ক্রিকেট ও বাংলাদেশের রাজনীতি, দ্য টু ওয়ে ট্রাফিক

‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ – তর্জমা করলে দাঁড়ায় স্বার্থের দ্বন্দ্ব। আরেকটু ভেঙে বললে দু’টো ভিন্ন বিষয় কিংবা পছন্দের মধ্যে চলমান টানাপোড়েন। বাংলাদেশ ক্রিকেট এই বিষয়টার বলি হয়েছে বারবার। সেই ধারাবাহিকতায়, নতুন করে সামনে এসেছে সাকিব আল হাসান ইস্যু।

গেল নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে সাকিব যুক্ত হয়েছিলেন রাজনীতির সাথে। এরপর তিনি জনগণের প্রতিনিধিও বনে গেছেন। কিন্তু পালা-বদলে সাকিব এখন জনরোষের শিকার হচ্ছেন। সেটা হচ্ছেন মূলত তাঁর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার জন্যই।

কিন্তু এই পরিস্থিতি কেননই বা সৃষ্টি হবে? সে প্রশ্ন অনেকেই করছে না বা করতে চাইছেন না। একজন খেলোয়াড় দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সময় তাকে রাজনীতির সাথে যুক্ত হতে হবে কেন? এখানেই তো কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের সূত্রপাত ঘটে। আর এর ফলে বড় পরিসরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন। বিশেষ করে ক্রিকেট।

উদাহরণ হিসেবে সাকিব আল হাসান সবচেয়ে নিকটতম। ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ঠিক আগ মুহূর্তে নির্বাচন নিয়ে বেজায় ব্যস্ত ছিলেন সাকিব। অথচ বিশ্বকাপের বছরে তার পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার কথা বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে। কিন্তু তার মনোযোগ বিভক্ত হয়ে যায়। আর তার ফলে যা হওয়ার হয়েছেও তাই।

তাছাড়া ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের পরপরই নির্বাচন আয়োজিত হয়েছে। যেহেতু সাকিব নির্বাচনে অংশ নেবেন, সেহেতু তার মাথায় নির্বাচন কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনাও জায়গা পেয়েছিল। সেবারেও সাকিবের পারফরমেন্সের বেহাল দশা নিয়ে নতুন করে বলবার কিছু নেই।

একই ঘটনা ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে ঘটিয়েছিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। বাংলাদেশ ক্রিকেট তখন ওয়ানডে ক্রিকেট সকলের সমীহ আদায় করছে। মাশরাফি দিচ্ছিলেন নেতৃত্ব। অথচ বিশ্বকাপের ঠিক আগ মুহূর্তে তিনি ছিলেন তুমুল ব্যস্ত। সেবারও নির্বাচনকে ঘিরেই ছিল মাশরাফির নানা ব্যস্ততা।

তিনি বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবারও সুযোগ পাননি। অথচ সেই সময় তিনি ছিলেন অধিনায়ক। সেই বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ প্রত্যাশার ধারেকাছেও যেতে পারেনি। একই সাথে অন্তত দুই ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব করা যায় না, সে প্রমাণ সাকিব-মাশরাফিরা দেখিয়েছেন।

খেলোয়াড়রা তাই এদফা এমন ঘটনার বিরোধিতা করছেন। একজন খেলোয়াড়ের মূল দায়িত্ব মাঠে পারফর্ম করা। তার ধ্যানজ্ঞান জুড়েই থাকবে শুধু ক্রিকেট। তাইতো সংস্কারের হাওয়ায় ক্রিকেট বোর্ডেও সংস্কার দাবি করেছেন অনেকে। শুধু ক্রিকেট বোর্ডের আচরণবিধি-তে যুক্ত করতে হবে নতুন ধারা- খেলোয়াড়ী জীবন চলমান থাকলে, প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়া যাবে না।

তবে প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু বলেছেন রাজনৈতিক দলগুলোরও দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে লিপু নিজের আর্জি রেখে বলেন, ‘সংস্কার দুই জায়গায়ই হতে হবে। একজন খেলোয়াড়ের যেমন- তিনি যোগদান করতে পারবেন কি পারবেন না রাজনৈতিক দলে জাতীয় দলে সার্ভ করার সময়। তার পাশাপাশি কোন রাজনৈতিক দলের কি উচিত কোন খেলোয়াড়কে টেনে নেওয়া রাজনীতির জন্য?’

এছাড়াও লিপু স্রেফ খেলোয়াড়দেরকে দোষারোপের পক্ষে নন। তিনি বলেন, ‘এটা ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক না। আপনি শুধু খেলোয়াড়কে দোষারোপ করতে পারেন না। আপনার উচিত রাজনৈতিক দলগুলোকেও দোষারোপ করা।’ রাজনৈতিক দলগুলো মূলত চায়, জনগণের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এমন সব চরিত্রকে নিজেদের দলে ভেড়াতে।

সে ধারা থেকেই সাকিব, মাশরাফিরা নির্বাচনের ময়দানে নেমেছেন। কিন্তু ক্যারিয়ারের সমাপ্তির রেখা টেনে দিয়েও তারা অংশ নিতে পারতেন রাজনীতিতে। তাতে করে এমন দ্বিধাগ্রস্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হত না। প্রশ্ন উঠত না। তিরস্কারের শিকারও হতে হত না মাশরাফি-সাকিবদের।

হয়ত এবারের পরিস্থিতি গোটা ক্রীড়াঙ্গণের জন্য হয়ে রইলো এক উদাহরণ। খেলোয়াড়রা হয়ত আর দুই নৌকায় পা দিতে চাইবেন না। বরং নিজেদের পেশাদারিত্বকে সর্বোচ্চ সম্মান করে খেলার মাঠে মনোযোগী হবেন। ক্যারিয়ার শেষে তিনি চাইলে যেকোন দিকেই পা বাড়াতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link