১৯২৮ সালে টেস্ট মর্যাদা পেলেও বিশ্ব ক্রিকেটে প্রতিষ্ঠা পেতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের। নিজেদের পায়ের তলায় শক্ত মাটির সন্ধান যেন তারা কিছুতেই পাচ্ছিল না। ক্যারিবীয় ক্রিকেটের উত্থানের শুরুটা হয়েছিল মূলত ’৫০ দশকের গোড়ার দিকে; প্রথম বারের মত যখন তারা ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট জয়ের স্বাদ পায়।
১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চার টেস্টের সিরিজ খেলতে ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথম টেস্ট স্বাগতিকরা জিতলেও পরের টেস্টে ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ক্যারিবীয়রা। টানা তিন ম্যাচ জিতে নিশ্চিত করেছিল সিরিজ জয়টাও। টেস্ট মর্যাদা প্রাপ্তির ২২ বছরে একবারও ‘ইংল্যান্ডের মাটিতে’ ইংল্যান্ডকে হারাতে না পারা ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য এই বিজয় ছিল নি:সন্দেহে একটি ঐতিহাসিক অর্জন।
বিশ্ব ক্রিকেটে পরাশক্তি হিসেবে ক্যারিবীয়দের উত্থানের শুরুর গল্পটা রচিত হয়েছিল লর্ডসের মাটিতে, সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে। আর ‘ঐতিহাসিক’ এই টেস্ট ম্যাচ নিয়ে বলতে গেলে প্রসঙ্গক্রমে চলে আসে ২৪ বছর বয়সী এক বার্বাডিয়ান তরুণের কথা। যার অপরাজিত ১৬৮ রানের ইনিংসটাকেই ম্যাচের প্রধান ‘টার্নিং পয়েন্ট’ বলে এক বাক্যে মেনে নেন সবাই।
আপনাদের নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে, কে ছিলেন এই তরুণ? তিনি আর কেউ নন; তর্ক-সাপেক্ষে ‘৫০ দশকের সেরা ব্যাটসম্যান; সাবেক ক্যারিবীয় ব্যাটিং কিংবদন্তী, স্যার ক্লাইড ওয়ালকট।
স্যার ক্লাইড ওয়ালকট ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিখ্যাত ‘থ্রি ডব্লুজে’র কনিষ্ঠতম সদস্য। এই ত্রয়ীর বাকি দুজন হলেন স্যার ফ্রাংক ওরেল আর স্যার এভারটন উইকস। তিন জনের মধ্যে বয়সে সবার ছোট হলেও উচ্চতায় ওয়ালকটই ছিলেন সবচেয়ে লম্বা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অন্যতম প্রধান দুর্বলতা ছিল মিডল অর্ডার ব্যাটিং। ‘থ্রি ডব্লুজের’ আবির্ভাবের পর সেই ‘দুর্বল’ মিডল অর্ডারই পরিণত হয় বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইন আপে। ওরেল-ওয়ালকট-উইকস ত্রয়ীর গ্রেটনেসের সামনে মাথা নত করতে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার নেইল হার্ভে, লিন্ডসে হ্যাসেট; ইংল্যান্ডের ডেনিস কম্পটন, পিটার মে, টম গ্রেভেনি; ভারতের বিজয় হাজারে, পলি উমরিগড়ের মত বিশ্বমানের ব্যাটসম্যানদেরও। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট ইতিহাসেই এই তিনজনের মত দাপুটে ও সফল মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান খুব কম এসেছেন।
মূলত নামের আদ্যক্ষরের মিলের কারণেই তাঁরা পরিচিতি পান ‘থ্রি ডব্লুজ‘ হিসেবে। তাঁদের সম্পর্কে প্রায়ই মজা করে একটা কথা বলা হয়ে থাকে, থ্রি ডব্লুজের নামে যদি কখনও একটা ওয়েবসাইট খোলা হত তবে সেটার এড্রেস লেখা হত এভাবে www.www!
