ক্রিকেটে মজার একটা টার্ম আছে ‘বানি’। কোনো ব্যাটসম্যান যদি বারবার একই বোলারের হাতে আউট হন, তাঁকে বলা হয় ওই বোলারের ‘বানি’। তো অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তী লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্নের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় ‘বানি’ কে ছিল জানেন? দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক ক্রিকেটার ড্যারিল কালিনান! টেস্ট এবং ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই তিনি ছিলেন ওয়ার্নের নিয়মিত শিকার। একবার কিংবা দুবার নয়, ক্যারিয়ারে মোট ১২ বার ওয়ার্নের ঘূর্ণিতে আউট হয়েছেন কালিনান!
ক্রিকেটের সবচেয়ে বিখ্যাত দ্বৈরথগুলোর একটা ছিল ওয়ার্ন বনাম কালিনান। ওয়ার্নকে তো এমন কথাও বলতে শোনা গেছে যে, ‘কত উইকেট পেলাম না পেলাম, সেসব নিয়ে ততক্ষণ ভাবি না, যতক্ষণ আমি কালিনানকে আউট করতে পারছি।’
অবসরের পর এক সাক্ষাৎকারে ওয়ার্ন সম্পর্কে কালিনানের সরল স্বীকারোক্তিটা ছিল এরকম, ‘কেন জানি না, খুব সাধারণ ভাবেই ওয়ার্ন ওয়াজ টু গুড ফর মি!’
ক্যারিয়ারজুড়ে বিশ্বের প্রায় সব আন্তর্জাতিক দলের বিরুদ্ধে ভাল পারফর্ম করলেও একমাত্র অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই টেস্টে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল রীতিমতো ভয়াবহ! মাত্র ১২.৭৫! এই লজ্জাজনক রেকর্ডের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যে শেন ওয়ার্নের তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না!
ডানহাতি ব্যাটসম্যান কালিনান বরাবরই লেগ স্পিনে একটু দুর্বল ছিলেন৷ অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার একটি টেস্ট ম্যাচের ঘটনা। মাত্রই ক্রিজে নামা কালিনানকে দেখে ওয়ার্ন বলে উঠেছিলেন, ‘শুধুমাত্র তোমাকে আউট করার জন্যই আমি গত দুই বছর ধরে অপেক্ষা করছি।’ ওয়ার্নের স্লেজিংয়ের প্রত্যুত্তরে কালিনানের তৎক্ষণাৎ জবাব, ‘মনে হচ্ছে এই পুরো সময়টা তুমি কেবল খেয়েই পার করেছ ৷’ বোঝাই যাচ্ছে, কালিনানের ইঙ্গিতটা ছিল ওয়ার্নের মুটিয়ে যাওয়া নাদুসনুদুস শরীরের দিকে!
স্টাইলিশ, এলিগ্যান্ট ও ন্যাচারাল স্ট্রোকমেকিং সাবেক ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানকে বিবেচনা করা হত তাঁর প্রজন্মের অন্যতম সেরা ব্যাটিং প্রতিভা হিসেবে। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তাঁর সাউন্ড টেকনিক, টেম্পারমেন্ট এবং ক্রিকেটের প্রায় সব ধরনের শটে তুমুল পারদর্শিতা দেখে অনেকে তাঁকে প্রোটিয়া কিংবদন্তী গ্রায়েম পোলকের উত্তরসূরি হিসেবেও ভাবতে আরম্ভ করেছিলেন।
বিশেষ করে পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে কালিনানের মত সাবলীল ব্যাটসম্যান সে যুগে কমই ছিল। এমন কোন শট নেই যেটা তাঁর হাতে ছিল না। উইকেটের দুদিকেই সমান স্বচ্ছন্দ কালিনান ছিলেন একজন ‘সুইট টাইমার অব দ্য বল’।
তাঁর সবচাইতে পছন্দের দুটো শট ছিল কাভার ড্রাইভ ও স্কয়ার কাট। পেসারদের রাইজিং লেন্থ বলে ‘অন দ্য আপ’ ড্রাইভিংকে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছিলেন তিনি।
কিংবদন্তী অলরাউন্ডার ক্লাইভ রাইসের মতে, ‘টেকনিক্যালি কালিনান ছিলেন পরিপূর্ণ এক ব্যাটসম্যান। ওর ব্যাটিং শট গুলো থেকে মনে হতে এমসিসির টেক্সটবুক থেকে উঠে এসেছে।’
ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ প্রোটিয়া ব্যাটসম্যান হিসেবে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই প্রথম শ্রেণির সেঞ্চুরি করা কালিনান ছিলেন নব্বই দশকের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ৩৩৭ রানের ইনিংসটিও কালিনানের দখলে।
