সাকিব আল হাসানকে সেই ছোট্টবেলা থেকে দেখছেন মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। বলা ভালো, তার হাতের তালুতেই বড় হয়ে উঠেছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব। এবার আবার যখন ক্রিকেটে ফেরার প্রস্তুতি শুরু করলেন, তখন সাকিবের পাশে ছিলেন দুই কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম ও এই সালাউদ্দিন।
সাকিবের প্রস্তুতির বিস্তারিত এবং সাকিব কোথায় বাকিদের চেয়ে আলাদা, এ নিয়ে খেলা ৭১-এর সাথে বিস্তারিত কথা বলেছেন সালাউদ্দিন।
সাকিবের ফিটনেস টেস্ট নিয়ে আলাপ শুরু করা যাক। তার ফিটনেস টেস্টে খুব ভালো করা নিয়ে অনেক আলাপ হচ্ছে। অবাক হয়েছেন?
আমি তো অবাক হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। বিপ টেস্টে তো একটা বেসিক ফিটনেস টেস্ট। শুধু সাকিব কেনো, সব ক্রিকেটারকেই এটাতে ভালো করতে হবে। যে কোনো ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে এটুকু প্রত্যাশা করি আমি। সাকিবরা এখন যে লেভেলের খেলোয়াড়, তাতে এক বছর সবকিছুর বাইরে থাকলেও এটুকু করতে পারা উচিত। আমি বরং অবাক হয়েছি যে, এটা নিয়ে এতো আলাপ হচ্ছে। আলাপ হবে তো মাঠের পারফরম্যান্স নিয়ে। ফিটনেস টেস্ট বড় কোনো ব্যাপার না।
সাকিবের বিকেএসপিতে যে ট্রেনিংটা হলো, সেটার শুরুর কথাটা জানতে চাই। বিকেএসপিকে কেনো বেছে নিয়েছিলেন আপনারা?
আমাদের শুরুতে চিন্তাটা ছিলো যে, কখন এবং কোথায় ট্রেনিংটা শুরু করা যায়। একটা সময় মনে হয়েছিলো, দেশের বাইরেও ট্রেনিং করতে হতে পারে। কারণ, করোনা পরিস্থিতি কী হয়, সেটা বোঝা যাচ্ছিলো না। কিন্তু সব জায়গায় সব সুবিধা হচ্ছিলো না। কারণ যেখানেই ট্রেনিং করুক, সেখানে বেশ ক জন কোচ লাগবে, ট্রেনার লাগবে; বড় একটা জায়গা লাগবে। এসব বিবেচনায় আমরা বিকেএসপিকে বেছে নিলাম। ওখান থেকে আমরা যে ভাবে সাপোর্ট পেয়েছি, তা অন্য কোথাও পাওয়া যেতো না। ফলে এটা রাইট ডিসিশন ছিলো।
ট্রেনিংয়ের ব্যাপারে আপনাদের কাছে প্রথম প্রায়োরিটি ছিলো কোনটা?
প্রথম আমরা ফিটনেস নিয়ে ভেবেছি। কারণ, ও তো প্রায় এক বছর কিছু (ট্রেনিং) করেনি। করার উপায়ও ছিলো না। তাকে তো ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। এ ছাড়া বাচ্চা হলো, সে নিয়ে সময় দিতে হয়েছে। ফলে আমাদের লক্ষ্য ছিলো, ওর ফিটনেসটা কতো দ্রুত আমরা আগের জায়গায় নিতে পারি। স্কিল নিয়ে আমরা খুব একটা দুশ্চিন্তা করিনি। এটা আমরা জানতাম যে, স্কিল নিয়ে খুব কষ্ট করতে হবে না। কারণ, মানুষ স্কিল কখনো ভোলে না। ফলে ফিটনেস নিয়েই জোর দেওয়ার পরিকল্পনা ছিলো।
আপনারা বেশ বড় একটা বহর ছিলেন ওর পাশে। দু জন বিশেষজ্ঞ কোচ, একজন অ্যাথলেটিক্স কোচ, একজন বক্সিং কোচ, ফিজিও; আরও অনেকে। স্পেশালি যদি বক্সিং কোচের কথা জিজ্ঞেস করি, তাঁকে কেনো আনা হয়েছিলো?