এঁদের তিনজনের মধ্যে কেবল নামের মিল (আদ্যক্ষর W) ছাড়াও আরও অনেক মিল ছিল। যেমন -এরা তিনজনই জন্মেছিলেন বারবাডোজের ব্রিজটাউনে, মাত্র ১৭ মাসের ব্যবধানে (১৯২৪ সালের আগস্ট-১৯২৬ সালের জানুয়ারি)।
এখানেই শেষ নয়। তাঁদের তিনজনের পরিবারই বসবাস করত কেনসিংটন ওভাল থেকে মাত্র ১ মাইলের মধ্যে। তিনজনেরই অভিষেক হয়েছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, ১৯৪৮ সালে একই সিরিজে। তিনজনই ছিলেন মূলত মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। ক্রিকেটে অবদানের জন্য তিন জনকেই পরবর্তীকালে ‘নাইটহুড’ উপাধিতে সম্মানিত করা হয়।
১৯২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি বারবাডোজের ব্রিজটাউন এলাকার নিউ অর্লিয়েন্সে জন্মগ্রহণ করেন ক্লাইড ওয়ালকট। তিনি পড়াশোনা করেছেন কম্বারমেয়ার স্কুলে। এরপর ১৪ বছর বয়সে ভর্তি হন বারবাডোজের বিখ্যাত হ্যারিসন কলেজে। প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে হাতেখড়িটাও সেখানেই।
কলেজ দলের হয়ে খেলার সময় টপ অর্ডারে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি উইকেটরক্ষকের দায়িত্বটাও তাঁকেই পালন করতে হত। অকেশনাল মিডিয়াম পেসার হিসাবে বোলিংয়ের হাতটাও নেহাত মন্দ ছিল না। ইনসুইঙ্গারসহ বোলিংয়ের বেশ কিছু কলাকৌশলও রপ্ত করেন কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থাতেই। মাল্টি স্কিল্ড ক্রিকেটার হিসেবে অচিরেই তাঁর বেশ নামডাক ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি। ১৬তম জন্মদিনটা ওয়ালকটের জন্য ছিল খুবই স্পেশাল। কেননা জন্মভূমি বারবাডোজের হয়ে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে অভিষেক ম্যাচটা যে ওইদিনই খেলেছিলেন! প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে শুরুর দিকে অতটা সফলতা না পেলেও লম্বা ইনিংস খেলার অভ্যাসটা গড়ে তোলেন সেখান থেকেই।
১৯৪৬ সালে ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেনে, ইন্টার আইল্যান্ড কম্পিটিশনের এক ম্যাচে, ‘স্কুলফ্রেন্ড’ ফ্রাঙ্ক ওরেলকে সাথে নিয়ে চতুর্থ উইকেটের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে ওয়ালকট যোগ করেন ৫৭৪ রান। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে যা একটি বিশ্বরেকর্ড এবং যে রেকর্ড আজও কেউ ভাঙতে পারে নি। ওয়ালকট করেছিলেন ৩১৪*, ওরেল ২৫৫*।
১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হোম সিরিজ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পুনর্জাগরণ ঘটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে প্রায় ৮ বছর (১৯৩৯-১৯৪৭) টেস্ট ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত ছিল ক্যারিবিয়ানরা।
ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফর্ম করে সিরিজের প্রথম টেস্টেই মূল একাদশে জায়গা করে নেন ক্লাইড ওয়ালকট। ওই সিরিজেই অভিষিক্ত হন ওরেল-উইকসরাও। অবশ্য অভিষেকে মনে রাখার মত তেমন কিছুই করতে পারেন নি ক্লাইড। ইনিংস উদ্বোধন করতে নেমে দু’বারই ফিরে যেতে হয় অল্প রানে (৮ ও ১৬)। ব্রিজটাউনে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচটি শেষ হয়েছিল অমীমাংসিত-ভাবে।
