্তি ছাড়া তখনকার অজি দলে সুযোগ পাওয়াই দুষ্কর।
তবুও সিডন্স অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে একটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে লাহোরে তিনি খেলতে নেমেছিলেন। একেবারেই যে খারাপ করেছিলে তিনি সেটা বলবার উপায় নেই। ৩২ রানের একটি ইনিংস তিনি খেলেছিলেন ওয়ানডেতে। সেটাই তার জাতীয় দলের প্রথম, একমাত্র ও শেষ স্মৃতি।
অথচ তিনি অস্ট্রেলিয়ার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে রান করেছেন দেদারছে। শেফিল্ড শিল্ডে তিনি ৪৫ গড়ে রান করেছেন। নামের পাশে আছে ১১ হাজারের বেশি রানের একটি ট্যালি। ৩৫টা সেঞ্চুরি তিনি করেছেন। সেই অংকগুলোর স্থান ওলোট-পালোট করে দিলেই হয়ে যায় তার হাফ সেঞ্চুরির সংখ্যা।
তবুও অজিদের সেই ‘ব্যাগিগ্রিন’ মুকুট পরার সৌভাগ্য হয়নি সিডন্সের। আক্ষেপ নিয়ে নিজের খেলোয়াড়ী জীবনের অবসান ঘটিয়েছিলেন তিনি। সেটাই তো প্রত্যাশিত। কিন্তু তিনি ফিরে আসার চেষ্টা করলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসে তিনি একটু জায়গা করে নিতে চাইলেন। তাইতো কোচিং ক্যারিয়ারকে বেছে নেওয়া।
মোটাদাগে তিনি ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আলোকিত সময় কাটিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাথে। প্রথমত তিনি ২০০৭ সালে এসেছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রধান কোচ হয়ে। সেবার প্রায় বছর চারেক ছিলেন তিনি জাতীয় দলের হেডমাস্টার হয়ে। তার সময়ে বাংলাদেশের উন্নতির গ্রাফ ধরে উপরের দিকেই ধাবমান।
সেবার জয় রথ নিয়েই তিনি হাজির হয়েছিলেন বিশ্বকাপের মঞ্চে। বাংলাদেশ তখন বেশ দারুণ সময় পার করছিল তার অধীনে। ২০১১ বিশ্বকাপটায় চমক দেখাবে টাইগাররা সেটাই প্রত্যাশিত ছিল। সিডন্স তেমনই ছক কষেছিলেন। তাছাড়া চেনা কন্ডিশনে ভাল করবারই কথা। তবে চমক দেখিয়েছে ঠিক, তবে তার বিপরীতমুখী। লজ্জার সব রেকর্ডের সাথে যুক্ত হয়ে যায় টাইগার ক্রিকেট।
দায়ভার খানিকটা সিডন্সের উপরও বর্তায়। সে দায় মাথায় নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাথে তার অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। সেই তিনি আবার ফিরে আসেন প্রায় এক দশকের বেশি সময় পরে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে দ্বিতীয় দফা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে এবারের দায়িত্বটা খানিকটা সীমিত। তিনি কেবলই একজন ব্যাটিং কোচ।
অবশ্য এতে তার উপর থেকে চাপ খানিকটা কমে। তাছাড়া তার ইতিহাস অনুযায়ী ব্যাটিং কোচের রোলটাই তো তার জন্য যথাযথ। অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটের কিংবদন্তি একজন ব্যাটার তিনি। ব্যাটিংয়ের খুঁটিনাটি নিশ্চয়ই বেশ ভালভাবেই জানা তার। তাছাড়া অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, শেন ওয়াটসনদের মত ক্রিকেটারদেরকে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা তো ছিলই তার।
সব মিলিয়ে টাইগার ক্রিকেটে এই রোলটায় বেশ মানিয়ে নিয়েছেন সিডন্স। সাফল্যও এসে ধরা দিচ্ছে। তার শিষ্যরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভাল করছে। ক্রমশ দলের ব্যাটিং ইউনিট আরও পোক্ত হচ্ছে। ভিনদেশী হয়েও বাংলাদেশের ক্রিকেটে আস্থার একটা জায়গা তৈরি করে নিতে পেরেছেন তিনি। তাই হয়ত তিনি আরও একটিবার স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন। শেষটায় এবার অন্তত বিষাদ উপহার দেবে না তার শিষ্যরা। সে আশাই হয়ত করছেন সিডন্স।