শুরুতে তো ফিটনেস ভালো করার জন্য বেশি কাজ করা হয়েছে। এরপর আমরা মনে করলাম, ক্রিকেট ডেভেলপমেন্টের জন্য বক্সিংটা একটা ভালো ব্যাপার হতে পারে। কয়েকটা সপ্তাহ পর ও তাই বক্সিং কোচের সাথে কাজ শুরু করে। আসলে বক্সিং এমন একটা খেলা, এটা থেকে আপনি ক্রিকেটেও উপকার পেতে পারেন। এতে ভালো পজিশন নিতে পারেন আপনি, বক্সিং অনুশীলন আপনাকে আরও ফাস্ট করবে এবং হ্যান্ড আই কম্বিনেশন আরও ভালো করবে।
কোথায় যেনো বলেছেন, ব্যাটিংয়ের সময়ের পায়ের পজিশনকে বক্সিং প্র্যাকটিস হেল্প করতে পারে…
শুধু ব্যাটিংয়ের নয়, বোলিংয়েরও। পজিশনিং সেন্স অনেক বাড়ে এতে। পাওয়ারফুল একটা পজিশন নিতে পারবেন আপনি। পাওয়ারটা ব্যাটিং বা বোলিংয়ের সময় কোথা থেকে জেনারেট করবেন এবং সেটা সবচেয়ে বেশি কিভাবে করতে পারবেন, তার একটা ভালো অনুশীলন বক্সিং।
এটা কি আপনারাই আবিষ্কার করলেন? নাকি ক্রিকেটে অলরেডি এটা ব্যবহার হচ্ছে?
না, আমরা আবিষ্কার করিনি। আমরা এটা নিয়ে ভেবেছি। কিন্তু আজকাল তো সব জায়গাতে দেখা হচ্ছে, একটা খেলায় কিভাবে আরেকটা খেলার হেল্প নিয়ে আরও উন্নতি করা যায়। অনেকেই তাই এই বক্সিংয়ের হেল্প নিচ্ছে।
দৌড়বিদ নিলেন কেনো ট্রেনিং দলে?
সে তো আসলে অ্যাথলেটিক্স কোচ। আমাদের ফিটনেস নিয়ে নিবিঢ় কাজ করার দরকার ছিলো। এটা অ্যাথলেটিক্সের ওরা সবচেয়ে ভালো জানে। ওরা তো অ্যাথলেটদের সর্বোচ্চ ফিটনেস নিয়ে কাজ করে। ফলে ওরাই ভালো বলতে পারতো যে সাকিবের ফিটনেস ডেভেলপমেন্টে কী ধরণের কাজ করতে হবে।
ব্যাটিং-বোলিং তো আপনি আর ফাহিম ভাই (নাজমুল আবেদীন ফাহিম) দেখছিলেন। ব্যাটিং বা বোলিংয়ে কী নতুন কোনো এডজাস্টমেন্ট করা হলো?
না, এই লেভেলে এসে সাকিবের ব্যাটিংয়ে নতুন কিছু যোগ করা বা এডজাস্ট করার মতো অবস্থা নেই। সেটা করা ঠিকও না। আমরা ওর স্বাভাবিক ধরণটা ঠিক রেখেই সেটা নিয়ে কাজ করে গেছি। এখন তো আর নতুন কিছু শিখানোর সময় না। আমরা কাজ করেছি যে, কিভাবে সে তাড়াতাড়ি নিজের ছন্দে চলে আসতে পারে। ম্যাচ ফিটনেস নিয়ে কাজ করেছিলাম। কারণ, তখন আমরা জানতাম, সামনে শ্রীলঙ্কা সিরিজ।
ম্যাচ তো খেলার সুযোগ পায়নি সাকিব। তাহলে ম্যাচ ফিটনেস নিয়ে কাজ করার উপায়টা কী ছিলো?
আমরা সেন্টার উইকেটে ম্যাচ কন্ডিশন কল্পনা করিয়ে নানা ড্রিল করিয়েছি। আমরা যেভাবে ব্যাপারটা করছিলাম, তা ওকে ম্যাচ ফিটনেসের কাছাকাছিই নিয়ে যাওয়ার কথা।
ফাহিম ভাই একটা সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সাকিবের বোলিংয়ে টার্ন আর বাউন্স বাড়বে ফেরার পর। এটা নিয়ে ঠিক কী করলেন?
