মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ার জার্সি গায়ে জড়ানো চাট্টিখানি কথা নয়। এত কম বয়সে অজি দলে ডাক পাওয়া দিবা স্বপ্নের মতো। সেই স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দিয়েছিল ডেমিয়েন ফ্লেমিংয়ের জীবনে। ফ্লেমিং শুধু মাত্র চব্বিশে ডাক পাননি। সে বছর অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অভিষেক হয়েছিলও তার।
ফ্লেমিং যখন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলা শুরু করেন, তখন তার প্রজন্মের খুব কম বোলারই ছিলেন যারা তারঁ মত স্যুইং করাতে পারতেন। দারুণ প্রতিভাবান এই পেসারের ক্যারিয়ার থামে মাত্র ২০ টেস্ট আর ৮৮ ওয়ানডেতে। কাঁধের ইনজুরি বারবার ফিরে এলে তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার বাঁধা গ্রস্ত হয়। তার যে দক্ষতা ছিল, তার সাথে যদি শরীরটা সায় দিত তাহলে তার নামের পাশে ম্যাচের সংখ্যাটা দুই আড়াইশো হতে পারত। পাশাপাশি উইকেট সংখ্যাটাও হতে পারত শ’চারেক। টেস্ট ও ওয়ানডে – দুই ফরম্যাটে ২৫ বোলিং গড়ই তার প্রমাণ।
মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ক্রিকেটের বাইশগজ মাতান ফ্লেমিং টেস্ট ক্রিকেটে তার অভিষেক হয় হ্যাট্ট্রিক দিয়ে। নিজের প্রথম ম্যাচেই পাকিস্তানের বিপক্ষে হ্যাট্রিক করে ক্রিকেটে তার আত্মপ্রকাশ।
১৯৯৪ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে স্বাগতিক পাকিস্তানের বিপক্ষে অনুষ্ঠিত তার অভিষেক টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে পর পর দুই বলে ফেরান আমির সোহেল এবং ইনজামাম উল হককে। আর তৃতীয় উইকেটটি ছিল সেলিম মালিকের। আর তাতেই অভিষেক টেস্টেই দ্বিতীয় ইনিংসে প্রথম হ্যাট্রিকের স্বাদ পান। হ্যাটট্রিকে ক্রিকেটে তার এই আত্মপ্রকাশ প্রত্যাশার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। অভিষেক টেস্টে তার আগে হ্যাটট্রিকের দেখা পেয়েছিলেন মাত্র দুইজন; মরিস আলম আর পিটার পেথেরিক। তৃতীয় বোলার হিসেবে তাদের পাশে নাম লেখান ফ্লেমিং।
অভিষেক ম্যাচেই সাত উইকেট। পরের ম্যাচে ইনজুরিতে বাদ। অভিষেকের ছড়ানো আলো এখানেই নিভে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এরপর থেকেই ইনজুরি হয়েছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী, যা ক্ষত-বিক্ষত করেছিল তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার।
টেস্ট ক্রিকেটে আর একবার হ্যাট্রিকের সুযোগ তৈরি করেছিলেন ফ্লেমিং। টেস্ট ক্রিকেটে, তার সেরা বোলিং ফিগার ছিল ১১ রানে ৫ উইকেট। ১৯৯৯-২০০০ সালে অ্যাডিলেডে ভারতের বিপক্ষে ১১ রানে পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন। সে ম্যাচে তিনি ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক তুলে নিতে পারতেন দ্বিতীয় স্লিপে থাকা শেন ওয়ার্ন যদি সহজ ক্যাচটা ফেলে না দিতেন।
ফিট ফ্লেমিং যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্য ছিলেন আতঙ্কের নাম। পেস বোলার হিসেবে দারুন আউটসুইংয়ে দক্ষতা ছিল তার, পুরানো বলে দারুণ রিভার্স সুইং করাতে পারতেন। তার এই আউটসুইং আর রিভার্স সুইং করানোর দক্ষতা ম্যাকগ্রা এবং গিলেস্পির ভাল করার মূল জ্বালানি ছিল।
মিতব্যয়ী বোলার হিসেবে তার আলাদা একটা নাম ডাক ছিল। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ডেথ ওভারেই বেশির ভাগ সময় বল করেছেন।
