দুঃসময়টা কেটে যাওয়ার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিলো। কিন্তু আবার ঘোরতর ভাবে ফিরে এসেছে মহামারীর আঘাত।
সারা পৃথিবীই করোনার দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত।
প্রথম দফা ভয়ানক সংক্রমণের সময়টায় খেলাধুলা বন্ধ ছিলো। কিন্তু এবার আর খেলাধুলা থেমে থাকেনি। ফুটবলে ততোটা কড়াকড়ি হচ্ছে না। প্রায় স্বাভাবিকভাবেই দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে খেলা চলছে। ক্রিকেটে অবশ্য এই জায়গায় তৈরী হয়েছে বায়ো বাবলের মতো একটা আইডিয়া। আর এই বায়ো বাবল একেবারেই ক্লান্তিকর, জীবনগ্রাসী একটা ব্যাপার হয়ে উঠেছে ক্রিকেটার ও ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের জন্য।
এই ওয়াকার ইউনুসকে দিয়েই আমরা উদাহরণটা পেতে পারি।
১৪ বছর আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট খেলেছেন, চার দফা পাকিস্তান দলের সাথে ছিলেন কোচিং স্ট্যাফে; কিন্তু এতো বেশি হতাশা আর ক্লান্তির মধ্যে কখনো বসবাস করতে হয়নি তাকে। গত দশ মাস ধরে পরিবারের সাথে দেখা করতে পারেন না। স্ত্রীর একটা অপারেশন হবে, সেখানে পাশে থাকতেও রীতিমতো সংগ্রাম করতে হলো এই কিংবদন্তী ফাস্ট বোলারকে।
ওয়াকার এখন পাকিস্তান দলের বোলিং কোচ।
পাকিস্তান একটানা ঘরে ও ঘরের বাইরে সিরিজ খেলছে। ফলে তাদের বায়ো বাবল ভাঙাই হচ্ছে না। ফলে লম্বা সময় ধরে এই হোটেলে আটকে থাকতে হচ্ছে সব ক্রিকেটারকে। এর মাঝে অবশ্য একটা ছুটি পেয়েছিলেন সবাই। ওয়াকারও পেয়েছিলেন।
ওয়াকারের পরিবার সিডনিতে। গত সেপ্টেম্বরে যখন ছুটি পেলেন, তখন শখ করে বৌ বাচ্চার কাছে দুটো দিন থাকার জন্য ছুটে গেলেন অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু করোনা তো কোনো কিছুই আর আগের মত রাখেনি। এখন আর বিমান থেকে নেমে সরাসরি বাসায় যাওয়া যায় না। সিডনিতে নেমে ওয়াকারকে ১৪ দিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে যেতে হলো। ওয়াকারও সেখানে বসে দিন গুনছিলেন; বাচ্চাদের দেখতে পাবেন।
৮ দিনের মাথায় ওই কোয়ারেন্টিনে থেকেই খবর পেলেন-বাবা মারা গেছেন। বৌ-বাচ্চা পড়ে রইলো সিডনিতে। বাসার কয়েক কিলোমিটার দূরে থাকা ওয়াকার তাদের মুখটা না দেখেই আবার পাকিস্তানে ফেরার বিমান ধরলেন। বাবার দাফন শেষ করে যে আবার সিডনি ফিরবেন, সে সুযোগ ছিলো না। আবার পরের সিরিজের জন্য জন্য হোটেলে ঢুকে যেতে হলো।
এর মধ্যে স্ত্রীর অসুস্থতা বাড়লো। তার অপারেশন করানোটা জরুরী হয়ে গেলো। এবার আর না ফিরে উপায় নেই। অবশেষে ছুটি পেয়েছেন ওয়াকার।
সামনের জিম্বাবুয়ে সিরিজের দল থেকে ছেড়ে দিয়েছে পাকিস্তান দল। ওয়াকার উড়াল দিয়েছেন সিডনির উদ্দেশ্যে। কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়। আবার সিডনিতে গিয়ে কোয়ারেন্টিন করতে হবে তাকে। ছাড়া পাবেন ঠিক স্ত্রীর অপারেশনের দিন।
ওয়াকার আসলে এই সময়ের একটা প্রতীক।
আসলে এই সময়ে এই লড়াইটা তো সব ক্রিকেটারের, ক্রিকেট কোচের। এই সময়ে সদ্যজাত সন্তানের পাশে একবার যেতে না পারার বেদনা নিয়ে লড়েন সাকিব, অসুস্থ বাবার পাশে থাকতে না পারার কষ্ট নিয়েই হোটেলে বন্দী থাকেন অন্য কেউ।
দূরে যাওয়ার দরকার কী?
আমাদের শহিদুল ইসলামের কথাটা মনে করে দেখুন। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপের কথা। টুর্নামেন্টের সেরা বোলারদের একজন ছিলেন এই পেসার। বাবা অসুস্থ। কিন্তু হোটেল থেকে বের হওয়ার অনুমতি নেই। শেষ পর্যন্ত ওই হোটেলে বসেই বাবার মৃত্যু সংবাদ পেলেন। বেরিয়ে বাবাকে শেষ দেখাটা দেখে আবার আইসোলেশনে ঢুকলেন। আইসোলেশন শেষ করে ফাইনালে নায়কও হলেন।
এটাই এখন নতুন দুনিয়া।
বারবারই বলা হচ্ছে, করোনার আগের দুনিয়া আর করোনার পরের দুনিয়া কখনো এক হবে না। হয়তো আবার আমরা কিছুটা স্বাভাবিক হবো। কিন্তু সবকিছু আগের মতো হওয়াটা এখন এক স্বপ্নের ব্যাপার হয়ে গেছে। এখন এই বাস্তবতা নিয়েই চলতে হবে। নতুন এই বাস্তবতায় পেশা আর পরিবার দুই জগতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।
অনেকে এই বাস্তবতা মানতে না পেরে পেশাকে বিসর্জন দিতেও কসূর করবেন না। অনেকের কাছে মনে হবে, এই হোটেলে বন্দী হয়ে থাকার চেয়ে না খেয়ে পরিবারের কাছে থাকাও ভালো।
এই সুরেশ রায়নার কথাই ধরুন।
আরব আমিরাতে আর সকলের সাথে বন্দী ছিলেন হোটেলে। সেখানে বসে শুনলেন পরিবারে এক ডাকাতি ও হত্যার ঘটনা। রায়না সহ্য করতে পারলেন না। কোয়ারেন্টিনকে লাথি মেরে দেশে ফিরে এলেন। আর খেললেনই না সেবারের আইপিএল। দল মালিক খোদ এন শ্রীনিবাসন রায়নাকে খোচা দিয়ে কথা বললেন। তারপরও রায়না পেছন ফিরে দেখেননি।
অবস্থাটা এমন হচ্ছে যে, ক্রিকেটারদের এরপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে-পরিবার, নাকি খেলা!