টেস্ট আঙিনায় নিজের সামর্থ্যটা জানান দিতে অবশ্য খুব বেশি দেরি করেননি তিনি। ওই বছরই ভারত সফরে পাওয়া সুযোগটা কাজে লাগিয়েছিলেন দারুণভাবে। দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলায় চারে নেমে খেলেন অপরাজিত ১৫২ রানের চমৎকার এক ইনিংস। কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে পেয়ে যান টেস্ট ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরিটাও (১০৮)। জীবনের ‘প্রথম’ বিদেশ সফরেই দুর্দান্ত খেলা ওয়ালকটের সিরিজ টোটাল ছিল ৪৫২ রান, এভারেজ ৬৪.৫৭। সেঞ্চুরি ও ফিফটি ছিল দু’টি করে। স্বাধীনতা লাভের পর সেবারই প্রথম বিদেশি কোন দলকে আতিথেয়তা দিয়েছিল ভারত।
ভারত সফরে পাওয়া দুর্দান্ত ফর্মটাই তিনি বয়ে নিয়ে যান ইংল্যান্ডে। ব্যাট হাতে থ্রি ডব্লুজের আধিপত্য আর সনি রামাধিন-আলফ ভ্যালেন্টাইন জুটির স্পিন ভেলকির সৌজন্যে প্রথমবারের মত ইংল্যান্ডকে তাদেরই মাটিতে সিরিজ হারাতে (৩-১ ব্যবধানে) সক্ষম হয় ক্যারিবীয়রা। লর্ডস টেস্টে ওয়ালকটের খেলা অনবদ্য ১৬৮* রানের ইনিংসটার কথা লেখার শুরুতেই বলেছি একবার।
১৯৫৪ সালে ‘ঘরের মাঠ’ বারবাডোজের কেনসিংটন ওভালে সফরকারী ইংলিশদের বিপক্ষে পেয়ে যান ক্যারিয়ারের একমাত্র ডাবল সেঞ্চুরিটাও। চারে নেমে খেলা ২২০ রানের স্ট্রোক ঝলমলে ইনিংসটা আক্ষরিক অর্থেই ছিল তাঁর ‘ক্যারিয়ার সেরা’। ব্রায়ান স্ট্যাথাম, ট্রেভর বেইলি ও টনি লকের মত বোলারদের রীতিমতো পিটিয়ে তুলোধুনো করেছিলেন সেদিন। অনবদ্য সেই ইনিংসে ভর করেই শক্তিশালী ইংল্যান্ডকে সেবার হারাতে পেরেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
পুরো সিরিজ জুড়ে দারুণ ফর্মে থাকা ক্লাইড ওয়ালকট শতক হাঁকিয়েছিলেন আরও দুটো। ৩ সেঞ্চুরিতে ৮৭.২৫ গড়ে সিরিজ শেষে তাঁর সংগ্রহ দাঁড়িয়েছিল ৬৯৮ রান।
১৯৫৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঘরের মাটিতে পাঁচ ম্যাচের সিরিজে ৩-০ ব্যবধানে বিধ্বস্ত হয় ক্যারিবিয়ানরা। তবে রে লিন্ডওয়াল, বিল জনস্টন, কিথ মিলার, রিচি বেনো, ইয়ান জনসনদের নিয়ে গড়া অস্ট্রেলিয়ার শক্তিশালী বোলিং আক্রমণের সামনে প্রতিরোধের দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন একজনই! স্যার ক্লাইড ওয়ালকট!
নিজের দল হেরেই চলেছে, সতীর্থদের আত্মবিশ্বাস প্রায় তলানিতে অথচ ওয়ালকটের ব্যাটে রানবন্যা যেন থামছিলই না! ৫ সেঞ্চুরি, ২ ফিফটিতে সিরিজসেরা ওয়ালকট করলেন ৮২৭ রান! গড় ৮২.৭০! স্যার ক্লাইড ওয়ালকটই টেস্ট ইতিহাসে ‘সর্বপ্রথম’ ব্যাটসম্যান যিনি এক সিরিজে ৫ টি সেঞ্চুরি হাঁকানোর কীর্তি গড়েছিলেন।
স্যার ক্লাইড ওয়ালকটের ক্যারিয়ারে ১৫টি টেস্ট সেঞ্চুরির পাশে হাফ সেঞ্চুরি আছে ১৪টি। ফিফটির চাইতে হান্ড্রেডের সংখ্যা বেশি। অর্থাৎ কনভার্সন রেট ৫০ শতাংশেরও বেশি! ওয়ালকটের সবশেষ টেস্ট সেঞ্চুরিটি এসেছিল ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে হোম সিরিজে, গায়ানার জর্জটাউনে। সেই সিরিজেও ৯৬.৫০ গড়ে তাঁর চারশ’র কাছাকাছি রান ছিল!
পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই সিরিজেই মাত্র ২১ বছর বয়সে টেস্ট ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকান স্যার গ্যারি সোবার্স। কিংস্টনের স্যাবাইনা পার্কে ৩৬৫* রানের মহাকাব্যিক ইনিংসটি খেলার পথে তরুণ বয়সের সোবার্সকে দারুণ সঙ্গ দিয়ে আগলে রেখেছিলেন স্যার ক্লাইড ওয়ালকট (৮৮*)।
১৯৬০ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি। পোর্ট অফ স্পেনের কুইন্স পার্ক ওভালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন ক্যারিয়ারের ৪৪তম ও শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ।
ছয় ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার দীর্ঘদেহী এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান পরিচিত ছিলেন ‘সহজাত স্ট্রোকপ্লেয়ার’ হিসেবে। অদ্ভুত ব্যাটিং স্টান্সের কারণে তাঁকে চিনতেও কোন অসুবিধা হত না। হাঁটু ভাঁজ করে মাটির দিকে সামান্য ঝুকেঁ ‘ক্রাউচড’ পজিশনে স্টান্স নিতেন তিনি। ‘থ্রি ডব্লু’র তিন সদস্যের মধ্যে ওয়ালকটই ছিলেন সবচেয়ে আগ্রাসী। সাবেক ইংলিশ অলরাউন্ডার স্যার অ্যালেক বেডসার বলেছেন, ‘আমার মতে ওয়ালকটই থ্রি ডব্লিউজের মধ্যে সবচেয়ে বড় হার্ডহিটার।’
আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান হলেও তাঁর ছিল অসাধারণ টেম্পারমেন্ট। ডিফেন্স ছিল রক সলিড এবং কমপ্যাক্ট। টেকনিক্যালি সাউন্ড হবার কারণে স্টিকি উইকেটেও দারুণ খেলতেন ওয়ালকট। বিখ্যাত ক্রীড়া সাময়িকী উইজডেনের ভাষ্যমতে, ‘তিনজনের মধ্যে ওয়ালকটকেই ভেজা উইকেটে নিজের সেরা খেলাটা খেলতে দেখা যেত, কারণ তার ডিফেন্সও ছিল খুব ভাল।’
ফ্রন্টফুটের চাইতে ব্যাকফুটে তিনি ছিলেন অধিক স্বচ্ছন্দ। পেছনের পায়ে নিখুঁত ড্রাইভ, পাঞ্চ আর স্কয়ার কাটে ছিলেন রীতিমতো স্পেশালিষ্ট। পুল কিংবা হুকের মত হরাইজন্টাল শটেও ছিল তাঁর অসামান্য পারদর্শিতা।
যেকোন শটেই প্রচুর পাওয়ার জেনারেট করতে পারতেন তিনি। ক্লাইড ওয়ালকটের মত এতটা সাবলীল ‘পাওয়ার প্যাকড’ স্ট্রোক সে যুগে আর কেউ খেলতেন কিনা সন্দেহ আছে। ওয়ালকটের ব্যাটিংকে এককথায় বলা যেতে পারে পাওয়ার আর এগ্রেসনের এক দুর্দান্ত কম্বিনেশন।
বিখ্যাত ক্রিকেট ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ তাঁর একটি লেখায় বলেছিলেন, ‘পাশবিক শক্তির জন্য ওয়ালকটের খুব নাম ডাক ছিল। আমি যদিও তাকে কখনো খেলতে দেখিনি। তবে, আমার বন্ধু পিজি বদ্যনাথান ১৯৪৮-৪৯ মৌসুমে মাদ্রাজ টেস্ট দেখেছিল। ও বলেছিল, ওয়ালকট ব্যাকফুটে গিয়ে ভারতীয় ফাস্ট বোলারের মাথার ওপর দিয়ে ছক্কা হাঁকিয়েছিল!’
ওয়ালকটের ব্যাটিংয়ে শক্তিমত্তার জায়গা যেমন ছিল, তেমনি কিছু দুর্বলতাও ছিল। পেসের তুলনায় স্পিনে তুলনামূলক দুর্বল ছিলেন তিনি। কিংবদন্তী ইংলিশ অফ স্পিনার জিম লেকারকে খেলতে তাঁর বেশ অসুবিধা হত বলে জানা যায়। টেস্ট ক্যারিয়ারে সর্বমোট ১২ বার লেকারের ঘূর্ণিবলে ধরাশায়ী হতে হয়েছে তাঁকে।
স্পেশালিষ্ট ব্যাটসম্যান হলেও হাতে ভাল বিকল্প না থাকায় উইকেটরক্ষক হিসেবে ওয়ালকটই ছিলেন ‘প্রথম পছন্দ’। এমনকি টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুটা বাজে হলেও পরবর্তী সিরিজগুলোতে টিকে গিয়েছিলেন কেবল ভার্সেটাইল ব্যাটিং আর কিপিং দক্ষতার গুণেই।
ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় তিনি ব্যাট করেছেন ৫ নম্বর পজিশনে। বলাবাহুল্য, সেযুগের উইকেটকিপারদের মধ্যে ওয়ালকটই সবচেয়ে ওপরের দিকে ব্যাট করতেন। অনেকের মতে, ক্রিকেটে কিপার-ব্যাটসম্যানের ধারণাটা সর্বপ্রথম উনিই প্রতিষ্ঠিত করেন।
