কোনো একটি ক্রিকেট সিরিজ নিয়ে উৎসাহের মাত্রাটা বোঝা যায় সিরিজ শুরুর আগের বিজ্ঞাপনী কাড়ানাকাড়া থেকে। আবার অনেক সময় একটা সিরিজের উত্তেজনার পারদ কতটা চড়বে সেটা অনেক সময় বিজ্ঞাপনই ঠিক করে দেয়। প্রথম ক্ষেত্রে এমনিই দর্শক উন্মাদনা তুঙ্গে থাকে। বিজ্ঞাপনের কাজ হয় সেই আগুনেই ঘৃতাহুতি দেয়া।
উদাহরণ হিসেবে বিশ্বকাপ জাতীয় আইসিসি ইভেন্ট বা ভারত-পাকিস্তান সিরিজের কথা বলা যায়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে উন্মাদনার আগুন জ্বালানোর জন্যে কাঠের যোগান বিজ্ঞাপন দেয়। উদাহরণ হিসাবে কোনো বড়ো টেস্ট বা ওয়ানডে সিরিজের নাম বলা যায়।
যবে থেকে ক্রিকেট দেখছি, বেশ কিছু মনোমুগ্ধকর বিজ্ঞাপন দেখেছি। আজ সেগুলোরই কয়েকটার কথা বলতে এলাম। তবে একটা কথা এখানে আগেভাগে বলে রাখি, ক্রিকেটের বিজ্ঞাপন বলতে কিন্তু ক্রিকেটেরই বিজ্ঞাপনকে বোঝাতে চাইছি। ক্রিকেটারদের করা বিজ্ঞাপন না।
প্রথমেই বলি আইপিএলের বিজ্ঞাপনের কথা। সোনি টিভির হাতে যতদিন অব্দি সম্প্রচার সত্ব ছিল, ততদিন তারা আই.পি.এল কে প্রাইম টাইম বিনোদন হিসাবেই প্রচার করতো। একদম প্রথম মৌসুমের আগেই তারা একটা বিজ্ঞাপন করেছিল-মনো-রঞ্জন কা বাপ। বেশ মজাদার বিজ্ঞাপন ছিল সেবার।
তাঁদের সম্প্রচারও বেশ লঘু ছিল। স্টুডিওতে ব্যান্ড, সিধুর শায়ারি, এবং গৌরব কাপুর ও সমীর খোচারের সঞ্চালনা। সাথে শিবানী দান্ডেকার, অর্চনা বিজয়রা তো ছিলেনই। আই.পি.এল যে নিছকই দিন পঞ্চাশেক ধরে চলা প্রাইম টাইম ধারাবাহিক যার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ওই স্লটের মেগা ধারাবাহিক সমূহ, এটা বোঝাতে সনির সম্প্রচার বাকি রাখেনি।
এরপর স্টার যখন এর সত্ব পেলো, তখন তারা আইপিএল কে সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে প্রচার করতে লাগলো। অনামী, অখ্যাত খেলোয়াড়দের আত্মপ্রকাশের মঞ্চ হিসাবে আইপিএলকে প্রচার করলো স্টার। এবং আইপিএল যে সিরিয়াস ক্রিকেট, সেটা তাদের বিজ্ঞাপনের ছত্রে ছত্রে বুঝিয়ে দিলো। ‘ইয়ে দেশ হায় বীর জাওয়ানও কা’ নয়া দৌড়ের সেই বিখ্যাত গানের প্যারোডি বানালো একটা।
অনুকূল রায় সেবার অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপের তারকা ছিলেন। তাঁকে কেন্দ্র করেই অনামী খেলোয়াড়দের ব্যাপারটা দেখালো ষ্টার। বিজ্ঞাপনটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল। এছাড়াও তারা সিলেক্ট চ্যানেলে টি-২০ খেলার পরিসংখ্যান ও স্ট্রাটেজি নিয়ে রীতিমতো দারুণ আলোচনা সভা বসিয়েছিলো। ডিন জোন্স সেটায় ধারাভাষ্য দিয়ে বেশ প্রশংসা পান। এই বদল অবশ্য এসেছিলো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বিবর্তনের হাত ধরেই।
