ধারাভাষ্যকারদের বিশ্ব একাদশ

ক্রিকেট খেলা বহুগুন বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে ধারাভাষ্যের গুনে। টেস্ট ক্রিকেটে বিশেষ করে ধারাভাষ্যকার বা কমেন্টেটর সমূহ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মাঝে মাঝে নিষ্প্রাণ টেস্ট ম্যাচের সময় খেলায় দর্শক ধরে রাখার জন্যে মজাদার গল্পের ঝুলি খুলে বসা, বা অত্যন্ত রোমাঞ্চকর মুহূর্তগুলোকে আরো বর্ণময় করে তুলতে ধারাভাষ্যকাররাই পারেন।

বর্তমান সময়ে ধারাভাষ্যের মান আমার চোখে অন্তত বেশ নিম্নগামী। নতুনদের মধ্যে একমাত্র অজিত আগারকার আমায় আকর্ষণ করেছেন। কাজেই এই অনুশীলন শুধু আমার প্রিয় ধারাভাষ্যকারদের সুমধুর স্মৃতি রোমন্থন করাই নয়, নতুনদের মনে করিয়ে দেয়া যে – ‘তোমরা একেবারেই এদের মর্যাদা রাখতে পারছোনা।’

মনে রাখতে হবে, আমার তৈরি কমেন্টেটর একাদশ কিন্তু শুধু ইংরেজি এবং দূরদর্শনের ভাষ্যকারদের নিয়ে হবে। যথেষ্ট রেডিও সম্প্রচার আমি শুনিনি কাজেই তাঁদের বাদ রাখছি। আর এটা যেহেতু টেস্ট একাদশ, তাই শুধু মাত্র টেস্ট খেলেছেন এমন ভাষ্যকাররাই এই দলে থাকবেন। আমার অন্যতম প্রিয় তিন ভাষ্যকার মার্ক নিকোলাস, টনি কোজিয়ার এবং হার্শা ভোগলেকে তাই বুকে পাথর চেপে বাদ দিতে হচ্ছে। তাহলে আর দেরি না করে শুরু করা যাক।

  • ওপেনার

মার্ক টেলর এবং বিল লরি আমার এই দলে ওপেনারের ভূমিকা পালন করবেন। অথেরটন এবং গাভাস্কার, দুজনেই খুব কাছাকাছি রয়েছেন। তবে বিল লরির কণ্ঠের উষ্ণতা বা মার্ক টেলরের সুচারু বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং মাখন মাখানো কণ্ঠস্বর গাভাস্কার বা অথেরটনকে এই দলের বাইরে রাখবে।

গাভাস্কারের দারুণ বিশ্লেষণী শক্তি এবং স্পষ্টবাদীতা, সাথে দারুণ রসবোধের উল্লেখ এই ক্ষেত্রে না করে পারছিনা। আমার ধারণা ভারতীয় বোর্ডের রক্তচক্ষু না থাকলে আমরা গাভাস্কারের মধ্যে এক অপূর্ব ভাষ্যকারকে পেতাম।

  • মিডল অর্ডার

নাসির হুসাইন, ইয়ান চ্যাপেল এবং ডেভিড গাওয়ার। নাসির হুসাইন এবং ইয়ান চ্যাপেল কিন্তু ঠোঁটকাটা স্বভাবের জন্যে কুখ্যাত। ঠিক এই কারণেই এই দুজনের ধারাভাষ্য আমার এতো পছন্দ। দুজনেরই শব্দ ভান্ডার দারুণ সমৃদ্ধ। চ্যাপেল সাহেব নিজের খেলোয়াড়ি জীবনের কাহিনী গুলো অসম্ভব ভালো বলতেন।

তাঁর ধারাভাষ্যে একটা বেশ অলস এলিগেন্স ছিল, যা আমাকে ভীষণ আকৃষ্ট করে। কোনো পরিস্থিতিতেই ছাদ ফাটানো চিৎকার তাঁকে আমি করতে দেখিনি। হুসেন আবার টেস্ট, টি-টোয়েন্টি এবং একদিনের ম্যাচ, সবেতেই সমান সাচ্ছন্দ্যের সাথে মানিয়ে নিতে পারেন। এবার আসি গাওয়ার এর কথায়।