টেস্ট ক্যারিয়ারে খেলা ৭০ ম্যাচে ৪৪.২১ গড়ে কালিনানের সংগ্রহ ৪৫৫৪ রান। আছে ১৪টি সেঞ্চুরি আর ২১টি ফিফটি। ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস অপরাজিত ২৭৫ রান, ১৯৯৯ সালে অকল্যান্ডে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে।
টেস্টে সর্বমোট ছয়বার ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছেন ড্যারিল কালিনান।
- শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৯৯৩ সালে কলম্বোর পি সারা ওভালে ১০২ ও ৭৩ রান
- নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৯৯ সালে অকল্যান্ডে ২৭৫* রান
- নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৯৯ সালে ওয়েলিংটনে ১৫২ রান
- ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২০০০ সালে কেপটাউনে ১২০ রান
- ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২০০১ সালে বারবাডোজে ১৩৪ ও ৮২ রান
- ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২০০১ সালে পোর্ট অব স্পেনে ১০৩ ও ৮৭ রান
১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অকল্যান্ডে ২৭৫ করে অপরাজিত ছিলেন কালিনান। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে টেস্টে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংসের আগের রেকর্ডটা ছিল গ্রায়েম পোলকের ২৭৪। কালিনান সেই রেকর্ড ভেঙে ২৭৫* করার পরপরই ক্রনিয়ে ইনিংস ঘোষনা করেন। ক্রনিয়ে সেদিন ইনিংস ঘোষণা না দিলে হয়ত আমলা (৩১১) নন; কালিনানই হতে পারতেন দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ান। ওই বছরেরই ডিসেম্বরে ডারবান টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২৭৫ রান করেছিলেন গ্যারি কারস্টেন।
প্রোটিয়াদের হয়ে দুটি বিশ্বকাপে অংশ নেয়া সাবেক এই ডানহাতি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান ক্যারিয়ারে ওয়ানডে খেলেছেন ১৩৮টি। সেখানে তিন সেঞ্চুরি ও ২৩ হাফ সেঞ্চুরিসহ ৩৩.০ গড়ে রান করেছেন ৩৮৬০। ক্যারিয়ার সেরা ১২৪ রান, ১৯৯৬ সালে নাইরোবিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে।
ওয়ানডেতে সর্বমোট ছয়বার ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছেন ড্যারিল কালিনান।
- পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৯৯৬ সালে শারজায় ১০৯ বলে ১১০* রান
- ভারতের বিপক্ষে ১৯৯৬ সালে জয়পুরে ১৩০ বলে ১১৬ রান
- জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৯৯৭ সালে সেঞ্চুরিয়নে ৯৮ বলে ৭৩ রান ও ১-০-৭-১
- অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৯৯৭ সালে ইস্ট লন্ডনে ১০৬ বলে ৮৫ রান
- ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৯৮ সালে ঢাকায় নকআউট বিশ্বকাপের ম্যাচে ৭০ বলে ৬৯ রান
- নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৯৯ সালে অকল্যান্ডে ৫৬ বলে ৯৪ রান
ওয়ানডেতে একবার ক্রিকেটের অদ্ভুত আইন ‘হ্যান্ডলিং দ্য বল’ আউটের শিকার হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৯ সালে ডারবানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচে বাঁহাতি স্পিনার কিথ আর্থারটনের একটি টার্নিং ডেলিভারিতে পুশ করেছিলেন কালিনান। বলে কিছুটা বাড়তি বাউন্স থাকায় ঠিকমত খেলতে পারেন নি তিনি। ব্যাটের কোনায় লেগে বলটি উপরে উঠে গেলে ফিল্ডার ক্যাচ নেবার আগে নিজের হাতেই বলটি ধরে ফেলেন ড্যারিল কালিনান! ‘হ্যান্ডলিং দ্য বল’ এর নিয়ম অনুযায়ী আম্পায়ারও বাধ্য হয়েছিলেন আঙুল তুলতে!
টেস্ট এবং ওয়ানডে উভয় ফরম্যাটেই কালিনান যে একজন বিশ্বমানের ব্যাটসম্যান ছিলেন এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তবে তাঁর ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়, তিনি তাঁর প্রতিভা কিংবা সামর্থ্যের প্রতি তেমন একটা সুবিচার করতে পারেন নি। যোগ্যতর ব্যাটসম্যান হিসেবে নিঃসন্দেহে আরও সমৃদ্ধ হতে পারত তাঁর ক্যারিয়ার।