ইংরেজ দ্বারা শাসিত কিংবা শোষিত এই ভারতীয় উপমহাদেশে ক্রিকেটের বিস্তার অনেকটাই স্বাভাবিক ঘটনা।
ইংরেজদের বহু রীতিনীতি এখনও এ অঞ্চলে বিদ্যমান। তাদের চালু করা খেলা ক্রিকেটও তাই এ অঞ্চলের মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে। প্রতিটা খেলার ভিন্ন ভিন্ন আমেজের পাশাপাশি রয়েছে নানান বৈরিতাও। ক্রিকেটেও তাই।
ক্রিকেটে, প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথের জনপ্রিয়তা বরাবরই তুঙ্গে। তবে একে বৈরিতা বলা চলে না। বৈরিতা দেখা যেতে পারে যুদ্ধের ময়দানে। যদিও, মাঠের ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথের সূচনা বৈরিতা থেকেই। ইংরেজদের থেকে ১৯৪৭ সালে দুই দেশ বিভক্তির ফলে ভারত-পাকিস্তান দুটো আলাদা ভূখণ্ড তৈরি হওয়ার পর, রাজনৈতিক মাঠের উত্তাপ খেলার মাঠেও আশ্রয় নিতে শুরু করে।
ক্রিকেটের জন্মভূমি ইংল্যান্ডে হলেও, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের উত্তাপের কাছে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া অ্যাশেজ সিরিজের জৌলুশ বরাবরই পর্দার আড়ালে চলে যায়। প্রথমবারের মতো দু-দল মাঠে নামে ১৯৫২ সালে। এক ইনিংস ও ৭০ রানে প্রথম সাক্ষাতে দিল্লীতে প্রথম জয়টা ভারতের। তবে টেস্ট ক্রিকেটে দুই দলের ৫৯ ম্যাচে সর্বাধিক ১২ জয় পাকিস্তানের, অন্যদিকে ভারতের জয় নয়টি। হিসাব গরমিল লাগতেই পারে; কারণ, বাকি ৩৮ ম্যাচ হয়েছে ড্র।
ওয়ানডে ক্রিকেটের যুগটা শুরু হয় আরও দেরিতে। দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর প্রথম দেখা ১৯৭৮ সালে। তাতেও জয় ভারতের। কিন্তু, পরের চিত্র পুরোই উল্টো রথের। কালেভদ্রে ভারতের দেখা মিলতো পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের। বর্তমান যুগে ভারতের আভিজাত্য আকাশচুম্বি হলেও এখন পর্যন্ত রঙিন পোশাকে পাকিস্তানের ৭৩ জয়ের বিপরীতে ভারতের ৫৫ জয় আছে। লোকমুখে প্রচলিত আছে, ‘রঙিন পোশাক, রঙিন টেলিভিশন আর ২০০০ সালের আগমনে ভারত নিয়মিত পাকিস্তানের উপর চড়াও হতে শুরু করে মাঠের ক্রিকেটে।’
দ্বৈরথে উপমহাদেশের দুই শক্তির অবস্থান আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। যার প্রতিফলন গিয়ে পড়ে গণমাধ্যমে। ম্যাচ নিয়ে গণমাধ্যমের চুলচেঁড়া বিশ্লেষণ, সমালোচনা করতে গিয়ে সীমা অতিক্রম, ব্যক্তিগত আক্রমণ; এসব স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরাজয় স্বাভাবিক হলেও, কেউই মেনে নিতে পারেনা একে অপরের বিপক্ষে পরাজয়। সমর্থকদের প্রত্যাশার চাপকে উৎরে ম্যাচে জয়লাভ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার হলেও, তা করেই দেখানোই দায়িত্ব। কারণ, সমর্থকদের পরাজয় অপছন্দ।