ক্যারিয়ারের শুরুতে কিপার-ব্যাটসম্যান হিসাবে নিয়মিত দলে থাকলেও পরে পিঠের ব্যথার জন্য গ্লাভসজোড়া তুলে রেখে মনোনিবেশ করেন ব্যাটিংয়ে। ব্যাটিং অর্ডারে ৫ নম্বর জায়গা ছেড়ে উঠে আসেন ৩ নম্বরে। কিপিং ছাড়লেও তিনি ফিল্ডিং করতেন স্লিপে। যথারীতি স্লিপ ফিল্ডার হিসেবেও দিয়েছেন বিশ্বস্ততার পরিচয়।
স্যার ক্লাইড ওয়ালকটের আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক। ৪৪ টেস্টের ৭৪ ইনিংসে ৫৬.৬৮ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ৩৭৯৮ রান। ক্যারিয়ার সেরা ২২০। এছাড়া বল হাতে নিয়েছেন ১১টি উইকেট আর উইকেটকিপার হিসেবে ১৫ টেস্টে তাঁর রয়েছে ৩৮টি ডিসমিসাল। স্লিপ ফিল্ডার হিসেবে ক্যাচের সংখ্যা ২৬টি।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১৪৬ ম্যাচের ২৩৮ ইনিংসে ৫৬.৫৫ গড়ে ওয়ালকটের সংগ্রহ ১১,৮২০ রান। ৪০টি শতকের পাশাপাশি হাঁকিয়েছেন ৫৪টি অর্ধশতক। ক্যারিয়ার সেরা ৩১৪*। পূর্ণাঙ্গ টেস্ট ক্যারিয়ার শেষে সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড়ের অধিকারী ব্যাটসম্যানদের তালিকায় ৫৬.৬৮ গড় নিয়ে ক্লাইড ওয়ালকটের অবস্থান ১১তম।
খেলা ছাড়ার পরেও সারাটা জীবন ক্রিকেটের সাথেই সম্পৃক্ত থেকেছেন সাবেক এই গ্রেট। বারবাডোজ, গায়ানা এবং ত্রিনিদাদের আঞ্চলিক ক্রিকেটের উন্নয়নের পেছনে নিরলস ও নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন আজীবন। খেলোয়াড়ি জীবনে তিনি যেমন সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান করেছেন, ক্রিকেট প্রশাসকের ভূমিকাতেও তাঁর ক্যারিয়ার ছিল ততটাই উজ্জ্বল।
‘৭৫ ও ‘৭৯ বিশ্বকাপজয়ী (এবং ‘৮৭) ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের টিম ম্যানেজার হিসেবেও দিয়েছেন দক্ষতার পরিচয়। প্রধান নির্বাচক ও বোর্ড প্রেসিডেন্টের ভূমিকায়ও তাঁকে দেখা গেছে বেশ কিছুদিন।
১৯৯২ সালে তিনটি ম্যাচে তিনি আন্তর্জাতিক ম্যাচ রেফারির দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৯৩ সালে আইসিসির চেয়ারম্যান হিসেবে কলিন কাউড্রের স্থলাভিষিক্ত হন তিনি। স্যার ক্লাইড ওয়ালকট ছিলেন প্রথম ‘অশ্বেতাঙ্গ’ এবং ‘নন-ইংলিশ’ আইসিসি চেয়ারম্যান। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত কৃতিত্বের সাথে এ দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
১৯৫৮ সালে উইজডেন মনোনীত ‘ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার’ খেতাবে ভূষিত হন। ১৯৯১ সালে বারবাডোজ সরকার কর্তৃক ‘গোল্ড ক্রাউন অব মেরিট’ উপাধিতে সম্মানপ্রাপ্ত হন। ১৯৯৩ সালে বারবাডোজের সর্বোচ্চ সম্মান ‘নাইট অব সেন্ট অ্যান্ড্রু’ পুরস্কার লাভ করেন। ‘ওরেল-ওয়ালকট-উইকস’ ত্রয়ীর সম্মানার্থে ২০০৭ সালে বার্বাডোজ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে কেনসিংটন ওভালের একটি স্ট্যান্ডের নামকরণ করা হয় ‘থ্রি ডব্লিউজ’ স্ট্যান্ড।
স্যার ক্লাইড ওয়ালকট তাঁর জীবদ্দশায় দু’টি আত্মজীবনী গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৯৫৮ সালে ‘আইল্যান্ড ক্রিকেটার্স’ এবং ১৯৯৯ সালে ‘সিক্সটি ইয়ার্স অন দ্য ব্যাকফুট’। ২০০৬ সালে ২৬ আগস্ট, বারবাডোজের স্থানীয় একটি হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর কিংবদন্তি ফাস্ট বোলার ও ধারাভাষ্যকার মাইকেল হোল্ডিং বলেছিলেন, ‘আরেকজন ভাল মানুষ চলে গেলেন, তিনি শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজেই নয়, গোটা বিশ্বের কাছেই ছিলেন কিংবদন্তি।’