করাচি ২০০০, অন্ধকারের অগ্নিবাদক

চারিদিকে সন্ধ্যা নেমে গেছে। ডিসেম্বর মাস, শীতের সময়। একটু আগেই অন্ধকার নামে। করাচির মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের ধ্বনি। কিন্তু তখনো ফ্লাডলাইট জ্বলে উঠেনি মাঠে। এরমাঝেই করাচির জাতীয় স্টেডিয়ামে দেশের সম্মান রক্ষার্থে মুখোমুখি লড়াই করছে পাকিস্তান আর ইংল্যান্ড।

অবাক হচ্ছেন অন্ধকারে কি করে ব্যাট চালাচ্ছেন ব্যাটাররা, ফিল্ডাররাই বা ক্যাচ লুফে নিচ্ছেন কি করে। আশ্চর্য হলেও সত্য সেদিন সন্ধ্যে নেমে আসার পরও খেলা গড়িয়েছিল মাঠে , আর সেই লড়াইয়ে শেষ হাসিটা হেসেছিল সফরকারী ইংল্যান্ড।

সেবারের টেস্টটা দুই দলের জন্যই ছিল সম্মানের। লাহোর আর ফয়সলাবাদে আগের দুই টেস্টই হয়েছিল ড্র। তা সত্ত্বেও মাঠ এবং মাঠের বাইরের নানা ঘটনায় সেবার উত্তাপ ছড়াচ্ছিল টেস্ট সিরিজটি। শেষ টেস্টের আগে লড়াই হচ্ছিল সমানে সমানে। সেই টেস্টের আগে করাচিতে কখনো হারেনি পাকিস্তান। অন্যদিকে টেস্ট র‍্যাংকিংয়ের তলানিতে চলে যাওয়া ইংল্যান্ডকে তখন নতুন দিনের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন অধিনায়ক নাসের হুসেইন।

দলে আগমণ ঘটছে দারুণ সব প্রতিভার, দায়িত্ব পাবার ১৮ মাসের মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩১ বছরের জয়খরা কাটিয়েছেন। তাছাড়া ইংল্যান্ডের সেই সফরটা ছিল পুরনো হিসেব মেটানোর। বছর দশেক আগে পাকিস্তানি আম্পায়ার শাকুর রানার কাছে অধিনায়ক মাইক গ্যাটিং এর ক্ষমা দৃশ্য তখনো ভুলতে পারেননি ইংলিশ সমর্থকরা। তাছাড়া আগের দুই টেস্ট ড্র হওয়ায় শেষ টেস্টে দুই দলই মাঠে নামে হাল না ছাড়া মানসিকতা নিয়ে।

টস জিতে ব্যাট করতে নামা পাকিস্তানকে পথ দেখান দুই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান ইনজামাম উল হক আর মোহাম্মদ ইউসুফ। ড্যারেন গফ আর অ্যাশলে জাইলসের ভালো বোলিং সত্ত্বেও এই দুজনের সেঞ্চুরিতে সুবাদে ৪০৫ রানের ভালো সংগ্রহ পায় স্বাগতিকরা।

জবাব দিতে নেমে অবশ্য ছেড়ে কথা বলেনি ইংল্যান্ডও, মাইক আথারটনের সেঞ্চুরি আর অধিনায়ক নাসের হুসেইনের হাফসেঞ্চুরির পাশাপাশি বাকিদের ছোট ছোট ইনিংসে তাদের ইনিংস থামে পাকিস্তানের চাইতে ১৭ রান পিছিয়ে থেকে।

পাকিস্তানের পক্ষে ওয়াকার ইউনূস নেন চার উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে বল হাতে আগুন ঝরান ইংরেজ বোলাররা। পাকিস্তান তাদের শেষ সাত উইকেট হারায় মাত্র ৮০ রানে, শেষপর্যন্ত সেলিম এলাহির ৩৭ রানের সুবাদে সংগ্রহ গিয়ে দাঁড়ায় ১৫৮ রানে। ড্যারেন গফ আর অ্যাশলে জাইলস দুজনেই পান তিনটি করে উইকেট। মহাগুরুত্বপূর্ণ পঞ্চম এবং শেষদিনে ইংল্যান্ডের সামনে জয়ের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৪৪ ওভারে ১৭৬ রান।

পাকিস্তানের অধিনায়ক মইন খান বুঝতে পেরেছিলেন এত অল্প রানের পুঁজি নিয়ে ব্যাটিংনির্ভর করাচির পিচে বোলাররা জেতাতে পারবেন না। তাই ইনিংসের শুরু থেকেই সময় বেশি সময় নিয়ে বল করতে নির্দেশ দেন বোলারদের।

রান আপ নিতে কিংবা ফিল্ডার পরিবর্তন করতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় নিয়ে খেলা বিলম্বিত করতে থাকেন পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা। ফলশ্রুতিতে করাচির বুকে যখন অন্ধকার নেমে আসে, তখনো জয় থেকে বেশ খানিকটা দূরে ইংল্যান্ড।

পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা তখন মেতে উঠেছে জয়ের সমান ড্র করতে পারার উল্লাসে, অন্যদিকে ইংল্যান্ড শিবিরে তখন শেষ মূহুর্তে তরী ডোবার হতাশা।

ঠিক এই সময়টাতে আবির্ভাব আম্পায়ার স্টিভ বাকনারের, পাকিস্তানিদের সকল দাবি অগ্রাহ্য করে খেলা চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। সাকলায়েন মুশতাককে টানা দুই চার মেরে গ্রাহাম থর্প যখন খেলা শেষ করলেন ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে করাচির জাতীয় স্টেডিয়ামে।

আসলেই কতোটা অন্ধকারে খেলা হয়েছিল সেদিন? এই প্রশ্নের উত্তরটা পাওয়া সেদিন ম্যাচ শেষে গ্রাহাম থর্প আর নাসের হুসেইনের ড্রেসিংরুমে ফেরার ছবিটা দেখলে। আলোকচিত্রী লরেন্স গ্রিফিথের সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে ফ্ল্যাশের ফলে গ্রাহাম থর্পের আলোকজ্জ্বল চেহারা আর পেছনে প্রায় অন্ধাকারাচ্ছন্ন করাচি স্টেডিয়াম।

ফ্ল্যাডলাইট ছাড়া সেখানে এতক্ষণ ক্রিকেট ম্যাচ হয়েছে এটা বললে বোধহয় কেউই বিশ্বাস করবেন না আজকের দিনে। তের বছর আগে আম্পায়ারের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল ইংল্যান্ড অধিনায়ক মাইক গ্যাটিংকে, আর সেদিন আরেক আম্পায়ারের বিচক্ষণতাতেই জয় পেয়েছিল ইংল্যান্ড। পোয়েটিক জাস্টিসের এর চাইতে বড় উদাহরণ বোধহয় ক্রিকেটের ইতিহাসে আর নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link