ইনিংস ঘোষণার ‘বিপদ’

টেস্ট ক্রিকেট হলো ধৈর্য্যের খেলা। টেস্টে আছে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ। প্রতি মুহূর্তেই দিতে হয় বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ উওরে যাওয়ার পরীক্ষা।

কিন্তু তারপরও কিছু বিষয় নিয়ে হয় বিভিন্ন বিতর্ক। তার মধ্যে একটি হলো ইনিংস ঘোষণা। ইনিংস ঘোষণা দেওয়া হয় তখনই যখন অধিনায়ক মনে করেন বিপক্ষ দলকে চাপে রাখার জন্য পর্যাপ্ত রান হয়েছে। কিন্তু ইনিংস ঘোষণা দেয়ার সময় অধিনায়করা এমন ভাবে সিদ্ধান্ত নেন, যেন কোনো ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি না। তারপরও কিছু অধিনায়কের সিদ্ধান্ত বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।

  •   টিম পেইন: রেকর্ড নয়, জয় আগে (২০১৯)

অ্যাডিলেড ওভালে এটি ছিলো অস্ট্রেলিয়া পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বিতীয় টেস্ট। অ্যাডিলেড ওভালে নিজের হোম কন্ডিশনে নিজেকে রান মেশিন হিসেবে নিজেকে আবারো প্রমাণ করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেনিং ব্যাটসম্যান ডেভিড ওয়ার্নার।

পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের আগে অ্যাশেজের ১০ ইনিংসে মোট ১০০ রানও করতে পারেননি ওয়ার্নার। পাকিস্তানি বোলিংকে পরিণত করেন পাড়ার মামুলি বোলার হিসেবে। ৩৩৫ রানে অপরাজিত থাকা এই ইনিংস খেলার পথে ভাঙ্গেন মার্ক টেইলর,স্যার ডন ব্রাডম্যান, মাইকেল ক্লার্কের রেকর্ড। এই ইনিংসের পর হন অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে টেস্ট ব্যক্তিগত সর্ব্বোচ্চ রানের অধিকারী।

৩৩৫ রানে ব্যাটিং করা অবস্থায় ইনিংস ঘোষণা করেন অধিনায়ক টিম পেইন। তিনি ভেবেছিলেন,ম্যাচ চলাকালীন সময়ে বৃষ্টি  হতে পারে। আর এর ফলে অস্ট্রেলিয়া তার প্রাপ্য জয় থেকে বঞ্চিত হবে। যদি ইনিংস ঘোষণা না করা হত তাহলে ওয়ার্নার যেভাবে ব্যাটিং করছিলেন তাতে ব্রায়ান লারার ৪০০ রানের রেকর্ড হয়তো ভেঙে ফেলতে পারতেন তিনি।

পরে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটিতে হয় লাভ করে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায় সবাই টিম পেইনের সমালোচনা করে।

  • অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের ইনিংস ঘোষণা ও ইংল্যান্ডের পরাজয় (২০০৬)

২০০৬-০৭ মৌসুমের অ্যাশেজের দ্বিতীয় টেস্টের স্কোর কার্ড দেখলে যেকোনো ইংলিশ সমর্থক ভাবতে বাধ্য কিভাবে এই টেস্ট হারলো ইংল্যান্ড। যদিও ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে ৫০০ এর বেশি রান করেছিলো। গ্যাবায় প্রথম টেস্টে বাজে ভাবে হেরে সিরিজ শুরু করেছিলো ইংল্যান্ড।

প্রথম টেস্ট হারার পর অ্যাডিলেড ওভালে দ্বিতীয় টেস্ট জয়ের জন্য ভালোই শুরু করেছিলো। কেভিন পিটারসেনের ১৫৩ রান এবং পল কলিংউডের ক্যারিয়ার সেরা দ্বিশতকে ভালো সংগ্রহ পায় ইংল্যান্ড। ৬ উইকেটে ৫৫১ রান তোলার পর ইংলিশ অধিনায়ক অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ ইনিংস ঘোষণা করে।

পল কলিংউডের সিদ্ধান্ত বেশ ভালোই মনে হচ্ছিল। ৬৫ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে বসে অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু অজি অধিনায়ক রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্ক এবং মাইক হাসির ব্যাটিং ৫১৩ রানের সংগ্রহ পায়। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১২৯ রানে গুটিয়ে যায় ইংল্যান্ড। পরে ম্যাচটি অতিসহজেই জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া।

  • জ্যামাইকার যুদ্ধ (১৯৭৬)

আগের গ্রীস্মে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৫-১ ব্যবধানে সিরিজ হারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওই সিরিজে ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েডের সকল ব্যাটসম্যান অস্ট্রেলিয়ান পেসারদের সামনে আত্মসমর্পণ করে।

জামাইক্যার সাবিনা পার্কে ভারতীয় দলের বিপক্ষে নিজের পেস চতুরতার প্রমাণ দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেন ক্লাইভ লয়েড। ড্যানিয়েল এবং মাইকেল হোল্ডিং দূর্দান্ত বোলিং করছিলেন এই ম্যাচে। তাদের লক্ষ্য ছিলো দূর্দান্ত সব বাউন্সারে ভারতীয় ক্রিকেটারদেরকে আঘাত করা। ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে আংশুমান গায়কড় এবং ব্রিজেশ প্যাটেল সহ বেশিরভাগ ক্রিকেটার চোট পান। এর পরেও প্রথম ইনিংসেও দূর্দান্ত ব্যাটিং করে ভারতীয় দল।

