ঠাণ্ডা মেজাজি ঘাতক

ক্রিকেটীয় পরিবারের অংশ ছিল তিন ভাই। বাবা ক্লাব ক্রিকেট খেলতেন। সেই দেখেই ভাইয়েদের ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ জন্মেছিল। যদিও বেশিরভাগ দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীর মত এদেরও পছন্দের একটা অংশ ছিল রাগবি।

তিন ভাই যখন একসাথে ঘরের পেছনের মাঠে খেলতো তখন অনেক কিছুর সাক্ষী থাকতো সেই মাঠ যেমন আমাদের জীবনেও থাকে। ছোট ভাই দুবলা-পাতলা বলে সবসময় তার উপর ছড়ি ঘোরাতো দুই বড় ভাই।সেই দুবলা-পাতলা কিশোর মরনে মরকেইল একদিন ৬ ফুট ৫ ইঞ্চির এক ভয়ংকর ও কার্যকর এক পেসার হয়ে উঠেছিলেন।

দীর্ঘদেহী পেসার হিসেবে আস্তে আস্তে পরিচিত হয়ে উঠবার মাঝে বড় বাঁধা ছিল প্রচুর ‘নো বল’ করার প্রবনতা। ২০০৩-০৪ মৌসুমে ১৯ বছর বয়সে যখন সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বিরুদ্ধে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হয় তখন প্রথম পাঁচ ওভারেই ১৭ টি ‘নো বল’ করেন। ঘরোয়া ক্রিকেটেও কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ‘নো বল’ এর জন্য দলকে ভুগতে হচ্ছিল, যদিও মরকেলের পেস এবং লাইন-লেংথ সবার মনোযোগ কাড়তে পেরেছিল।

ভাগ‍্যক্রমে এই সময় তিনি চোখে পড়ে যান দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি অ্যালান ডোনাল্ডের। শৃঙ্খলাপরায়ন হবার পাঠটা তিনিই দিতে থাকেন, যদিও সমূলে বিনাশ হয়তো করতে পারেননি। কিন্তু তাঁর পরামর্শ, প্রশিক্ষণ ও তদারকিতে পাল্টে যেতে থাকে মরকেলের।

এরপর এল সাত ডিসেম্বর, ২০০৬। পেসারটির জীবনের রূপরেখা তৈরী করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল সেটা। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে ভারতের প্রস্তুতি ম‍্যাচ তথা ট্যুর ম‍্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকা ‘এ’ দলের হয়ে সুযোগ পান তিনি। এর থেকে বড় মঞ্চ আর হয় না নিজেকে নির্বাচকদের কাছে প্রমাণ করবার।

পরে নিজেই একদিন জানিয়েছেন ওই দিনটি তাঁর জন্য খুব নার্ভাস কাটে, কারণ প্রতিপক্ষের সেরা পাঁচ জনের বিরুদ্ধে প্রথম বল করতে চলেছেন। তবে, সেই চাপ ভুলে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন অসাধারণ ভাবে। নিজের প্রথম বলেই বীরেন্দ্র শেবাগের উইকেট উপড়ে দিয়েছিলেন। এরপর একে একে লক্ষণ, শচীন, ধোনি – সে হোক না যতই প্রস্তুতি ম‍্যাচ।

এরপর আর দেশের হয়ে অভিষেকের জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। বক্সিং ডে টেস্টে যখন দল ১-০ তে পিছিয়ে এবং দলের অন‍্যতম গুরুত্বপূর্ণ বোলার এবং তাঁর ভবিষ্যৎ ‘পার্টনার ইন ক্রাইম’ ডেল স্টেইন চোট পেলেন তখন সম্মানজনক টুপিটি মাথায় পরার সৌভাগ্য হলো। ওই ম‍্যাচে দু’ইনিংসেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু রান এবং ভারতের প্রথম ইনিংসে তিন উইকেট নিয়ে (যার মধ্যে প্রথম উইকেট ছিল মহেন্দ্র সিং ধোনি) দলের জয়ে অসাধারণ ভূমিকা রাখলেন।

২০০৭ বিশ্বকাপের পর যখন দলের দুই প্রধান স্তম্ভ শন পোলক এবং মাখায়া এনটিনি অবসর নিলেন তখন ওই দীর্ঘদেহী পেসারই হয়ে উঠলেন গ্রায়েম স্মিথের অন‍্যতম প্রধান অস্ত্র। তখনকার বিশ্বের সেরা পেসার স্টেইনের সাথে জুটি বেঁধে একের পর দলকে ভেঙে দিতে থাকলেন। এরপর আবার যখন আরেক অসাধারণ সুইং বোলার ভার্নন ফিল্যান্ডার তাঁদের সাথে যোগ দিলেন, তখন দক্ষিণ আফ্রিকা দলকে রুখে কে।।বিশ্বের অন‍্যতম সেরা পেস বোলিং লাইন আপে পরিনত হওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘদিন দেশকে সেবাও করতে পারলেন তাঁরা।

একজন পেসারের স্বাভাবিক দুই অস্ত্র হল গতি ও সুইং, এটা মরকেলেরও শক্তির জায়গা ছিল। তবে, তিনি সুইং এ কিছুটা অপটু হলেও এনার সিম মুভমেন্ট ছিল অসাধারণ। মরকেলের প্রধান শক্তি ছিল পেস এবং অনিয়মিত বাউন্স। ক্রমাগত এক জায়গায় বল রাখতে পারতেন। আর এভাবেই হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের অন‍্যতম ‘আনপ্লেয়েবল পেসার’।

যদিও একজন পেস বোলার হিসেবেও তিনি অতোটা অ্যাগ্রেসিভ ছিলেন না অন‍্যান‍্য পেসার বা নিজের প্রধান সহযোগী স্টেইনের মত। বলা যায় স্টেইনের আড়ালে ঢাকা পড়তো তাঁর কীর্তিগুলো। যদিও, মানুষ এবং ক্রিকেটার দুক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অসাধারণ।নিজের কাজ করতেন এবং আবার বোলিং ক্রিজে ফিরে যেতেন, মেশিনের মত একটা ব্যাপার। যেন, কম্পিউটার দিয়ে প্রোগ্রামিং করে দেওয়া। ব‍্যাটসম‍্যানদের দিকে তেড়ে যাওয়া বা স্লেজিং করা তার ধাঁচে ছিল না।

আন্তর্জাতিক মঞ্চে ৮৬ টি টেস্টে ২৭.৬৬ গড়ে ৩০৯ উইকেট, ১১৭ টি ওয়ানডেতে ২৫.৩২ গড়ে ১৮৮ উইকেট এবং ৪৪ টি ম‍্যাচে ২৫.৩৪ গড়ে ৪৭ উইকেট পেয়েছেন। এই রেকর্ড আরও ভাল হত যদি চোটের জন্য শেষের দিকে মাঝে মাঝেই অনিয়মিত হয়ে না পড়তেন।

ক‍্যারিয়ারের ভাল সময়ে সব সময় র‍্যাংকিংয়ে প্রথম দশের মধ্যেই থাকতেন। চোট ও পরিবারকে সময় দেওয়ার জন্য মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই অবসর নিয়েছেন। কিন্তু, তার বিপরীতে খেলা সব ব‍্যাটসম‍্যানদের জন্য রেখে গিয়েছেন অসাধারণ পেসের সাথে অকওয়ার্ড বাউন্সের ভয়ংকর সব দু:স্মৃতি। আর বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে হারের পর তাঁর অশ্রু সজল চোখে মাঠের মধ্যে বসে থাকা স্মৃতি রয়ে গিয়েছে সমর্থকদের মনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link