দশক সেরা টেস্ট বোলিং

এবারের আয়োজন টেস্টের দশক সেরা পাঁচ স্পেল নিয়ে। এই স্পেলগুলি বাছাই করার ব্যাপারে আমাদের কাছে উইকেট সংখ্যার চেয়েও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে কোন পরিস্থিতে সেই উইকেট এসেছে, তার গুণগত মান এবং বিপক্ষের ব্যাটিং।

এক দশক পর হিসেবের খাতা নিয়ে সকলেই বসছেন। আমরাও বসি। তবে দশক সেরা দল অনেকেই বানাচ্ছেন, তাই সেই পথ দিয়ে হাঁটছি না। টেস্ট ও ওয়ানডের নিরিখে, দশকের সেরা পাঁচ ম্যাচ, সেরা পাঁচ ইনিংস, সেরা পাঁচ স্পেল ইত্যাদি বেছে নেবো।

এবারের আয়োজন টেস্টের সেরা পাঁচ স্পেল নিয়ে। এই স্পেলগুলি বাছাই করার ব্যাপারে আমাদের কাছে উইকেট সংখ্যার চেয়েও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে কোন পরিস্থিতে সেই উইকেট এসেছে, তার গুণগত মান এবং বিপক্ষের ব্যাটিং। তাহলে আর দেরি না করে শুরু করা যাক।

  • মন্টি পানেসার (৫/১২৯ ৬/৮১) বনাম ভারত, মুম্বাই ২০১২

নব্বইয়ের দশকের পর ভারতের মাটিতে বিদেশি স্পিনার আসা মানে কচুকাটা হওয়া ধরাবাঁধা। শেন ওয়ার্ন, মুত্তিয়া মুরালিধরণ কেউ পারেননি সেভাবে। তো মন্টি পানেসার নামের কেউ বিরাট কিছু করে ফেলবে, এমনটা ভাবাও হয়নি। তার আগের টেস্টে ইংল্যান্ডের ওপরে স্টিমরোলার চালিয়ে জিতেছে ভারত।

ফলত: মুম্বাইয়ে ঘূর্ণি উইকেট। পানেসার সেই সময় গ্রায়েম সোয়ানের দাপটে দল থেকে একরকম বেরিয়েই গেছিলেন। কিন্তু পিচ দেখে সেই ম্যাচে তাঁকে ফিরিয়েছিলো ইংল্যান্ড। সেই ম্যাচে বাজে খেললে ইংল্যান্ডের দলের দরজা সারাজীবনের জন্যেই বন্ধ হয়ে যাবে। সেইরকম চাপের পরিস্থিতিতে পানেসার যে বোলিং করেছিলেন, গত দশ বছরে কোনো বিদেশি স্পিনার কে সেরকম করতে দেখিনি।

আর আউট করেছিলেন কাকে? বিরাট কোহলি, মহেন্দ্র সিং ধোনি, বীরেন্দ্র শেবাগ এবং তখনো সবচেয়ে বড়ো উইকেট শচীন টেন্ডুলকার। শচীনকে যে বলে আউট করেছিলেন, ভারতের মাটিতে এই শতাব্দীতে হওয়া সেরা বল আখ্যা দেয়াই যেতে পারে। এবং শুধু প্রথম ইনিংসে নয় দ্বিতীয় ইনিংসেও একই রকম বিধ্বংসী বোলিং করে ভারতকে ম্যাচ এবং সিরিজ থেকেই লগ-আউট করে দেন। অনেকে পিটারসেনের সেই ১৮৬ কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধরেন ইংল্যান্ডের সেই সিরিজ জয়ে, ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় পানেসারের সেই বোলিংয়ের একই রকম রকম গুরুত্ব ছিল ইংল্যান্ডের সেই জয়ে।

  • মিশেল জনসন (৭/৪০) বনাম ইংল্যান্ড, অ্যাডিলেড ২০১৩

২০১৩ অ্যাশেজে মিশেল জনসন গতিকে ঠিক সেই মান্যতা দেন যা ওয়ার্ন ২০ বছর আগের এশেজে লেগস্পিনকে দেন। ব্রিসবেনের প্রথম টেস্টে জনসন ঢোকেন পরিবর্ত হিসাবে। সেখানে মোটামুটি বাকি সিরিজে কি আসতে চলেছে তার একটা আভাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা ছিল গ্যাবার গতিময় উইকেট। ইংল্যান্ডের মনোবল জনসন ভেঙেছিলেন অ্যাডিলেডের দ্বিতীয় টেস্টে।

অ্যাডিলেড ওভালের সামনের ওভাল রোডের মতো সপাট উইকেটে জনসন নেন সাত উইকেট, যার মধ্যে ছিল কুকের স্টাম্পস ভেঙ্গে দেওয়া আগুনের গোলা। সেই স্পেলের গুরুত্ব শুধু টেস্টের জয়-পরাজয়ে সীমিত ছিল না, পেস বোলিংকে পুনরায় আবেদনময় করে তোলাতে জনসনের সেই স্পেলের গুরুত্ব অপিরিসীম।