এসবের জন্মই মূলত ভূখণ্ড বিভক্তির মাধ্যমেই। তবে অতীতকে পেছনে ফেলে মাঠের ক্রিকেটে বন্ধুত্বকে সঙ্গী করে, সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের মাধ্যমে একে অপরের মোকাবেলায় বিশ্বাসী বেশিরভাগ ক্রিকেটার। এসব নিয়ে ক্রিকেটারদের মন্তব্যের উদাহরণও আছে ভুরিভুরি।
বুম বুম আফ্রিদিই বলেছেন, ‘রাজনৈতিক বিষয়বস্তু ক্রিকেট থেকে আড়ালে রাখা উচিত। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ আবারও হওয়া জরুরি।’ আফ্রিদির সাথে একমত শোয়েব মালিকও। তিনিও মনে করেন, ‘দু-দলের মাঝে দ্বিপাক্ষীয় সিরিজ আয়োজন করা সময়ের দাবি।’
দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যকার সবশেষ সিরিজ আয়োজিত হয় প্রায় ৯ বছর আগে। টি-টোয়েন্টি সিরিজ ড্র হলেও, ২-১ ব্যবধানে পাকিস্তান জিতে নেয় ওডিআই সিরিজ। এরপর আর কোনো সিরিজ আয়োজন হয়নি সম্ভাবনা তৈরি হলেও। এখন এশিয়া কাপ, চ্যাম্পিয়ন’স ট্রফি,ও বিশ্বকাপেই দেখা হয় দু-দলের। তাতে অবশ্য জয়ের পাল্লা ভারতের বেশি হলেও ভারতকে হারিয়ে ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ঘরে তোলে পাকিস্তান। সবশেষ টেস্ট সিরিজ হয়েছে ১৪ বছর আগে।
পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও দু-দলের সিরিজ আয়োজন নিয়ে ইতিবাচক বার্তা দেওয়া হলেও, ভারতকে খুব বেশি মাথা ঘামাতে দেখা যায়না এ ইস্যুতে। বরাবরই নীরব ভূমিকা তাদের। তবে, বিশ্ব আসর কিংবা এশিয়া কাপে যতবার দেখা হয়েছে তাতে সফলতার পাল্লা ভারি করে রেখেছে ভারত। দ্বৈরথের ফলে মাঠের ক্রিকেটে কেউ কাউকে দিতে নারাজ এক বিন্দু ছাড়। এরপরেও, দু-দলের খেলোয়াড়দের মাঝে খেলার মাঠে কিংবা বাইরে বন্ধুত্বের দৃষ্টান্তও কম নয়। যা তৈরি করে বাড়তি সম্মান কিংবা বৃদ্ধি করে খেলার আমেজকে।
যেমন অভিষেকের প্রায় চারমাস পর ২০০৫ সালে পাকিস্তান সফরে গিয়ে দারুণ নৈপুণ্যে পাকিস্তানীদের প্রশংসাতেই উদ্ভাসিত হন এমএস ধোনী। নবাগত ধোনিকে আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সমর্থকরাই। এমনকি, পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি পারভেজ মোশাররফ ধোনির পারফরম্যান্সের সুনাম করার পাশাপাশি ধোনীর লম্বা চুলের প্রশংসাও করেন সবার সামনে। পরামর্শ দেন চুল না কাটতে।
