ট্রল সম্রাট থেকে সত্যিকারের নেতৃত্বের মঞ্চে

তরুণ ক্রিকেটারদের নিয়ে আমরা অনেক সময় অনেক ভবিষ্যদ্বানী করি, অনুমান করি, কখনও হুটহাট অনেক কিছু বলি। সত্যি বলতে, সেসবের বেশির ভাগই বাস্তবে রূপ পায় না। কিছু কিছু মিলে যায়। কোনো একটা মিলে গেলে সেসব নিয়ে জাহির করাটা খুব দৃষ্টিকটূ ব্যাপার। তার পরও আজকে একটু বলতে ইচ্ছে করল।

তরুণ ক্রিকেটারদের নিয়ে আমরা অনেক সময় অনেক ভবিষ্যদ্বানী করি, অনুমান করি, কখনও হুটহাট অনেক কিছু বলি। সত্যি বলতে, সেসবের বেশির ভাগই বাস্তবে রূপ পায় না। কিছু কিছু মিলে যায়। কোনো একটা মিলে গেলে সেসব নিয়ে জাহির করাটা খুব দৃষ্টিকটূ ব্যাপার। তার পরও আজকে একটু বলতে ইচ্ছে করল।

তিন সংস্করণের নিয়মিত অধিনায়ক হিসেবে পথচলা শুরু করবেন নাজমুল হোসেন শান্ত। যে সময়টায় তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ধুঁকছিলেন, পায়ের নিচে জমিন খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তাকে নিয়ে তুমুল সমালোচনার পাশাপাশি ট্রল ও ব্যক্তিগত আক্রমণ চলছে প্রবল, সেই সময়টায় দুটি ব্যাপার অনেকবার বলেছি। টক শোতে, আড্ডায়, নানা জায়গায় বলেছি।

প্রথমত, আমাদের দেশের ক্রিকেট সিস্টেমের অনেক ঘাটতি, সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতার মধ্যেও তাকে অনেক যত্নে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। কোনো একটা সময় তিনি অবশ্যই দাঁড়িয়ে যাবেন। কেবল নিজের পথটা তাকে খুঁজে নিতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ব্যাপারটিই এমন। টেকনিক, স্কিল, টেম্পারামেন্ট, এসব তো লাগেই। তবে ২২ গজে রান করার পথটা একান্তই নিজের মতো করে বের করে নিতে হয়।

দ্বিতীয়ত, সবসময়ই বলেছি, শান্ত একদিন জাতীয় দলের অধিনায়ক হবেন। অন্তত কোনো একটা সংস্করণে হবেনই হবেন। প্রেসবক্সে আমার আশেপাশে যারা বসেন, সবারই তা মনে থাকার কথা। শান্তর চরম দু:সময়ের সময়ও এই কথা জোর দিয়ে বলেছি। সেটা কোনো ‘ওয়াইল্ড গেস’ ছিল না।

শান্তকে যতটা দেখেছিলাম (খুব বেশি না যদিও), তার ওয়ার্ক এথিকস যতটুকু দেখতাম, তার কথা শুনে যতটা বুঝতাম, খুব গভীর ক্রিকেট বোধ, ব্যক্তিত্ব, কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের ব্যাপারটি তাতে ফুটে উঠত আমার চোখে। এজন্যই বিশ্বাসটা ছিল। সবাই হাসত তখন। তবু বিশ্বাসটা ছিল আমার।

সেই শান্ত তিন সংস্করণ বাংলাদেশকে নেতৃত্বে দিয়ে ফেলেছেন এর মধ্যেই। তবে সত্যিকারের যাত্রাটা শুরু আগামী কাল থেকে। আজকে তাই তখনকার কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করল।

তবে, শান্তর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অধ্যায়ের যেমন শুরু হতে চলেছে, তেমনি সবচেয়ে কঠিন সময়ের শুরুটাও এখন। বাংলাদেশের বাস্তবতায় অধিনায়কত্ব পাওয়া মানে নড়বড়ে সময়ের শুরু। সুতোর ওপর হাঁটা যাকে বলে। আজকের অভিনন্দনের মালা কালকেই রূপ নিতে পারে সমালোচনার প্রবাহে, পরশু গালির তোপে।

এরপর চারপাশের চাপে নাভিশ্বাস উঠে যাবে তার। সমৃদ্ধ ক্রিকেট সংস্কৃতির দেশে যা হয়, বাংলাদেশে হয় তার উল্টো। এজন্যই অধিনায়ক শান্তর সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যান শান্ত।

