ব্র্যাডম্যান ট্র্যাজেডির ‘নায়ক’

প্রথম বল করলেন হোলিস, অর্থোডক্স লেগব্রেক। রান হলো না। অফস্ট্যাম্পে হাওয়া লাগিয়ে বের হয়ে গেল বলটা। পরের বলটি পিচ করালেন আরেকটু সামনে। ডন সামনে পা বাড়িয়ে খেলতে চাইলেন। কিন্তু গুগলিটা পড়তে পারলেন না। মিস করলেন বলের লাইন। স্টাম্পে বলের আঘাতের শব্দ এলো তার কানে। যে মাঠে তার আগের তিনটি টেস্ট ইনিংস ছিল ২৩২, ২৪৪ ও ৭৭ রানের, সেই ওভালেই শূন্য রানে বোল্ড!

১৩ টেস্টে ৪৪ উইকেট নেওয়া একজন লেগ স্পিনারকে ভুলেই যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এরিক হোলিস হারিয়ে যাননি, তাঁকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।

কারণ, ক্রিকেটের সবচেয়ে বিখ্যাত শূন্যটির সঙ্গে যে জুড়ে আছে তাঁর নাম! ক্যারিয়ারের গড়টা কাঁটায় কাঁটায় ১০০ করতে জীবনের শেষ টেস্টে মাত্র ৪ রান দরকার ছিল স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের। কিন্তু ওভালে এরিক হোলিসের গুগলিতে রানের খাতা খোলার আগেই বোল্ড হয়েছিলেন ব্র্যাডম্যান। হোলিসের কাছে যেটি স্মরণীয় মুহূর্ত, বাকি ক্রিকেটবিশ্বের কাছে সেটাই সর্বকালের সেরা অঘটন।

স্টাফোর্ডশায়ারের ওল্ড হিলে ১৯১২ সালে জন্মগ্রহণ করেন এরিক হোলিস। ১৯৩২ সালে ওয়ারউইকাশায়ারের হয়ে কাউন্টিতে অভিষেক হয় তার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তেমন সফলতা না পেলেও কাউন্টিতে তিনি ছিলেন অনবদ্য। ১৯৩৫ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত প্রতি মৌসুমে তিনি ১০০’র অধিক উইকেট শিকার করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাউন্টি ক্রিকেট বন্ধ থাকলে তিনি বার্মিংহ্যামের জেলা ক্রিকেট টুর্নামেন্টগুলোতে ব্রোমিচ ডার্টমাউথের হয়ে খেলতে শুরু করেন। এ সময় তিনি ডার্টমাউথের হয়ে পাঁচ বছরে ৪৯৯ উইকেট দখল করেন। তার সময়কালে প্রতিবছরই শিরোপা জিতেছিল ডার্টমাউথ।

নিজের সময়কালে তিনি ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা বোলার ছিলেন। এজবাস্টনের তুলনামূলক ধীরগতির পিচে তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। বলে টার্ন খুব বেশি ছিল না তার। তবে টপ স্পিন ছিল দুর্দান্ত। গুগলিও অনেক সময় ছিল দুর্বোধ্য। ধারাবাহিকভাবে বল রাখতে পারতেন একই লেংথে। এক প্রান্ত থেকে ক্লান্তিহীন বোলিং করে যেতে পারতেন দিনভর। প্রায় প্রতি মৌসুমেই বল করেছেন হাজারের বেশি ওভার।

১৯৫৭ সালে ক্যারিয়ারের শেষ মৌসুমেও বোলিং করেছেন সবার চেয়ে বেশি, ১ হাজার ১৫৭ ওভার। লেস্টারশায়ারের বিপক্ষে ম্যাচে এক পর্যায়ে তার টানা ৭৮ বলে কোনো রান নিতে পারেনি ব্যাটসম্যানরা। ১৯৪৬ সালে ওয়ারউইকাশায়ারের হয়ে দারুণ এক মৌসুম কাটান তিনি। পরিণত হন সে মৌসুমে কাউন্টির সর্বোচ্চ উইকেটসংগ্রাহকে। নটিংহ্যামশায়ারের বিপক্ষে এক ম্যাচে কোনো ফিল্ডারের সাহায্য ছাড়া শিকার করেন দশ উইকেট। এর মাঝে সাতটি ছিল বোল্ড এবং তিনটি এলবিডব্লিউ। ১৯৪৭ মৌসুমটা কিছুটা খারাপ কাটে তার। তবে স্বরূপে ফেরেন পরের মৌসুমেই।

