অ্যাসিস্ট, গোল এবং লাল কার্ড

পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে। বাংলায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ বাক্য। তাছড়া পশ্চিমাদের মতে ওয়াইন নাকি যত পুরোনো হয় তত তাঁর কদর বাড়ে৷ দু’টো ক্ষেত্রেই একটা বিষয় এক। সেটা পুরান। আর এসব কিছুতে আজ যাকে বেঁধে ফেলা যায় তিনি বার্সেলোনার পুরোনো দানি আলভেস। পুরোনো তবে নতুন মোড়কে মোড়ানো।

বয়সটা ৩৮ ছুঁয়েছে। কিন্তু কে বলবে এই লোক এত বুড়ো! না আপনিও বুঝবেন না। বয়সের বিন্দুমাত্র ছিটেফোঁটা নেই তাঁর খেলায় কিংবা খেলার ধরণে। ক্লান্তি? সে আবার কি? ওমন কোন শব্দ তো নেই দানি আলভেসের নিজস্ব অভিধানে। দ্বিতীয় মেয়াদে বার্সায় যোগ দিয়েছিলেন জাভি কোচ হয়ে আসার সাথে সাথেই।

জাভি কেন যে নিয়ে এলেন এই বুড়োকে তা নিয়ে ভ্রু কুচকানো মানুষের যে অভাব ছিলো না তা বলতে কোন দ্বিধা নেই। কিন্তু ঠিক কেন যে জাভি কোচের দায়িত্ব পেয়েই নিয়ে এলেন আলভেসকে তা তো এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

লা লিগার হাই ভোল্টেজ ম্যাচ। ঘরের মাঠে কাতালানরা আতিথেয়তা দিচ্ছে আরেক স্প্যানিশ জায়েন্ট আতলেটিকো মাদ্রিদকে। সিমিওনি বনাম জাভির লড়াইয়ে তুরুপের তাস যেন দানি। তা বহুকাল বাদে এমন গোছালো আক্রমণাত্মক ফুটবল উপহার দিলো বার্সেলোনা। অ্যাডামা তাওরে, পিয়েরে-এমরিক আউবামেয়াংদের অভিষেকের দিনে সব আলো নিজের করে নিয়েছে সেই দানি আলভেস।

অ্যাসিস্ট, গোল, লাল কার্ড। সবখানেই নামটা ধ্রুব। আর সেটা দানি আলভেস। হাই ভোল্টেজ ম্যাচ। শুরু থেকেই স্নায়ুচাপ ছুঁয়েছে দূর দিগন্ত। সেই ম্যাচের আট মিনিটেই পুরো ক্যাম্প ন্যু-কে স্তব্ধ করে দিয়ে গোল করে বসেন আতলেটিকোর বেলজিয়াম তারকা ইয়াননিক কারাস্কো।

কি করে সহ্য করেন দানি আলভেস এ গোল। শোধ তো দিতে হবে। নতুন দিনের স্বপ্নে বিভোর সমর্থকদের তো আর নিরাশ করা যায় না। ঠিক দু’মিনিট বাদেই নিজের জবাবটা জানিয়ে দিলেন আলভেস। মারফত বন্ধু জর্ডি আলবা।

মাঠের ডান পাশ থেকে হাওয়ায় ভাসিয়ে বল পাঠালেন দানি অন্যপ্রান্তে। সেখানে বল মাটিতে ছোয়ার আগেই শক্তিশালী বা-পায়ের ভলিতে তা জালে জড়ান আলবা। ব্যাস এসে গেলো সমতা। তাতেই কি সন্তুষ্ট হবেন আলভেস ও তাঁর দল? মোটেও না।

তাঁরা একের পর এক আক্রমণ করতে লাগলেন। রক্ষণ, মিডফিল্ড শেষমেশ আক্রমণভাগ সবখানেই সমানভাবে চোষে বেড়ালেন দানি আলভেস। তরুণদের শিখয়ে দিলেন কি করে খেলতে হয় বিশ্বের সেরা ক্লাবটির হয়ে। তরুণরা শিখলেন এবং গোল করলেন।

স্কোর শিটে নাম লেখালেন গাভি ও ডিফেন্ডার রোনাল্ড আরাউহো। নতুন দিনের এরাই তো কাণ্ডারি। ৩-১ গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় বার্সেলোনা। ড্রেসিং রুমে জাভি হয়ত একটু খেপিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরই এক সময়কার সতীর্থ দানি আলভেসকে।

হয়ত বলেছিলেন, ‘কি হে ছোকরারা গোল করে তুমি করো না?’ বন্ধুকে দেখিয়ে দিতে নিজেই করে বসলেন গোল। অসাধারণ ওয়ান-টু-ওয়ান বিল্ড আপে সতীর্থদের পা গলে পৌঁছে গেলো ডি-বক্সে। আতলেটিকো রক্ষণও হয়ত ভেবে পাচ্ছিলেন না ঠিক কি করবে তাঁরা।

তবে তাঁদের ভাবার আগেই দানি আলভেস ভেবে রেখেছেন এবং গোল করেছেন। ইয়ান ওবলাকের জন্যে নিতান্তই এক বিভীষিকাময় দিন এটি। চারটি গোল যে তিনি হজম করেছে বার্সার বিপক্ষে। যে বার্সা নিয়ে নাকি ট্রল হয়, নিন্দা হয়। কিন্তু তিনি হয়ত জানতেন না এই বার্সায় দানি আলভেসরাও রয়।

অ্যাসিস্ট করেছেন, গোল করেছেন। এবার পালা রেডকার্ড। নিতান্ত এক বোকামি কিংবা শরীরের ভারসাম্যহীনতা। সে যাই হোক দানি করে বসলেন এক ভুল। অগ্যতা তাঁর নামটি উঠে গেলো রেফারির কালো বইয়ে। লাল রঙের বিপদের কার্ডটি দেখিয়ে দিলেন রেফারি। ম্যাচ শেষের মিনিট বিশেক আগে দশ জনের দলে পরিণত হয় বার্সা। সমর্থকদের এমন গগন বিদারী অভ্যর্থনা শেষ কবে কে পেয়েছিলো বলুন তো! তাও আবার লাল কার্ড খেয়ে মাঠের বাইরে যেতে যেতে?

আলভেসের লাল কার্ডের পরও পুরো ক্যাম্প ন্যু দু’পায়ে সটান দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছে তাদের ঘরের ছেলেকে। যে ছেলে প্রতিটা ধমনীতে বহে খয়েরী-বেগুনি। যে ছেলের এই জার্সি গায়ে জড়ালে আর বয়স বাড়ে না, যে ছেলের এই জার্সি জড়ালে আর নিজের চিন্তা মাথায় আসেনা। দানি আলভেসরাই বারবার মনে করিয়ে দেয় ফুটবলটা ঠিক কতটা আবেগের। ঠিক কতখানি আপন হলে নিজেকে সপে দেওয়া যায় একটা ক্লাবের জন্যে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link