একজন ক্রিকেটার ক্রিকেট খেলেন একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্তই। তাই অবসর নেয়ার পর জীবনের অনেকটা সময়ই পড়ে থাকে। এত লম্বা একটি সময় একজন ক্রিকেটার কী করবেন? একজন ক্রীড়াবিদের পক্ষে নিশ্চয়ই বাকি জীবনটা ঘরে বসে কাঁটিয়ে দেয়া সম্ভব না। তাই অনেকেই বেঁছে নেন তাঁদের পছন্দের পেশা। তবে ক্রিকেটারদের সাধারণত অবসরের পর টিম ম্যানেজমেন্ট, ধারাভাষ্য – ইত্যাদি পেশায়ই বেশি দেখা যায়।
কিছু ক্রিকেটার আছেন যারা তাঁদের লম্বা সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগাতে চান। তাঁদের ক্রিকেটীয় জ্ঞান,দক্ষতাকে কাজে লাগাতে চান। সেগুলো ছড়িয়ে দিতে চান পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। তাঁরা তাই বেঁছে নেন কোচিং পেশাকে। সেই ক্রিকেটাররা নিজেরাই হয়ে ওঠেন ক্রিকেটার তৈরির কারখানা। সেই ক্রিকেটার এবং পরবর্তীকালের কোচদের নিয়ে খেলা ৭১ তৈরি করেছে একটি একাদশ।
- গ্যারি কার্স্টেন (দক্ষিণ আফ্রিকা)
দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক এই বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন ১৯৯৩ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত। এই সময়ে তিনি ১০১ টি টেস্ট ও ১৮৫ টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। ওয়ানডেতে তাঁর ১৮৮ রানের ইনিংসটি দক্ষিণ আফ্রিকার যে কোনো ব্যাটসম্যানের জন্য সর্বোচ্চ। গ্যারি কার্স্টেনকে এখনো ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান ভাবা হয়।
কোচিং পেশায়ও তিনি সেরাদের একজন। ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি ভারত জাতীয় দলের কোচ ছিলেন।সেই সময়েই তার কোচিং এ ভারত ২০১১ বিশ্বকাপ জেতে। পরবর্তীতে কার্স্টেন দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলেরও হেড কোচের দায়িত্ব পালন করেন।
- জাস্টিন ল্যাঙ্গার (অস্ট্রেলিয়া)
আমাদের একাদশের দ্বিতীয় ওপেনার জাস্টিন ল্যাঙ্গার। অস্ট্রেলিয়ান এই ওপেনারের টেস্ট অভিষেক হয় ১৯৯৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ২০০৭ সালে অবসরে যাওয়ার আগে ১০৫ টেস্টে তার সংগ্রহ ৭৬৯৬ রান। টেস্টে তাঁর ব্যাটিং গড় ৪৫.২৭,যা আজকের দিনে এসেও বেশ ঈর্ষা জাগানীয়া। টেস্টে তাঁর ঝুলিতে আছে ২৩ টি সেঞ্চুরি এবং ৩০ টি হাফ সেঞ্চুরি।
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ) ২০০৯ সালে তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার সহকারী কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়। তখন তিনি মূলত টেস্ট দলের ব্যাটিং কোচ ও মেন্টর হিসেবে কাজ করেন। তবে ২০১৮ সালে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তাঁকে হেডকোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়।
- অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার (জিম্বাবুয়ে) – উইকেটরক্ষক
জিম্বাবুয়ান এই বাঁ-হাতি উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান খেলেছেন ৬৩ টি টেস্ট ম্যাচ এবং ২১৩ টি ওয়ানডে ম্যাচ। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার কে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে ধরা হয়। তাঁর ঝুলিতে আছে ৫২ গড়ে ৪৭৯৪ টেস্ট রান এবং ৩৫ গড়ে ৬৭৮৬ ওয়ানযে রান। আইসিসির সর্বকালের সেরা ১০০ টেস্ট ব্যাটসম্যানের তালিকায় তিনি আছেন ৩১তম অবস্থানে।
২০০৯ সালে তিনি ইংল্যান্ডের হেড কোচের দায়িত্ব নেন। তাঁর কোচিংয়ে ইংল্যান্ড ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয় করে। এছাড়াও ফ্লাওয়ারের অধীনে ইংল্যান্ড ২০০৯, ২০১১ ও ২০১৩ সালে তিনটি অ্যাশেজ সিরিজ জয় করে।
- জাভেদ মিয়াঁদাদ (পাকিস্তান)
জাভেদ মিয়াদাদ টেস্ট ক্রিকেটে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের একজন। পাকিস্তানের হয়ে তিনি ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ক্রিকেট খেলেন। তিনি ১২৪ টেস্ট ২৩৩ ওয়ানডেতে যথাক্রমে ৮৮৩২ ও ৭৩৮১ রান করেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর ৩১ টি সেঞ্চুরি এবং ৯৩ টি হাফ সেঞ্চুরি আছে।