ব্যাটসম্যান শান্ত যদি রানের ধারায় থাকেন, তাহলে দল হারতে থাকলেও খুব বেশি চাপে তাকে পড়তে হবে না। কিন্তু ব্যাটসম্যান শান্ত রানের খোঁজে থাকেন, তাহলে একদিন অধিনায়কত্বও হারিয়ে ফেলবেন। কোন পরিস্থিতি আদর্শ হওয়া উচিত, কোনটি নয়, এসব বলে লাভ নেই। বাংলাদেশের বাস্তবতার কথা বলছি।

এই তো, মুমিনুলের হক কত চেষ্টায় টেস্ট দলটাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলেন। সহজাত অধিনায়ক তিনি ছিলেন না। বাধ্য হয়েই কাঁধে নিতে হয়েছিল টেস্ট দলের দায়িত্ব। এরপর অনেক লড়াই করে, অনেক শিখে একটা পর্যায়ে টেস্ট সংস্কৃতি গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন, পেস বোলারদের পাশে দাঁড়ানো ও তুলে ধরার কাজটিও তিনি সবচেয়ে ভালো করেছেন, আরও নানাভাবে একটা পরিকল্পনার পথ ধরে টেস্ট দলকে এগিয়ে নেওয়া চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তার নিজের ব্যাটিং ফর্ম বাজে হয়ে যায়। নানা দিক থেকে চাপ আসতে শুরু করে। তিনি অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

শান্ত সেখানে তিন সংস্করণের অধিনায়ক। বাংলাদেশে তো প্রায়ই একটির সঙ্গে অন্য সংস্করণ গুলিয়ে ফেলা হয়। অধিনায়কের ক্ষেত্রে আরও বেশি হয় তা। এক বিন্দুও সংশয় নেই যে, তার ওপর চাপ ও চ্যালেঞ্জ থাকবে ভীষণ। তাকে তাই রান করতে হবে। নিয়মিত রান করতে হবে। তিনি যত ভালো অধিনায়কই হন, যত ভালো ভাবনা-পরিকল্পনাই থাকুক, ব্যাটে রান না থাকলে তিনি টিকতে পারবেন না।

খুব ভালো সময় ও বয়সে তিনি নেতৃত্ব পেয়েছেন। ২৫ বছর বয়স। দল একটা পালাবদলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তার সামনে সম্ভাবনা অপার। তবে আগে নিজের সঙ্গে জিততে হবে তাকে। তিন সংস্করণেই তিনি ভালো কিছু ইনিংস খেলেছেন। ধারাবাহিকতাও কিছু ছিল। তবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হলে আরও ধারাবাহিক হতে হবে সব সংস্করণেই।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, কোচের সঙ্গে রসায়ন। এখনও পর্যন্ত চান্দিকা হাতুরুসিংহে তাকে খুবই পছন্দ করেন। সমর্থন করেন। পাশে থাকেন। তবে কিছুদিন পর আস্তে আস্তে শান্তর নিজস্ব ভাবনার ভিত শক্ত হবে। স্বতন্ত্র দর্শন প্রস্ফুটিত হতে থাকবে। কর্তৃত্ব বাড়তে থাকবে বা বাড়াতে চাইবেন। নিজের মতামত আরেকটু বেশি প্রতিষ্ঠিত করতে চাইবেন। ওই সময়টায় তিনি ও কোচ কীভাবে মানিয়ে নিতে পারেন পরস্পরের সঙ্গে, সেটির ওপরও নির্ভর করবে অনেক কিছু।

২০১৬-২০১৭ মৌসুমের নিউজিল্যান্ড সফরে শিক্ষানবিশ হিসেবে দলের সঙ্গে গিয়ে হুট করেই শান্তর টেস্ট অভিষেক হয়ে গিয়েছিল কয়েকজন ক্রিকেটার চোটে পড়ার। ক্রাইস্টচার্চে তার অভিষেকের দিনটায় মাঠে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। এবার তার নেতৃত্বের নতুন শুরুতে মাঠে থাকতে পারছি না। তবে তার জন্য শুভ কামনা সবটুকু শুভ কামনা সবসময়ই আছে…

খুব ভাবতে ইচ্ছে করছে, তার এই অধ্যায়ে বাংলাদেশ দল ও বাংলাদেশের ক্রিকেট নতুন উচ্চতায় পা রাখবে। ভাবতে ইচ্ছে করছে, তিনি ছাপ রাখবেন এবং লেগ্যাসি তৈরি করবেন।

– ফেসবুক থেকে

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...