নাচতে জানলে উঠোন নাকি কোনো সমস্যা না। বাঁকা উঠোনেও নাকি দিব্যি নেচে ফেলা যায়।
আমরা নাচের লোক নই। তাই সে ব্যাপারে কিছু না বলি। তবে ক্রিকেটের কথা বলতে পারি। খেলতে পারলে আসলে মাঠ, উইকেট, আলো; এসব কোনো ব্যাপারই না। বিশ্বাস হচ্ছে না? আপনি এই লেখাটি পড়ার পরই উপসংহারে পৌছে যাবেন- ক্রিকেট খেলার জন্যে ২২ গজি পিচের দরকার নেই, তা খেলা যেতে পারে সবখানে।
হাটে? মাঠে? বাটে? বরফের পাত কিংবা সমুদ্রের স্রোত? নাকি উচু কোন পাহাড়ের চূড়ার ক্রোধ? সেখানে যদি হাঁটতে পারে একটা বিড়াল, তবে খেলা যাবে ক্রিকেটও!
- এই বালুকাবেলায়
ফাটা পিচ? বাজে আউটফিল্ড? আলোর স্বল্পতা? ক্রিকেট ম্যাচ না হওয়ার জন্যে এত এত শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন!
তাহলে আপনাদের ‘আইল্যান্ড সেইলিং ক্লাব’ আর ‘রয়্যাল সাউদার্ন ইয়াট ক্লাব’-এর গল্প শোনাই, যারা কিনা তাদের বার্ষিক ক্রিকেট ম্যাচটা খেলে একটা সমুদ্রের বালুকাবেলায়।
হ্যা, ভুল শোনেননি। একটা ক্রিকেট ম্যাচ খেলা হয় বালুকাবেলায়। সেখানে নিচু কাদাবালি যেমন থাকে, তেমন থাকে পানির স্রোত। তাঁর মধ্যেই চলে বার্ষিক ক্রিকেট ম্যাচ।
তবে অদ্ভুত এই ক্রিকেট ম্যাচের কিছু গোলমেলে নিয়ম আছে। যেমন, এই ম্যাচে অংশ নেওয়া সব ক্রিকেটারকে সাদা রঙ পরিধান করতে হবে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, এই ম্যাচে কোন দল হারবেনা, অংশ নেওয়া দুটি দলকেই ম্যাচ শেষে জয়ী ঘোষণা করা হবে।
অদ্ভুত নিয়মের এই অদ্ভুত ক্রিকেট ম্যাচের প্রচলন কিন্তু একদমই আধুনিক যুগে না। সূচনা খুঁজতে হলে আপনাকে ফিরে যেতে হবে ১৯৫০ সালে। ১৯৫০ সালে এই ক্রিকেট ম্যাচ প্রথমবারের মত আয়োজন করেন উফা ফক্স; যিনি পেশায় ছিলেন একজন নৌকা প্রস্তুতকারক। উফা ফক্সের সেই ক্রিকেট ম্যাচ এরপর থেকে আয়োজিত হতে থাকল প্রতিটা বছরেই।
- পাহাড় চূড়ায়
সমুদ্র ছেড়ে একটু পাহাড়ে ঘোরা যাক। হ্যা, সেখানেও ক্রিকেট ম্যাচ হয়। শুধু হয় বললে অবশ্য কম বলা হবে, সুইস ক্রিকেট ক্যালেন্ডারের সবচাইতে মর্যাদাপূর্ণ ক্রিকেট ম্যাচটা আয়োজিত হয় সেইন্ট মরিটজ এর চূড়ায়। এই ম্যাচটার শুরুর ইতিহাস অল্প দিনের নয়, প্রথম এই ম্যাচ আয়োজিত হয় ১৯৮৮ সালে।
গল্পটা খুলে বলা যাক। ইংলিশ একদল ট্যুরিস্ট এসেছিলেন এই পাহাড়ে ঘুরতে। ঘুরতে এসে হঠাৎ তাদের ইচ্ছে হল ক্রিকেট খেলার। ব্যাস, যেই ভাবা সেই কাজ। পাহাড়ের চূড়ায় একটা ফাঁকা জায়গাকে কোনভাবে প্রস্তুত করে নিয়ে তাঁরা নেমে পড়লেন ক্রিকেটে। আর এরপর থেকে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারী মাসে এখানে ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। বছরের এই সময়টাতে এখানে একটা বরফে জমা লেক থাকে, ম্যাচটা ওখানেই অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৮ সালে এই ম্যাচ খেলতে একবার এন্ড্রু সাইমন্ডস, মাহেলা জয়াবর্ধনে, বীরেন্দর শেবাগ, শোয়েব আকতার আর গ্রায়েম স্মিথ গিয়েছিলেন।
- হাড় কাঁপানো শীতের জগত
আচ্ছা, শূন্য ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার নিচে কি ক্রিকেট খেলা যায়? আপনি হয়ত না সূচক উত্তর দেবেন, তাহলে এই ঘটনাটি শুনুন। ১৮২২-১৮২৩ সালের দিকে উইলিয়াম এডওয়ার্ড পেরি নামক একজন এক্সপ্লোরার নর্থওয়েস্ট প্যাসেজে অনুসন্ধানে যান। সেই দলটার জাহাজ ছিল দুটো ‘এইচ এম এস ফুরি” আর ‘এইচ এম এস হেকলা’। অনুসন্ধানের নেতৃত্বে ছিলেন জর্জ ফ্রান্সিস লিঁও।
সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ জাহাজ দুটো বরফে আটকে গেল আর কিছুক্ষণ পর জর্জ আর তাঁর দল টের পেলেন আগামী বছরের বরফ গলার আগে এই জাহাজ ছাড়া পাওয়ার কোন রাস্তা নেই। দুর্গম সেই অঞ্চলে তখন যোগাযোগেরও কোন উপায় ছিল না তাদের। ফলাফল, একটা বছর দলটাকে কাটাতে হবে ওখানেই। জানিয়ে রাখি, দ্বীপের সাধারণ তাপমাত্রা ছিল -২৩০ থেকে -৩৫০ সেন্টিগ্রেড। নর্দার্ন কানাডার সেই জায়গাতে সময় কাটানোর জন্যে দলটা যে জিনিসটা খুঁজে পেল তা হল ক্রিকেট। ব্যাস, শূন্য ডিগ্রির নিচে চলতে থাকল ক্রিকেট ম্যাচ।
- হিমালয় হিমালয়
এভারেস্টের বেস ক্যাম্প কি ক্রিকেট খেলার উপযুক্ত? হলেও কি, আর না হলেও বা কি।
২০০৭ সালে ১৮ ব্রিটিশ ক্রিকেটার খেলার জন্যে বেছে নিয়েছিল এটাকেই। দলটার মূল উদ্দেশ্য ছিল, সর্বোচ্চ উচ্চতায় ক্রিকেট খেলার একটা রেকর্ড গড়া। সেই রেকর্ড গড়তে গিয়ে তাঁরা সিক্স-এ-সাইড পাঁচ ওভারের একটা ম্যাচ খেলে সেখানে। রেকর্ডটা অবশ্য খুব বেশিদিন টিকে থাকেনি, কেননা ২০০৯ সালে গ্রোপ শেপ গ্লেসিয়ারে একটা পুরো ২০ ওভারের ম্যাচ হয়। যেখানে ম্যাচটা খেলা হয়, ভূ-পৃষ্ট থেকে জায়গাটার উচ্চতা ছিল ৫১৬৫ মিটার।
এই রেকর্ডটা অনেকদিন অক্ষত ছিল। তবে ২০১৪ সালে কিলিমাঞ্জারোর চূড়ায় ক্রিকেট ম্যাচ খেলার মধ্যে দিয়ে সর্বোচ্চ উচ্চতায় ক্রিকেট ম্যাচ খেলার এক নতুন রেকর্ড স্থাপিত হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৭৫২ মিটার উচ্চতায় খেলা এই ম্যাচ এখন অব্দি সর্বোচ্চ উচ্চতায় খেলা ক্রিকেট ম্যাচ!
- গভীর জঙ্গলে
কেনিয়াতে একবার আলিয়া বোয়ার গিয়েছিলেন বেবুন (বানরজাতীয় প্রাণী) এর ওপর গবেষণার কাজে। সেখানে গিয়ে তিনি দেখলেন, ক্রিকেটকে তিনি প্রচন্ড মিস করতে শুরু করেছেন। তা সেই ক্রিকেট বিরাগ কাটাতে তিনি স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দাকে ক্রিকেট শেখাতে শুরু করলেন। এরপর মজার যে ব্যাপারটা ঘটে গেল, স্থানীয় মাসাই উপজাতি একটা আস্ত ক্রিকেট দল গঠন করে ফেলল। দলটার একটা নামও দিয়ে দিল তাঁরা- মাসাই ওয়ারিয়র্স।
গবেষক আলিয়া কেনিয়া ছেড়ে এলেন। কিন্তু মাসাই ওয়ারিয়র্স নিজেদের ক্ষেত্র বাড়াতে লাগল। এখন তাঁরা ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে নিয়মিত ইংল্যান্ড সফর করে। তবে, ক্রিকেট ম্যাচের মধ্যে দিয়ে আরো মহৎ উদ্যোগ নিয়েছে মাসাই ওয়ারিয়র্স। আর তা হল প্রতিটা ক্রিকেট ম্যাচের মধ্যে তাঁরা জনসচেতনতা তৈরির চেষ্টা করে। সেই জনসচেতনতার বিষয় কখনও হয় লিঙ্গবৈষম্যের, কখনও এইচআইভি বা কখনও সমকালীন কোন সমস্যা।
- গহীন গুহা
গুহার মধ্যেও কিন্তু ক্রিকেট ম্যাচ হয়। ২০১৩ সালে এমনই এক ক্রিকেট ম্যাচ দেখেছিল বিশ্ব। ইংল্যান্ডের লেক ডিস্ট্রিক্টের এক গুহায় আয়োজিত সেই ক্রিকেট ম্যাচের উদ্দেশ্য ছিল বন্যার্তদের সহায়তায় দাতব্য অর্থ তোলা। ম্যাচটা আয়োজিত হয়েছিল বড়দিনের উৎসবে । আইসিসি চাইলে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচের বিকল্প হিসেবে এই ম্যাচের দিকে কিন্তু তাকাতেই পারে!
ক্রিকেটের এই যে গল্পগুলো বললাম, সেগুলো রেকর্ডের পাতায় আছে। তবে আমাদের বাংলাদেশেই কিন্তু আরো নানারকম অদ্ভুত জায়গাতে ক্রিকেট খেলা হয়। নির্মীয়মান রাস্তার উপর কিংবা বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত মাঠের ওপর- কোথায় ক্রিকেট খেলা হয়না এদেশে?
কিন্তু সেসবের খবর তো আর রেকর্ডের পাতায় থাকেনা!
-দ্য ক্রিকেট মান্থলি অবলম্বনে