আগে মাঝে মাঝে ভারতীয় দূরদর্শনে স্কাই টিভির ম্যাচ পরবর্তী এবং পূর্ববর্তী অনুষ্ঠান দেখানো হতো। সেই অনুষ্ঠান গুলির সঞ্চালনা করতেন গাওয়ার। মায়ান্তি লাঙ্গের বা যতীন সাপরুর শেখা উচিত, ক্রিকেটের অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা ঠিক কেমন হওয়া উচিত। সাথে ওনার সিল্কের মতো কণ্ঠস্বর এবং অগাধ ক্রিকেট প্রজ্ঞা তো আছেই।

  • অল রাউন্ডার

রিচি বেনো এবং টনি গ্রেগ। চ্যানেল নাইন ক্রিকেট সম্প্রচারে যে বিপ্লব ঘটিয়েছে, তার দুই পুরোধা হলেন এই দুজন। বেনো তো ক্রিকেট ধারাভাষ্যের ব্রাডম্যান। ঠিক কতটুকু বলা দরকার এবং কিভাবে, তা রিচির চেয়ে ভালো আর কেউ বুঝতেন না। তিনি লিখেছিলেন, ‘দর্শক টিভিতে স্কোরবোর্ড দেখতে পাচ্ছে।

অযথা সেই একই জিনিস বলে তাকে বিরক্ত করার মানে হয় না।’ নৈশব্দ কে আর্টের পর্যায় উন্নীত করেন রিচি। গ্রেগ আবার উপমহাদেশীয় দর্শকের নাড়িটা দারুণ বুঝতেন। লরির মতোই উষ্ণতা ভরা কণ্ঠস্বর ছিলো টনি গ্রেগের।

  • উইকেটরক্ষক

ইয়ান স্মিথ। দুই ইয়ান-হিলি এবং স্মিথ ছাড়া এই জায়গায় আমার দেখা সেরকম দাবিদার নেই। বর্তমানে গিলক্রিস্ট বেশ ভালো কাজ করছেন, কিন্তু ওনার কাজও খুব চড়া সুরে বাঁধা।

বোলার: মাইকেল হোল্ডিং, ইয়ান বিশপ এবং রবিন জ্যাকম্যান। হোল্ডিংয়ের স্পষ্টবাদিতা এবং সংযম তাঁকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে রেখেছে। বিশপ আবার প্রতিটা জিনিসের ভিতরে ঢুকে বিশ্লেষণ অপূর্ব করেন। আর জ্যাকমানকে মনে থাকবে ব্যতিক্রমী শব্দ চয়ন এবং বর্ণনার জন্যে।

তাহলে দলটা দাঁড়ালো এরকম – মার্ক টেলর, বিল লরি, নাসির হুসাইন, ইয়ান চ্যাপেল, ডেভিড গাওয়ার, রিচি বেনো, টনি গ্রেগ, ইয়ান স্মিথ, মাইকেল হোল্ডিং, ইয়ান বিশপ, রবিন জ্যাকম্যান।

রিচি বেনো থাকতে অন্য কেউ এই দলের অধিনায়ক হবার কথা ভাববেনও না।

বিশেষ উল্লেখ: সৌরভ গাঙ্গুলী, সুনীল গাভাস্কার, সাইমন ডওল (যখন টেস্টের ধারাভাষ্য দেন, টি-টোয়েন্টি তে শোনা যায়না), কুমার সাঙ্গাকারা ,ইয়ান বোথাম , মাইকেল অথেরটন এবং ইমরান খান। ইমরান নিয়ে এক লাইন বলতেই হবে। এর আগে আমি কখনো ইমরানের ধারাভাষ্য শুনিনি।

তবে লকডাউনের শুরুতে ভারত-পাকিস্তান ১৯৯৬ এবং ১৯৯৯ বিশ্বকাপের ম্যাচ দুটি পুন:সম্প্রচারিত হয়। সেই দুটিতেই ইমরান ছিলেন ভাষ্যকার হিসাবে। এতো সুন্দর কণ্ঠস্বর, শব্দচয়ন এবং সংযম, আমার মনে হয়েছিল এই লোকটা নিয়মিত ধারাভাষ্য দিলে হয়তো বেনোকে চ্যালেঞ্জ জানাবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link