১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে তিনি তিন দফায় পাকিস্তানের কোচের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর কোচিংয়ে পাকিস্তান এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করে।
- টম মুডি (অস্ট্রেলিয়া)
অস্ট্রেলিয়ান ডান হাতি এই অলরাউন্ডার ৮ টি টেস্ট এবং ৭৬ টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন। এরমধ্যে তিনি ১৯৮৭ এবং ১৯৯৯ সালে দুটি বিশ্বকাপ ফাইনাল ও খেলেন।
কোচ হিসেবে টম মুডির ছাড়িয়ে গিয়েছেন নিজের ক্রিকেটার স্বত্বাকে।২০০৫ সালে তিনি শ্রীলংকার হেড কোচ কোচ পদে নিয়োগ পান। তাঁর ২ বছর পর ২০০৭ বিশ্বকাপে মুডির অধীনে ফাইনাল খেলে শ্রীলংকা দল।তবে পরবর্তীতে তিনি আর কোনো জাতীয় দলের কোচ হিসেবে কাজ করেননি।তিনি বিগ ব্যাশ ,আইপিএল এর মত ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে কোচিং করিয়েছেন নিয়মিত।
- ড্যারেন লেহম্যান (অস্ট্রেলিয়া)
অস্ট্রেলিয়ান এই ব্যাটসম্যান খেলেছেন ২৭ টি টেস্ট ম্যাচ এবং ১১৭ টি ওয়ানডে ম্যাচ। প্রায় ৪৫ গড়ে তাঁর ঝুলিতে আছে ১৭৯৮ টেস্ট রান এবং ৩৮ গড়ে ৩০৭৮ ওয়ানডে রান।
২০১৩ সালে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের কোচ হওয়ার মাধ্যমে তাঁর কোচিং যাত্রা শুরু হয়। তবে, স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারির পর তিনি বিদায় বলে দেন। এছাড়াও তিনি আইপিএল এর বিভিন্ন দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিগব্যাশের দল কুইন্সল্যান্ড ক্রিকেটেরও কোচিং এর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
- ড্যানিয়েল ভেট্টোরি (নিউজিল্যান্ড) – অধিনায়ক
নিউজিল্যান্ডের এই অলরাউন্ডার ১৯৯৭ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেন। তিনি নিউজিল্যান্ডের হয়ে ১১৩ টি টেস্ট ও ২৯৫ টি ওয়ানডে খেলেন। তাঁর ঝুলিতে আছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার আন্তর্জাতিক রান এবং ৬৬৭ টি উইকেট।ভিট্টোরিই প্রথম বাঁ-হাতি স্পিনার যিনি টেস্ট ও ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই ৩০০ এর অধিক উইকেট রয়েছে। নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসেরও সেরা অধিনায়কদের একজন তিনি।
কোচ হিসেবেও ভিট্টোরি সমানভাবে সফল। তিনি ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আইপিএলের দল রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গয়ালোর এর হেড কোচের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) তাঁকে বাংলাদেশ দলের স্পিন কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়।
- অনিল কুম্বলে (ভারত)
১৮ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে অনিল কুম্বলে ভারতের হয়ে ১৩২ টি টেস্ট ও ২৭১ টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন। তিনি বিশ্বের তৃতীয় বোলার যার টেস্ট ক্রিকেটে ৬০০ এর অধিক আন্তর্জাতিক উইকেট রয়েছে। ওয়ানডে ক্রিকেটেও তাঁর ৩৩৭ টি উইকেট রয়েছে।
বিসিসিআই ২০১৬ সালে অনিল কুম্বলেকে ভারতের কোচ হিসেবে ঘোষণা করে। তবে পরের বছর আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে ভারত হারার পর তিনি পদত্যাগ করেন। যদিও তিনি কোচ থাকাকালীন সময়ে ভারত পরপর তিনটি টেস্ট সিরিজ জয় করে। এছাড়াও তিনি আইপিএলের দল পাঞ্জাবের কোচের দায়িত্ব পালন করেন।
- ওটিস গিবসন (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)
ওটিস গিবসন তাঁর চার বছরের সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ারে মাত্র ২ টি টেস্ট ও ১৫ টি ওয়ানডে খেলেছেন। তবে এর মধ্যেও তাঁর ঝুলিতে ৩৭ টি আন্তর্জাতিক উইকেট। বোঝাই যাচ্ছে এই পেসার তাঁর খেলোয়াড়ী জীবনে খুব সফল ছিলেন না।
