৬৪ বলে সাকিব আল হাসান ৭৭ রানের ইনিংস খেললেন। পরিস্থিতির বিচারে অনন্য অবশ্যই। কিন্তু সাকিবের জন্য এমন ইনিংস একেবারে নতুন কিছু নয়।
আসলেই কী তাই? সাকিব আল হাসান কী এমন করেই খেলেন?
একটু সাকিবের ব্যাটিংটা চোখ বুজে মনে করার চেষ্টা করুন। সাকিবের ইনিংস মানেই আগে স্কয়ার কাট, স্কয়ার ড্রাইভ আর পুলের ফুলঝুরি। এভাবেই রান করে এসেছেন তিনি। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কী দেখলেন? স্কয়ার দিয়ে ব্যাট চালানোতেই স্বচ্ছন্দ সাকিব এই ম্যাচে অনেক বেশি আক্রমনাত্মক ছিলেন লং অফ ও লং অন এলাকায়। ‘ভি’-এর মধ্যে খেললেন অনেকগুলো শট। তিনটি ছক্কাই ওই এলাকা থেকে মেরেছেন। এক গাদা চারও মেরেছেন।
তাহলে কী সাকিব বদলে গেলেন?
হ্যাঁ, আমরা যদি ব্যাটিং পজিশন, বডি পজিশন, শট এরিয়া এবং ব্যাট সুইং বিচার করি তাহলে বলতে হবে, সাকিব আল হাসান আমূল বদলে গেছেন। ২০১৯ সালের সেই ভয়ানক ফর্মের সাকিব আল হাসানের সাথে এই সাকিবকে মেলাতে গেলে আপনি আবিস্কার করবেন একেবারেই নতুন এক ব্যাটসম্যানকে।
সাকিবের ব্যাটিং ভঙ্গির এই বদলটা প্রথম দেখা গেলো গত বিপিএলে। ২০১৯ বিশ্বকাপের দূরন্ত পারফরম্যান্সের পরই একেবারে রানখরায় ভুগতে শুরু করেছিলেন সাকিব। এবারের বিপিএলে এসে দীর্ঘকাল পর রান পেলেন। আর তখনই চোখে পড়লো এই বদলে যাওয়া সাকিবকে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয় পাওয়া প্রথম ম্যাচে পরিষ্কার হয়ে গেলো, সাকিব নিজের ভঙ্গিটা বদলে ফেলেছেন পুরোপুরি। খোঁজ নিয়ে এর নেপথ্য গল্পটাও জানা গেলো। নেপথ্য গল্প শোনার আগে বদলগুলো দেখে নেওয়া যাক।
- বডি পজিশন
সাকিব আগে উইকেটে দাড়াতেন অনেকটা সোজা হয়ে। দূর থেকে একটা সরল রেখা বলে ভুল করলেও করা যেতো। এখন সাকিবের সেই বডি পজিশনটা বদলে গেছে। উইকেটে অনেক ঝুকে দাড়াচ্ছেন তিনি। ফলে হাত অনেক বেশি রিল্যাক্স থাকছে।
একটু ঝুকে উইকেটে দাড়ানোর এই পজিশনে আসার পেছনে তার ইনজুরিরও একটা ভূমিকা থাকতে পারে। এই পজিশনে আগের পজিশনের চেয়ে তিনি হয়তো শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্য বেশি পাচ্ছেন।
- চেস্ট পজিশন
এখন সাকিব অনেকটাই ওপেন চেস্টেড পজিশনে ব্যাট করছেন। আগে তিনি বোলারের দিকে একেবারেই আড়াআড়ি হয়ে থাকতেন। ফলে বল দেখার জন্য তুলনামূলক সময়টা কম পেতেন। এখন তিনি অনেক বুকটা সামনের দিকে উন্মুক্ত করে দাড়াচ্ছেন।
এই পজিশনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এতে আপনি যেমন বল দেখার জন্য বেশি সময় পাবেন, তেমনই হ্যান্ড-আই কোঅর্ডিনেশন কাজে লাগানোর সুবিধা বেশি পাবেন। সাকিবের মত যারা টেকনিকের ওপর অতো বেশি ভরসা করেন না, তাদের জন্য এই পজিশন খুব ভালো কাজ করে।
- ব্যাট
একটু খেয়াল করলে দেখবেন, সাকিবের ব্যাট ধরার অবস্থানটাও বদলে গেছে। আগে স্ট্যান্সে তার ব্যাট অনেক উচু থাকতো। ফলে ব্যাট নামানোর জন্য সময়টা একটু কম পেতেন। যদিও অনেকে মনে করেন, ব্যাট উচুতে থাকলে পাওয়ার বেশি জেনারেট করা যায়। কিন্তু সাকিব ও তার কোচ নিশ্চয়ই অন্যরকম মনে করেছেন। ফলে ব্যাটের অবস্থানটাও বদলে গেছে তাঁর।
- টপ হ্যান্ড
এই জায়গাটায় একটা বড় পরিবর্তন এসেছে সাকিবের। আগে মূলত বটম হ্যান্ডেই সাকিব খেলতেন। ইনফ্যাক্ট সারা পৃথিবীর খেলোয়াড়দের বড় অংশই মূলত বটম হ্যান্ড নির্ভর। কিন্তু সাকিবের মনে হচ্ছিলো, তার ব্যাট স্পিড বাড়ানো দরকার। আর সে জন্য সেরা সমাধাণ ছিলো দুই হাতে সমান শক্তি দিতে পারা।
এ জন্য সাকিব বিশেষ কিছু অনুশীলন করেছেন। করে দুই হাতেই এখন সমান শক্তি দিতে পারছেন। এতে অনেক অনেক বেড়ে গেছে সাকিবের ব্যাটের গতি। এখন তিনি বলতে আগের চেয়ে অনেক পরে শুরু করেও দ্রুত আঘাত করতে পারছেন। এটা করতে তাকে দুটো হাতের পজিশনও একটু এডজাস্ট করতে হয়েছে।
নেপথ্য গল্প
এবার আসুন, এই পুরো ব্যাপারটা কিভাবে ঘটলো, তা নিয়ে।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, নিষেধাজ্ঞার পর সাকিব বিকেএসপিতে একটা নিবিঢ় ক্যাম্প করেছিলেন। সেখানে তার সাথে ছিলেন দু জন বিশেষজ্ঞ কোচ-নাজমুল আবেদীন ফাহিম ও মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। এ ছাড়া সেখানে কয়েকজন সহায়তাকারী কোচও ছিলেন।
সে সময়ই আসলে সাকিবের এসব টেকনিক নিয়ে বেশ কাজ করা হয়। কিন্তু কাজ করলে সাথে সাথে তো সেটা প্রয়োগ করা যায় না। সাকিব সেই ব্যাপারগুলো নিয়ে অনেক কাজ করেছেন, অনেক অনুশীলন করেছেন। অবশেষে দেখা যাচ্ছে, তিনি সেটা মাঠে প্রয়োগ করতে শুরু করেছেন। আর তার ফলও মিলছে।
সাকিব আল হাসানের বয়সে কেউ একজন এভাবে যখন নিজেকে বদলে ফিরে আসার উদাহরণ তৈরি করেন, সেটা দেশের ক্রিকেটের জন্যই অসাধারণ একটা ব্যাপার হয়। তরুন যারা ব্যর্থতার জন্য দলের বাইরে আছেন, তারা নিজেদের বলতে পারবেন, আমরাও পারবো।
সাকিব হয়ে উঠুন আরেকটা উদাহরণ।