  • ভার্নন ফিল্যান্ডার (৫/১৫) বনাম অস্ট্রেলিয়া, কেপটাউন ২০১১

১৮৯ রানে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় অস্ট্রেলিয়ার সামনে নিজের প্রথম টেস্টে নতুন বল হাতে নামা। পরিস্থিতি হিসাবে ভাবতেই অনেকের বুক কেঁপে যাবে। কিন্তু ফিল্যান্ডারের বুক তো কাঁপেই নি, উল্টে তিনি অস্ট্রেলিয়াকে তাদের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম লজ্জার সম্মুখীন করেছিলেন। ৪৭ অল-আউটের লজ্জা অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের সোনালী পাতায় একটা কালো দাগ হিসাবে থেকে যাবে।

তার নেপথ্যে এই একজন, ভার্নন ফিল্যান্ডার। তাঁর শিকারের মধ্যে অন্যতম দুই ছিলেন পন্টিং ও প্রথম ইনিংসে ১৫০ করা ক্লার্ক। সেই ম্যাচের গতিপথ ওই ঘন্টাদেড়েকের খেলায় বদলে দেন ফিল্যান্ডার। অসামান্য সিম বোলিংয়ের যে নিদর্শন তিনি দেখিয়েছিলেন, খুব বেশি লোক তা পারেন না।

  • স্টুয়ার্ট ব্রড (৬/১৭) বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা, জোহানেসবার্গ ২০১৫

দক্ষিণ আফ্রিকার ৩১৩ রানের জবাবে ইংল্যান্ড করে ৩২৩। সিরিজে তখনো পিছিয়ে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ছিল সুবর্ণ সুযোগ ২০০ রান তুলে ইংল্যান্ডকে জোবার্গের ফাটা ফাটা উইকেটে চতুর্থ ইনিংস খেলানোর এবং সিরিজে সমতা ফিরে পাবার। কিন্তু স্টুয়ার্ট ব্রড অন্য কিছুই ভেবেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ছয় ব্যাটসম্যানকে শুধু অল্প রানে তুলে নেননি, রীতিমতো নাকানিচোবানি খাইয়েছিলেন।

প্রায় প্রতি বলেই মনে হচ্ছিলো, একটা উইকেট নেবেন ব্রড। নিজের দিনে ব্রড কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারেন, সেটা সকলেরই জানা, কিন্তু এতটা এর আগে তিনি একবারই দেখিয়েছিলেন। সেটার বিষয় আসছি পরে। আগে বলে নেয়া যাক ব্রডের শিকার কারা কারা ছিলেন। এলগার, আমলা, ডুপ্লেসি এবং ডিভিলিয়ার্স। সুইং, বাউন্স এবং ধারাবাহিকতার যে ত্রয়ী সেদিন দেখা যায়, তা দক্ষিণ আফ্রিকাকে সিরিজ থেকে পুরোপুরি বের করে দেবার জন্যে যথেষ্ট ছিল।

  • স্টুয়ার্ট ব্রড (৮/১৫) বনাম অস্ট্রেলিয়া, ট্রেন্টব্রিজ ২০১৫

আবারো ব্রড। এবার অ্যাশেজ পুনরুদ্ধারের লড়াই। অ্যান্ডার্সন বিহীন ইংল্যান্ড সেই ম্যাচে কিছুটা ব্যাকফুটেই ছিল। স্মিথ, ওয়ার্নার, রজার্সরা আগের টেস্টের ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে বড়ো রানের ক্ষিদে নিয়ে মুখিয়ে ছিলেন।ওপেনিং স্পেলে ব্রড কে খেলে দিলেই নিশ্চিন্ত। আনকোরা মার্ক উড বা অ্যান্ডারসনের পরিবর্ত স্টিফেন ফিনকে তো স্মিথরা চোখ বুজে খেলেই দিতেন।

কিন্তু তখন কে জানতো স্টুয়ার্ট ব্রডের জীবনের সেরা দিন সেদিনই আসতে চলেছে। সুইং বোলিংয়ের যে প্রদর্শনী সেদিন ব্রড দেখিয়েছিলেন, অস্ট্রেলিয়া সমর্থকরা নিশ্চয় সিধু জ্যাঠার ভাষায় বলেছিলেন, ‘ইসস! কি ভীষণ।’ সেই ৪৭ এর চার বছর পর অস্ট্রেলিয়া আবারো লজ্জায় নিমজ্জিত হয়, এবার সংগ্রহ ৬০। এরপর ম্যাচে ফিরে আসার আশা হয়তো অতি বড় অস্ট্রেলিয়া সমর্থকও করেননি, এবং প্রত্যাশা মতোই তা হয়নি। দু’দিন বাদে শানিবাসরীয় দুপুরে বিয়ার স্নাত ব্রড অ্যাশেজ পুনরুদ্ধারের উদযাপন করেছিলেন।

এছাড়াও বহু অনবদ্য বোলিং স্পেল আমরা দেখেছি গত দশকে। যেমন মেলবোর্নে জাসপ্রিত বুমরার ছয় উইকেট, ব্যাঙ্গালুরুতে নাথান লিওঁর আট উইকেট, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রঙ্গনা হেরাথের নয় উইকেট, ব্যাঙ্গালুরুতে অশ্বিনের ছয় উইকেট এবং আরো অনেক। যেগুলো বাদ গেলো তার জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...