তবে কোচ হিসেবে তাঁর ক্যারিয়ার মোটেও সংক্ষিপ্ত নয়। ২০০৭ সালে ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) তাকে ইংল্যান্ড দলের বোলিং কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়। তাঁর কোচিংয়ে ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল খেলে।মাঝে তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও পরে আবার ইংল্যান্ডের বোলিং কোচ হয়ে ফিরে আসেন। ২০১৯ বিশ্বকাপ যান দক্ষিণ আফ্রিকা দলের প্রধান কোচ হয়ে। ২০২০ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড তাকে বাংলাদেশের বোলিং কোচ হিসেবে ঘোষণা করে।
- জেসন গিলেস্পি (অস্ট্রেলিয়া)
অস্ট্রেলিয়ান ডান হাতি এই পেসার ৭১ টি টেস্ট ও ৯৭ টি ওয়ানডে ম্যাচ। তাঁর ঝুলিতে আছে ২৫৯ টি টেস্ট উইকেট এবং ১৪২ টি ওয়ানডে উইকেট। টেস্টে এক ইনিংসে আট বার পাঁচ উইকেট নেয়ার কৃতিত্বও আছে তাঁর। মজার ব্যাপার হলো পুরোদস্তুর এই বোলারের টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরিও রয়েছে একটি।
জিম্বাবুয়ের তরুণ ক্রিকেটারদের নিয়ে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি আইপিএলয়ে কোচিং করানো শুরু করেন।২০১১ সালে তিনি কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের কোচ হিসেবে কাজ করেন। এর বাদে নিয়মিত তিনি কাজ করেন বিগ ব্যাশ ও অস্ট্রেলিয়ার শেফিল্ড শিল্পে।
- ওয়াকার ইউনুস (পাকিস্তান)
পাকিস্তানের সাবেক এই অধিনায়ক ১৯৮৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন। তিনি মোট ৮৭ টেস্ট ও ২৬২ টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন। দ্রুত গতির এই পেসার প্রথম বোলার হিসেবে ওয়ানডে ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন। টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে তাঁর ঝুরিতে আছে ৭৮৯ টি আন্তর্জাতিক উইকেট।
কোচ হিসেবেও ইউনুস সমান ভাবে উজ্জল। ২০০৬ সালে তাঁকে পাকিস্তানের বোলিং কোচ নিয়োগ দেয়া হয়।পরবর্তীতে ২০১০ সালে তিনি পাকিস্তানের হেড কোচের দায়িত্ব নেন। এছাড়াও তিনি আইপিএল ও বিপিএলেও কোচের দায়িত্ব পালন করেন। এখন তিনি পাকিস্তানের বোলিং কোচ।
- চান্দিকা হাতুরুসিংহে (শ্রীলঙ্কা) – দ্বাদশ ব্যক্তি
খেলোয়াড়ী জীবনটা তাঁর খুব বড় নয়। নব্বইয়ের দশকে টপ অর্ডারের এই ব্যাটসম্যান খেলেছেন ২৬ টি টেস্ট ও ৩৫ ওয়ানডে। সব মিলিয়ে হাজার দুয়েকের মত রান করেছেন।
তবে, কোচ হিসেবে একালে তাঁর বেশ নাম ডাক। শ্রীলঙ্কা দলে টম মুডির সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন একটা সময়। এরপর বোর্ডের সাথে ঝামেলায় গিয়ে পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে বিগ ব্যাশ ও শেফিল্ড শিল্ডে কোচিং করান। এরপর তাঁকে প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। তাঁর অধীনে বাংলাদেশ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলে। এরপর তিনি ফিরেন শ্রীলঙ্কায়। যদিও, তাঁর হাত ধরে সুদিনে ফিরতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। আর শ্রীলঙ্কায় শেষটা ভালও হয়নি হাতুরুর। রীতিমত মামলা পর্যন্ত গড়ায় দু’পক্ষের সম্পর্ক।
- কোচ: গর্ডন গ্রিনিজ
এই দলের কোচ হিসেবে আমরা বেছে নিয়েছি গর্ডন গ্রিনিজকে।ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই ব্যাটসম্যান তাঁর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার শেষে আসেন কোচিং পেশায়। ১৯৯৬ সালে তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোচ হিসেবে নিযুক্ত হন।তাঁর কোচিং এ বাংলাদেশ ১৯৯৭ সালে ২২ দলকে হারিয়ে আইসিসি ট্রফি জয় করে। সেই সাথে বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালে তাঁদের প্রথম বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। তাঁর সময়েই ২০০০ সালে বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পায়।এর ফলে তাঁকে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্বও দেয়া হয়।
গর্ডন গ্রিনিজের খেলোয়াড়ী জীবনটাও বেশ বর্ণাঢ্য। ওয়েস্ট ইন্ডিজের তো বটেই বিশ্বের ইতিহাসেই অন্যতম সেরা ওপেনার হিসেবে পরিচিত ভয়ডরহীন এই ব্যাটসম্যান।