খুব বেশি কিছু না। সামান্য কাজ। আসলে সাকিবের বোলিং তো একেবারেই গড গিফটেড। আমরা এই বোলিংটা বেটার করার জন্য কিছু করিনি। কারণ, ওর অ্যাকশনে নতুন কিছু অ্যাড করা কঠিন। সাকিবের অ্যাকশন খুব সিম্পল। আর এই সিম্পল অ্যাকশনের কারণেই ও একটা ভালো জায়গায় খুব ভালো বল করে যেতে পারে। এটাই ওর স্ট্রেন্থ। আবার এই সিম্পল অ্যাকশনের সমস্যা হলো, এখানে খুব বেশি ভেরিয়েশন যোগ করার উপায় থাকে না। এই ধরণের বোলাররা কখনোই খুব ভেরিয়েশন আনতে পারে না। তাই আমরা সেটা চেষ্টা করি না।
আপনি একটা কলামে লিখেছেন যে, সাকিব এবার ফিরে আগেও ভালো করবে।
আসলে সাকিবকে সেই ছোটবেলার পর আর কখনো এতো লম্বা সময়ের জন্য পাইনি। এবার পেলাম। আমি দেখলাম, তার আরও ভালো করার চেষ্টাটা আগের চেয়েও বেশী মনে হচ্ছে। আর আমি এই বয়সী যারা আছে, তাদের সবার কাছ থেকে আরও ভালো খেলা আশা করি। সাকিব, তামিম, মুশফিক; সবাইকে আগের চেয়ে ভালো করা উচিত। কারণ, তারা এখন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটটা বুঝে ফেলেছি। ফলে সেই জায়গা থেকেই আমি আশা করি, সাকিব আগের চেয়ে ভালো করবে।
ওভারঅল সাকিবকে এই পুরো ট্রেনিংয়ে কেমন মনে হলো?
সাকিব কঠিন একটা ট্রেনিং করেছে, এটা বলতে পারি। দিনে চারটা সেশন করে ট্রেনিং করেছে। সেই আন্ডার নাইনটিন পার করে আসার পর আর কখনো এই ধরণের ট্রেনিং করেছে বলে মনে হয় না। এই ট্রেনিংটা ক্রিকেটাররা ছোটবেলায় করে। সাকিব সেই বয়সে ফিরে গিয়েছিলো। এটা খুব কঠিন একটা কাজ ছিলো। আমরাও নিশ্চিত ছিলাম না যে, ও এরকম দিনে চার সেশন করে ট্রেনিং নিতে পারবে কি না। ওর পরিশ্রমটা দেখার মতো ছিলো। এই নিজেকে ছোটবেলার পরিশ্রমে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের চেয়ে ওর আগ্রহটাই বেশি ছিলো।
আপনি বলছিলেন যে, যেটা আপনারা ভেবেছেন চার সপ্তাহ লাগবে, সেটা ও এক সপ্তাহে করে ফেলেছে।
হ্যা, বিশেষ করে স্কিলের ব্যাপারে। আমরা হয়তো টার্গেট করেছিলাম যে, এটা তিন সপ্তাহ পর এচিভ করতে পারবো, সেটা সাকিব এক সপ্তাহে এচিভ করে ফেলছিলো। এটা হয়েছে।
সাকিবের এই ছোটবেলায় ফিরে যাওয়া দেখতে দেখতে ছোট বয়সের সাকিবের কথা মনে হচ্ছিলো না? ছোট বেলায় কখনো মনে হয়েছে যে, এই পিচ্চি একদিন বিশ্বসেরা হবে?
সত্যি বলি, এভাবে বিশ্বসেরা হবে কখনো মনে হয়নি। হ্যা, আর দশ জনের চেয়ে একটু আলাদা ছিলো। ট্রেনিংয়ে একটা ব্যাপার কখনো দু বার দেখাতে হতো না। ওর বিশেষত্ব ছিলো, খুব দ্রুত ব্যাপারটা ধরে ফেলতে পারতো। ফলে বাকীদের চেয়ে কোথাও একটু আলাদা তো ছিলোই। কিন্তু বেস্ট হয়ে যাবে, এটা কল্পনা করতে পারিনি।
এটাই কি বাকিদের সাথে সাকিবের পার্থক্য?
না, শুধু এটা না। ইম্প্রুভমেন্টের একটা দারুন চেষ্টা আছে। সেটা শুধু ওর না। আমি তামিম আর মুশফিকের কথাও বলবো। এদের নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা আছে। সেই চেষ্টাটা এরা সবসময় করে। আর এটাই এদেরকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে ফেলে।
এদের পরের প্রজন্মেও অনেককে ট্যালেন্ট মনে করা হয়। কিন্তু তাদের কী এই চেষ্টাটা আছে?
আসলে এটা তো অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। কারও হয়তো চেষ্টা আছে; সঠিক উপায়ে করছে না। আবার কেউ হয়তো সেই সাপোর্ট পাচ্ছে না। একটা খেলোয়াড় কার সাথে মিশছে, পরিবার থেকে কী সাপোর্ট পাচ্ছে, চারপাশে কারা আছে, সামনে কারা আছে; সবকিছু মিলিয়ে এই ব্যাপারগুলো হয়।