১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্ট, স্যার ডনের ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট শুরু। অন্যদিকে এরিক হোলিসের অভিষেক টেস্ট।প্রথম দিনই ইংল্যান্ড ৫২ রানে অলআউট। এরপর ব্যাটিংয়ে নামল অস্ট্রেলিয়া। ১১৭ রানের উদ্বোধনী জুটি গড়লেন সিড বার্নস ও আর্থার মরিস। ৬১ রান করা বার্নসকে ফিরিয়ে জুটি ভাঙলেন হোলিস। মাঠে ঢুকলেন নতুন ব্যাটসম্যান ডন। যদিও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডের মাঠে খেলা, ব্যাট হাতে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিয়েছেন ইংলিশদেরই, তবু বিদায় বেলায় সেখানেই পেলেন দারুণ সম্মান ও ভালোবাসা।

ওভালের পুরো গ্যালারি উঠে দাঁড়াল। মাঠে ইংলিশ অধিনায়ক নরম্যানন ইয়ার্ডলি গোটা দলকে পাশে নিয়ে সম্মান জানালেন টুপি খুলে ও থ্রি চিয়ার্স দিয়ে। তাদের সঙ্গে করমর্দন করে উইকেটে গেলেন ডন। মাত্র ৪ রান করলেই তার টেস্ট ব্যাটিং গড় হয়ে যাবে পারফেক্ট হান্ড্রেড- ঠিক একশ। স্রেফ একটি শটের ব্যাপার। অনেক ইতিহাসের জন্ম দেওয়া ব্যাটে নতুন ইতিহাসের রচনা দেখতে পিনপতন নিরবতায় তাকিয়ে গ্যালারি।

প্রথম বল করলেন হোলিস, অর্থোডক্স লেগব্রেক। রান হলো না। অফস্ট্যাম্পে হাওয়া লাগিয়ে বের হয়ে গেল বলটা। পরের বলটি পিচ করালেন আরেকটু সামনে। ডন সামনে পা বাড়িয়ে খেলতে চাইলেন। কিন্তু গুগলিটা পড়তে পারলেন না। মিস করলেন বলের লাইন।

স্টাম্পে বলের আঘাতের শব্দ এলো তার কানে। যে মাঠে তার আগের তিনটি টেস্ট ইনিংস ছিল ২৩২, ২৪৪ ও ৭৭ রানের, সেই ওভালেই শূন্য রানে বোল্ড! ইংল্যান্ড ম্যাচ হারল ইনিংস ব্যবধানে। দ্বিতীয় ইনিংস তাই ব্যাট করার সুযোগ পেলেন না ডন। ব্যাটিং গড় ১০০ করারও কোনো সুযোগ তাই হলো না। ডনের ব্যাটিং গড় ৯৯.৯৪, সম্ভবত ক্রিকেটের সবচেয়ে আলোচিত সংখ্যা।

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ক্যারিয়ারে পুরোটা সময় জুড়ে খেলেছেন ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে। তাদের হয়ে ২১ বছরে ৫১৫ ম্যাচ খেলে শিকার করেন ১,৬৭৩ উইকেট। ১৯৫১ সালে ওয়ারউইকশায়ারকে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ জেতানোর পথে মৌসুমে নিয়েছেন ১৪৫ উইকেট। ১৯৫৫ সালে উইজডেন ‘বর্ষসেরা ক্রিকেটার’ হিসেবে মনোনীত হন।

১৩ টেস্টে ৪৪ উইকেট, এমন সাদামাটা যার রেকর্ড, তকে ক্রিকেট বিশ্ব কেন মনে রাখবে? হোলিস অমর হয়ে আছেন ব্র্যাডম্যান ট্র্যাজেডির নায়ক কিংবা খলনায়ক হিসেবে।

তবে ওয়ারউইকশায়ারে তিনি মহানায়ক। কেবল ব্র্যাডম্যানকে আউট করার জন্য নয়, এ কাউন্টির হয়ে খেলে অবিস্মরণীয় সব সাফল্য তিনি এনে দিয়েছেন। টেস্ট ক্রিকেটে নিজের সামর্থ্য দেখাতে পারেননি, তবে কাউন্টি ক্রিকেটে রাজত্ব করেছেন দুই যুগ।

নিজেদের মহানায়কের স্মৃতি ধরে রাখতে চেষ্টার কমতি রাখেনি ওয়ারউইকশায়ার। এজবাস্টনের মাঠে ঢুকলেই আপনাকে জানান দেবে এরিক হোলিসের উপস্থিতি। মাঠের একটি স্ট্যান্ডও তার নামে। মাঠের সবচেয়ে উৎসবমুখর ও আকর্ষণীয় স্ট্যান্ড সেটি। লোকে যতোই তাকে একটি বলের জন্য মনে রাখুক, ওয়ারউইকশায়ারে তিনি এক জীবনের নায়ক, অনেক জীবনের প্রেরণা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...