সনি যেসময় আইপিএল দেখাতো সে সময় টি-টোয়েন্টি নিছক বিনোদন ছিল। আস্তে আস্তে তা পরিণত হয় আজকের চরম স্ট্রাটেজিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে। অবশ্য এটাও মানতে হবে, সোনির সে সময় কোনো নিবেদিতপ্রাণ খেলার চ্যানেল ছিল না। স্টার আবার সম্পূর্ণ খেলারই চ্যানেল। কাজেই এই জায়গায় হয়তো সম্প্রচার ও বিজ্ঞাপনে ফারাক টা বোঝা যায়।
২০০৩ বা ২০০৭ বিশ্বকাপের কোনো থিম সং ছিল কি না মনে নেই।যদি থেকেও থাকে ক্রিকেট বিশ্বকাপের সেরা বিজ্ঞাপনী থিম সং হিসাবে ‘দে ঘুমাকে’ এক নম্বরেই থাকবে। ২০১৫ বিশ্বকাপের আগে, ‘গ্রেটনেস ইস কন্টাজিয়াস’ নিছক বিজ্ঞাপন হিসাবে দারুণ ছিল।
পিছনে ছোট্ট ভয়েসওভার, এবং জনসন ও ম্যাকালামের সাজঘরে তৈরি হয়ে মাঠের দিকে বেরোনোর দৃশ্য এবং ইন্টারকাটে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ক্রিকেট খেলার দৃশ্য। সব মিলিয়ে একটা দারুণ চিত্রপট তৈরি করে। ২০১৯ বিশ্বকাপের থিম সং ও বিজ্ঞাপন অবশ্য অত্যন্ত বিরক্তিকর লেগেছিলো।
লেখা শেষ করি কিছু টেস্ট সিরিজের বিজ্ঞাপন নিয়ে কথা বলে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ দেশের মাটিতে বেশ লম্বা মৌসুম খেলতো। টেস্ট-ওয়ানডে মিলিয়ে। টেন স্পোর্টসে সেটার একটা দারুন বিজ্ঞাপন দেখাতো। ‘সান ইস শাইনিং’ বলে বব মার্লের একটা গান দিয়ে শুরু হতো।
বিজ্ঞাপনের মাঝে মাঝে আসতো সোবার্স, ওরেল, মার্শালদের স্ট্যাচু এবং শেষ দৃশ্যে একজন সমুদ্র সৈকতে একটা ছোট ঘরে বসে বিয়ার সহযোগে টিভিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট খেলা দেখছে। গরমের ছুটিতে আমরাও ওয়েস্ট ইন্ডিজের খাও-পিও-খেলো ক্রিকেট মৌসুম চুটিয়ে উপভোগ করতাম।
সেই বিজ্ঞাপনের অংশবিশেষ দিলাম এই লেখার সাথে। এছাড়াও স্টার যখন প্রথম ভারতের ঘরের মাঠে হওয়া সিরিজের সম্প্রচার সত্ত্ব পেলো, তখন ২০১২ সালে ইংল্যান্ডের সাথে হারার পর অস্ট্রেলিয়া সিরিজ শুরুর আগে কপিল দেবের করা একটা বিজ্ঞাপন বেশ লেগেছিলো – ‘বাচ্চে বাচ্চে জানতে হে, আসলি টেস্ট আভি বাকি হ্যায়’।
এছাড়াও ২০১১ সালে ৮-০’র প্রথম ভাগ অর্থাৎ ইংল্যান্ড সফর শুরুর আগে একটা দারুণ বিজ্ঞাপন করেছিল। এক সাহেব, বিশ্বজয়ী ভারতের এক সমর্থককে একটি শপিং মলে বলছেন, হতে পারো তোমরা চ্যাম্পিয়ন, কিন্তু বিশ্বকাপেও, ‘ইউ কুডন্ট বিট আস।’
তবে ক্রিকেট সিরিজের বিজ্ঞাপন বা প্রোমো হিসাবে আমার প্রিয় হলো ২০১৫ অ্যাশেজের আগে, স্কাই টিভির করা বিলি জোয়েলের বিখ্যাত গান, ‘উই ডিডন্ট স্টার্ট দ্য ফায়ার’ এর প্যারোডি। সেটাও এখানে দিলাম লেখার সঙ্গে। বর্তমানে ক্রিকেট বিজ্ঞাপন আদতেই ম্যাদামারা হয়ে গেছে। না থিম সং না হিউমার, কিছুই নেই। এবং এটা হয়েছে মাত্র গত বছর দুয়েকে। তাই, আমাকে অতীতজীবী বলে গালি দেবেন না প্লিজ।