শোয়েব আখতার তখন মূর্তিমান আতঙ্ক ক্রিকেটবিশ্বে। সৌরভ গাঙ্গুলি, শেওয়াগ কিংবা শচীন; কেউই সাবলিলভাবে সবসময় খেলতে পারেননি তাকে। আখতারের এক ফুল লেন্থের ডেলিভারিতে শচীনের স্ট্রেইট ড্রাইভ করা বল, আখতারের পায়ে আঘাত করলে তিনি মাটিতে বসে পড়েন ব্যাথায়। সতীর্থরা তাকে ঘিরে ধরলেও পরবর্তীতে শোয়েব আখতারকে ননস্ট্রাইকের ব্যাটসম্যান ভিরেন্দর শেওয়াগই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন সোজা হয়ে দাঁড়াতে। শেওয়াগ-আখতারের বন্ধুত্ব এখন রূপ নিয়েছে তারচেয়েও গভীরে।
একবার টেস্টে আফ্রিদির করা অফ স্ট্যাম্পের বাইরে লেগস্পিনের গতি বুঝতে না পেরে ভড়কে যান আজহার উদ্দীন। স্পিনের মাঝে আফ্রিদির আকস্মিক পেস বোলিং করার অভ্যাস তো আর নতুনকিছু নয়। সেদিন ভড়কে গিয়ে আজহার উদ্দীন আফ্রিদিকে হাসিমুখে বলে উঠলেন, ‘একটু আস্তে কর না বড় ভাই।’
এছাড়াও, সৌরভ গাঙ্গুলির মতে ইনজামামের পক্ষে ভারতের বিপক্ষে শতক হাঁকানো ছিলো মামুলি ব্যাপার। ইমরান খানের মতে তিনি নন! কপিল দেবই সেরা অল-রাউন্ডার। এমন বন্ধুত্বের নজির নেহাত কম নয়! ভিরাট কোহলির পক্ষ থেকে আমির যে ব্যাট উপর পেয়েছেন তা আর অজানা নেই কারোই।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে পরাজয়ের পরেও শোয়েব মালিকের সাথে খোশগল্পে মেতে উঠেন যুবরাজ-কোহলিরা বন্ধুত্বের প্রমাণই দিয়েছিলেন সেদিন। তাছাড়া, আফ্রিদি ও শোয়েব আখতারের সাথে যুবরাজ ও হরভজনের সুসম্পর্কের গল্প তো অনেক শুনেছে সবাই। সময় পেলেই সিরিজ চলাকালীন শোয়েব আখতার ঢু মারতেন ভারতের সাজঘরে। তবে বাইশ গজে লড়াইটা চলতো শেয়ানে-শেয়ানে।
সমর্থকদের মাঝেও বন্ধুত্বের নজির রয়েছে বেশ। শচীন টেন্ডুলকারের ভক্ত সুধীর কুমার চৌধুরী কিংবা পাকিস্তান ভক্ত বৃদ্ধ চাচাকে দেখা যায় গ্যালারিতে খেলা চলাকালীন একে-অপরকে জড়িয়ে ধরতে।
২০১৯ বিশ্বকাপে দু-দলের ম্যাচ শেষে মাঠের বাইরে পাকিস্তানীদের সান্ত্বনা দিতেও দেখা যায় ভারতীয়দের। এ সম্পর্কগুলো ক্রিকেটেরও উর্ধ্বে। যা কিনা, তুড়ি মেরে তাড়িয়ে দেয় যুগ যুগ ধরে চলা রাজনৈতিক বৈরিতাকে। ছড়িয়ে দেয় সম্প্রীতির বাণী।
রাজনৈতিক বৈরিতা থেকে যে উত্তাপ মাঠে ছড়িয়েছে তার আড়ালেও রয়েছে এমন আরও অনেক বন্ধুত্বের গল্প। ক্রিকেটে বাড়তি আনন্দ যোগ করে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ। নানাবিধ কারণে দু-দলের ম্যাচ আয়োজন এখন আর সম্ভব না হলেও! এই স্মৃতিগুলো এখনও বেশ চকচকে।
স্মৃতিগুলো মন খারাপও করে দেয় বটে। যেহেতু, দু-দলের মধ্যেকার সিরিজের দেখা নেই প্রায় ৯ বছর হতে চললো। আবার কবে দেখা মিলবে দুই দলের সিরিজে তা নিয়ে সন্দিহান ক্রিকেটভক্তরা। তবে অপেক্ষা তাদের থেমে নেই মোটেও, পুনরায় দ্বিপাক্ষীয় সিরিজে প্রতিবেশী দু-দল মাঠে নামবে, আশা সবার।