চাপের মুখে বল হাতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করার নজির আছে তার। এই যেমন ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের সেমি ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিপক্ষের সেই ম্যাচের কথা বলাই যায়। সে ম্যাচে চাপের মধ্যে বল করেও ম্যাচ জিতিয়েছিলেন অজিদের।
তার ক্যারিয়ারের সেরা ম্যাচে বলা যায় ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেমিফাইনাল ম্যাচে। ডেথ ওভারে দারুণ সব ইয়র্কার দিতে পারতেন বলে, শেষ ওভারে বল করতে ডেকে পাঠান অধিনায়ক। চাপে যে তিনি দারুণ বোলিং করে থাকেন তার প্রমাণ দিয়েছিলেন আগের বিশ্বকাপে।
তাই, এবার এই কাজটা তার জন্য সহজ হবে বলে ধরে নিয়েছিলেন সবাই। কিন্তু দক্ষিন আফ্রিকান ব্যাটসম্যান ক্লুজনার তার প্রথম দুই বলে পর পর দুই চার মারলে বড় ধাক্কা খেয়েছিলেন। কিন্তু স্বরূপে ফিরতে সময় নেননি তিনি, পরের দুটিতে ব্লকহোলে পাঠিয়ে দেন।
শেষ ওভারে জয়ের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ছিল মাত্র ৯ রান, প্রথম বলে দুই চারে আট রান নিতে পারলেও পরের বলগুলোতে রান নিতে পারেননি আফ্রিকান ব্যাটসম্যানরা। ফলে ম্যাচটি ড্র করতে সক্ষম হয় ফ্লেমিংয়ের অস্ট্রেলিয়া। ডেমিয়েন ফ্লেমিং অস্ট্রেলিয়া হয়ে একটি বিশ্বকাপ জিতেছিলেন।
শচীন টেন্ডুলকারের বিপক্ষে বল করাটা উপভোগ করতেন। শচীনের বিপক্ষে ২০টি ওয়ানডে খেলেছেন ফ্লেমিং, সেখানে পাঁচ বার তাকে আউট করেছিলেন। টেস্টেও আউট করেছিলেন দুইবার। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে লড়াইটা খুব ভাল জমত তাদের মধ্যে। টেন্ডুলকার আর শেন ওয়ার্নের লড়াইটা ছিল তার কাছে বেশ উপভোগের। একদিকে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান আর অন্যদিকে বিশ্ব সেরা বোলার।
মূলত বোলার হলেও ব্যাট হাতে তার দুটি অর্ধ-শতক আছে টেস্টে। ১৯৯৮ সালে গ্যাবায় তার ৭১ রানের অপরাজিত ইনিংসেই টেস্ট ড্র করেছিল অস্ট্রেলিয়া।
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ৮৮ ওয়ানডেতে ১৩৪ উইকেট নেন, তিনি বিভিন্ন ইনজুরিতে পড়ে ২০০০-২০০১ সালে এ সব ধরণের ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা করেছিলেন।
২০০৩ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট একাডেমিতে প্রধান কোচ হিসেবে নিযুক্ত হন। যেখানে তিনি ক্রিকেটের বোলিংয়ের সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলির সাথে সম্পর্কিত একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দেন। যা বাউলোলজি নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।এই তত্ত্বের জন্য ড্যামিয়েন ফ্লেমিং ‘দ্য বাউলোলজিস্ট’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর এই তত্ত্বকে তিনি একজন বোলারের শারীরিক, মানসিক এবং মানসিক ক্ষমতা সর্বাধিক করার বিজ্ঞান হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
এখন তিনি পাবলিক স্পিকিং অঙ্গনের একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক ম্যাচের ভাষ্যের সময় তাঁর কৌতুকপূর্ণ বোধের জন্য পরিচিত। তিনি অস্ট্রেলিয়ান শো ‘থ্যাঙ্কস গড ইউ হিয়ার’ এ নিয়মিত উপস্থিত হতেন। নি:সন্দেহে অস্ট্রেলিয়ায় জন্মানোটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ। ভুল সময়ে, ভুল জায়গায় জন্ম তাঁর। অন্য কোনো দেশে জন্মালে দিব্যি পেস বোলিংয়ের কিংবদন্তি বলে যেতেন তিনি।