দ্বিতীয় ইনিংসে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়েছিলো। ভারতের প্রায় অর্ধেক ক্রিকেটার হাসপাতালে গিয়েছিলো। তারপরও ভারতীয় দল ১২ রানের লিড পেয়েছিলো। এটি নিয়ে একটি বির্তকের সৃষ্টি হয়,যখন ম্যারে ‘ফায়ার ইন ব্যাবলিন’ ডকুমেন্টারিতে বলেন, ‘ভারতীয় ক্রিকেটাররা ভেবেছিলো আমরা পেস বোলিং নিয়ে বাড়াবাড়ি করছি। বাড়াবাড়ির প্রর্দশনী হিসেবে তারা ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে আত্মসমার্পণ করে।’

পরবর্তীতে বিষান সিং বেদি এই প্রসঙ্গে জানান তিনি ইনিংস ঘোষণা করেননি। ব্যাটসম্যান না থাকায় ইনিংস শেষ হয়েছিলো।

  • হ্যান্সি ক্রনিয়ের ম্যাচ পাতানো এবং একটি লেদার জ্যাকেট

এটি ছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইংল্যান্ডের মধ্যকার শেষ টেস্ট। ইতিমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা আগের ম্যাচগুলো জিতেছিলো। পিচ দেখে মনে হছিলো ম্যাচে পেসাররা গতি তুলবেন। পিচে অনেক বেশি পেস থাকায় সেঞ্চুরিয়নে দক্ষিণ আফ্রিকা ১৫৫ রান তুলতে ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলে।

এইভাবে ম্যাচের সাড়ে তিন সময় চলে যায়। শেষ দিনে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রনিয়ে ইংলিশ অধিনায়ক নাসির হুসেইনকে একটি প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবটি ছিলো, দুই দলই একটি করে ইনিংস শেষ করবে। আর সফরকারীদের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৭৩ ওভারে ২৭০ রান।

ইংল্যান্ডের কাছে প্রস্তাবটি বেশ ভালো ছিলো। কারণ এতে তারা সহজেই ম্যাচ জিততে পেরেছিলো। কারণ দিনের শুরুতে ল্যান্স ক্লুজনার এবং শন পোলক ব্যাটিং করছিলো। তাতে বোঝা গিয়েছিলো এই উইকেটে রান তোলা বেশ সহজ হবে।

শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৫০ রানের। পরে ব্যাটিং করতে নেমে ইংল্যান্ডের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ৭৬ ওভারে ২৪৫ রান। এই লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ৫ বল হাতে রেখেই জয় নিশ্চিত করে ইংল্যান্ড।

হ্যান্সি ক্রনিয়ের এই সিদ্ধান্ত সবাইকে বেশ অবাক করে। মাইকেল আথারটন এই জয়কে দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য সম্ভাব্য সহজ জয় হিসেবে উল্লেখ করেছিলো। ক্রনিয়ের এই সিদ্ধান্তের কারণ চার মাস পর সবার কাছে পরিষ্কার জয়ে যায়। কিং কমিশনের কাছে স্বীকারোক্তিতে জানায় তিনি বুকির কাছে দেড় লাখ ডলার নিয়েছেন। এর বিনিময়ে তিনি ম্যাচের ইনিংস ঘোষণা করেছেন। এটাও জানান ম্যাচ শেষে বুকি তাকে অর্থ দিয়েছিলেন। আর সাথে একটি কালো জ্যাকেট। ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম পাতানো টেস্ট ছিলো এটি।

  • শচীন টেন্ডুলকারের ১৯৪ রানের সময় রাহুল দ্রাবিড়ের ইনিংস ঘোষণা

এই ইনিংস ঘোষণাকে বলা হয় সবচেয়ে বাজে সময়ে ইনিংস ঘোষণা। ২০০৪ সালে ভারতের পাকিস্তান সফরের সময় এই ঘটনাটি ঘটান ভারতীয় অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়। পাকিস্তানের বিপক্ষে এই টেস্টে ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি হাকান বীরেন্দ্র শেবাগ। এছাড়াও পাকিস্তানের বিপক্ষে পাকিস্তানের মাটিতে প্রথম দ্বিশতকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাস্টার ব্লাস্টার শচীন টেন্ডুলকার।

ভারতীয় অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড় ধারণা করেছিলেন ম্যাচ জেতার জন্য পর্যাপ্ত রান হয়েছে। কিন্তু দল ভাবছিলো অন্য কথা। সবাইকে ভাবছিলো শচীনের সেঞ্চুরির পর দ্রাবিড় ইনিংস ঘোষণা করবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে শচীন ১৯৪ রানে থাকা অবস্থায় ইনিংস ঘোষণা করেন দ্রাবিড়।

পরবর্তীতে শচীন তার আত্মজীবনিতে জানান দল চা বিরতির আগে ১৫ ওভার খেলতে চেয়েছিলো। তিনি তার দ্বিশতক করার জন্য  চেষ্টা করেছিলো। তিনি সেটা করতে পারেননি।

শচীন বলেন, ‘এই ঘটনায় রাহুলের সাথে আমার সম্পর্কে কোনো সমস্যা হয়নি। মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে – আমরা আগের মতই আছি।’

 

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link